ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আগামী মাসে চালু হচ্ছে এ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্লান্টেশন পদ্ধতি

ঢামেক ও সিএমএইচে এ পর্যন্ত ২৬ রোগীর বোনম্যারো প্রতিস্থাপন

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ঢামেক ও সিএমএইচে এ পর্যন্ত ২৬ রোগীর বোনম্যারো প্রতিস্থাপন

নিখিল মানখিন ॥ বোনম্যারো (অস্থিমজ্জা) প্রতিস্থাপনে আশার আলো দেখছে বাংলাদেশ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) শুরু হওয়ার পর ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) গত বছরের নবেম্বরে দুজন ক্যান্সার রোগীকে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করা হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গত তিন বছরে ২৪ রোগীর বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। প্রত্যেক রোগী সুস্থ আছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বর্তমানে অটোলোগাস পদ্ধতিতে নিজেদের শরীর থেকে সেল নিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তবে আগামী মার্চ মাসের মধ্যে এ্যালোজেনিক ট্রান্সপ্লান্টেশন পদ্ধতি চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ পদ্ধতিতে কোন স্বজন কিংবা দাতার (ডোনার) শরীর থেকে সেল নিয়ে প্রতিস্থাপন করা হবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে কয়েকগুণ কম খরচে বোনম্যারো প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে ঢামেক হাসপাতালে। ঢামেকের বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন ইউনিট সূত্র জানায়, এখানে রোগীর বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন করতে খরচ হয় ছয় থেকে সাত লাখ টাকা। আর সরকারী অনুদান পেলে তা নেমে আসে তিন থেকে চার লাখ টাকায়। ভারত ও সিঙ্গাপুরে এ কাজে খরচ হয় যথাক্রমে ৪০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত লাগে। তবে সংশ্লিষ্টদের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার চিত্র ভিন্ন। এখানে চিকিৎসা নেয়া রোগীর স্বজনরা জানিয়েছেন, একজন রোগীকে সুস্থ করতে সর্বসাকল্যে খরচ ৫০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর ঢামেক হাসপাতালে বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন ইউনিট উদ্বোধন করা হয়। প্রথম ট্রান্সপ্লান্টেশন করা হয় ২০১৪ সালের ১০ মার্চ। চিকিৎসকরা বলছেন, বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে ব্লাড ক্যান্সার, লিউকোমিয়া, থ্যালাসেমিয়া, লিম্ফোমা, সিভিয়ার এ্যাপ্লাস্টি এ্যানিমিয়াসহ জটিল রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। বিএমটি সূত্র জানায়, বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে (এমজিএইচ) দুজন নার্স, দুজন টেকনোলজিস্ট এবং নয় চিকিৎসককে শুরুর দিকে আট সপ্তাহ প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়। এছাড়া এমজিএইচ ও একে খান হেলথ কেয়ার ট্রাস্টের মাধ্যমে যৌথভাবে এক বছরের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর তাদের বিএমটি স্পেশালাইজড নার্সিং সার্টিফিকেট দেয়া হয়। বিএমটি ইউনিটে বহির্বিভাগ রয়েছে। এখানে রোগীর ফ্রি ফলোআপ ও চিকিৎসাসেবা দেয়া হয়। বিএমটি ইউনিটে অত্যাধুনিক পাঁচটি ট্রান্সপ্লান্টেশন কেবিন রয়েছে, যেখানে ট্রান্সপ্লান্টেশন ও পরবর্তী সময়ে রোগীরা দুই-তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন। এর মধ্যে একটি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) হিসেবে সংরক্ষিত। এইচডিইউ হিসেবে চারটি পুরুষ ও চারটি মহিলা বেডের পৃথক রুম রয়েছে। চালু আছে ইমার্জেন্সি ল্যাবও। রক্ত পরিশোধনের একটি মেশিনও রয়েছে এখানে। আছে বিএমটি ফার্মেসি। এখানে এসেপটিক ও নিখুঁতভাবে কেমোথেরাপি গোলানো, সংরক্ষণ ও সরবরাহ করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রোগীদের ভোগান্তির অভিযোগও আছে। এছাড়া কোন কোন সময় ভুল রিপোর্টও দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রক্তরোগবিদ্যা (হেমাটোলজি) বিভাগের প্রধান ও হাসপাতালটির বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন ইউনিটের প্রধান এমএ খান বলেন, সব প্রতিস্থাপনই সফল হয়েছে। বোস্টনের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের (এমজিএইচ) সহযোগিতায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন ইউনিটে প্রথম রোগী ছিলেন ৫২ বছর বয়সী ওমর আলী। ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত ওমর আলীর বোনম্যারো প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৪ সালের ১০ মার্চ। প্রায় এক মাস পর হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান ওমর আলী। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পর তিনি ভাল আছেন। শুধু ওমর আলীই নন, এখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ আছেন আরও ২৩ রোগী। রোগীর স্বজনদের দাবি, একেকজন রোগীর চিকিৎসায় খরচ হয় প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এ প্রসঙ্গে এমএ খান বলেন, এটা দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা। অনেক পরীক্ষা আছে যেগুলো বাইরে থেকে করাতে হয়। তাই খরচের পরিমাণ কিছুটা বেড়ে যায়। তবে সব পরীক্ষা হাসপাতালে করানোর সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টা চলছে। সেটা সম্ভব হলে খরচ আরও কমবে। ঢাকা মেডিক্যালের বোনম্যারো প্রতিস্থাপন কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশে এতদিন কোন অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন সেন্টার ছিল না, অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আছে ২৮টি। এখানে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন সেন্টার না থাকায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা শুধু কেমো ও রেডিওথেরাপিনির্ভর ছিল। সিঙ্গাপুরে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করতে ব্যয় হয় এক কোটি টাকার উপরে, ভারতে প্রয়োজন হয় ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা আর দেশে প্রতিস্থাপন চালু হওয়ায় পাঁচ লাখ টাকায় অটোলোগাস ও ১০ লাখ টাকায় এ্যালোজেনিক বোনম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট করা সম্ভব হবে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন প্রকল্পের পরিচালক অধ্যাপক এমএ খান বলেন, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ইউনিট চালু হওয়ায় দরিদ্র ও অসহায় রোগীরা বেশি উপকৃত হবেন। বিত্তবানরা বিদেশে না গিয়ে এ দেশে স্বল্পমূল্যে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের সুযোগ পাবেন। আর্থিক সাশ্রয় ছাড়াও তাদের হয়রানি অনেকগুণ কমে যাবে। অত্যাধুনিক এ চিকিৎসাসেবা যাতে আরও বেশি মানুষ পেতে পারে সেজন্য এ বিভাগকে আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। বাড়াতে হবে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনোলজিস্ট। এছাড়া চিকিৎসক ও নার্সদের প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ প্রদান ও আর্থিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে ডোনারদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, অস্থিমজ্জা হচ্ছে হাড়ের মধ্যে থাকা এক ধরনের নরম টিস্যু আর স্টেমসেল হচ্ছে অস্থিমজ্জায় থাকা অপরিণত কোষ, যা শরীরে প্রয়োজনীয় রক্তকণিকা বাড়াতে কাজ করে। ট্রান্সপ্লান্ট প্রক্রিয়ায় ক্যান্সার রোগীর আক্রান্ত বোনম্যারো কেমোথেরাপির মাধ্যমে নষ্ট করে দাতার শরীর থেকে নেয়া স্টেমসেল রক্তে প্রবেশের মতো করেই শরীরে প্রবেশ করানো হয়। এক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না। দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে স্টেমসেলগুলো থেকে নতুন রক্তকণিকা তৈরি হতে শুরু করে। থ্যালাসেমিয়া, এ্যাপ্লাস্টিক এ্যানিমিয়ার মতো রোগে আক্রান্তদের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়।
×