ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আজ বিডিআর বিদ্রোহের আট বছর পার হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আজ বিডিআর বিদ্রোহের আট বছর পার হচ্ছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আজ বিডিআর বিদ্রোহের নামে পিলখানায় স্মরণকালের জঘন্যতম সেনা হত্যাযজ্ঞের ৮ বছর। এদিন বিডিআর বিদ্রোহীরা তথাকথিত দাবিদাওয়া আদায়ের নামে ৫৭ জন মেধাবী ও চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। একসঙ্গে এত সেনা কর্মকর্তা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। হত্যাযজ্ঞ মামলায় ফাঁসির দ-াদেশপ্রাপ্ত ১৫২ জনের রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে আর যাতে কোন বাহিনীতে এমন বিদ্রোহের ঘটনা না ঘটতে পারে, এজন্য নেয়া হয়েছে নানা পদক্ষেপ। বিডিআর বিদ্রোহের পর বাহিনীটির নাম পরিবর্তন করে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) করা হয়েছে। বিজিবির নতুন আইনে বিদ্রোহের শাস্তি সর্বোচ্চ ৭ বছরের পরিবর্তে মৃত্যুদ- করা হয়েছে। বাহিনীকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। বাহিনীতে প্রথমবারের মতো নিয়োগ দেয়া হয়েছে নারীদের। যারা সফলতার সঙ্গে সীমান্তের বিভিন্ন চেকপোস্টসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে দায়িত্ব পালন করছেন। আজ বিডিআর বিদ্রোহে শাহাদাতবরণকারীদের শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনী ও বিজিবি প্রধানসহ উর্ধতনরা। আজ ও আগামীকাল রবিবার শাহাদাতবরণকারীদের স্মরণে বিজিবির প্রতিটি দফতরে বিশেষ দোয়া, মিলাদ মাহফিলসহ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ইতিহাসের জঘন্যতম সেই বিডিআর বিদ্রোহের সূচনা হয় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের সভাপতিত্বে পিলখানায় বিডিআর দরবার হলে বার্ষিক দরবার শুরু হয়। এরই মধ্যে দরবার হলে উপস্থিত জওয়ানরা জাগো বলে হুঙ্কার দিয়ে দরবার হল ত্যাগ করে। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্রাগারের দিকে ছুটে যায়। সেখানে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তা মেজর রেজাউল করিমকেও টেনেহিঁচড়ে বের করে। তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এরপর অস্ত্রাগার লুট করে। বিদ্রোহী সিপাহী মাঈন লুন্ঠিত অস্ত্র নিয়ে দরবার হলে প্রবেশ করে মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের দিকে অস্ত্র তাক করে। এ সময় উপস্থিত অন্যান্য চৌকস সেনা কর্মকর্তারা মাঈনকে নিরস্ত্র করে ফেলেন। এরপরই দৃশ্যপট পাল্টে যায়। শত শত বিদ্রোহী অস্ত্রহাতে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। গুলিতে পুরো দরবার হল ঝাঁঝরা হয়ে যায়। বিদ্রোহীদের সরাসরি মদদ দেয় সুবেদার মেজর গোফরান মল্লিক। বিদ্রোহীরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। আর একে একে বাসা থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের। যা মহান স্বাধীনতা যুুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর নির্মমতাকেও হার মানিয়েছে। পৈশাচিক সেই হত্যাকা- থেকে বঁাঁচতে অনেকেই দিশেহারা হয়ে আশ্রয় নেন বিভিন্ন জায়গায়। বিদ্রোহীদের নির্যাতনে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বেশ কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা প্রাণ বাঁচাতে নিজের পোশাক খুলে বিডিআর জওয়ানের পোশাক পরেন। একজন সেনা কর্মকর্তা সন্তানের স্কুলের বেতন দেয়ার জন্য বিডিআরের স্কুলে যান। সেখানেই হামলা করে উন্মত্ত বিদ্রোহীরা। সেই সেনা কর্মকর্তাকে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা নিজের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন। প্রায় তিন দিন সেখানেই লুকিয়ে ছিলেন। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সেই সেনা কর্মকর্তা আর প্রধান শিক্ষিকার কপালে খাবার হিসেবে জুটেছিল মাত্র দেড় লিটার পানি। দেড় লিটার পানিতেই কোনমতে জীবন বাঁচে সেই সেনা কর্মকর্তা আর শিক্ষিকার। পরবর্তীতে তাঁদের যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তাঁরা ক্ষুধার যন্ত্রণায় টেবিলের নিচে অচেতন হয়ে পড়ে ছিলেন। বিদ্রোহের নির্মমতা এতটাই পৈশাচিক ছিল যে, যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অনেক সেনা কর্মকর্তাকে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো দৌড়ে পালানোর নির্দেশ দিয়ে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেছে উন্মাদ বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহীরা দরবার হলে উপস্থিতদের মধ্যে যাদের পেয়েছে তাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। দরবার হল থেকে একজন সেনা কর্মকর্তাকে ধরে টেনেহিঁচড়ে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। নেয়ার সময় সেনা কর্মকর্তারা খুনী বিডিআর বিদ্রোহীরা আমবাগান দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলে। সেনা কর্মকর্তা সরল বিশ্বাসে জওয়ানদের এমন নির্দেশ শাস্তি হিসেবে ভেবে দৌড়ে পালাতে যান, ঠিক তখনই তার পায়ে পর পর কয়েকটি গুলি করে বিদ্রোহীরা। এরপর আহত সেনা কর্মকর্তাকে বিদ্রোহীরা টেনেহিঁচড়ে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যায়। সেখানে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। টানা প্রায় দুই দিন নির্যাতন চালানোর পর ২৬ ফেব্রুয়ারি ওই সেনা কর্মকর্তাকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে বিদ্রোহীরা। আর ২৫ ফেব্রুয়ারির রাতে সেনা কর্মকর্তাদের কোয়ার্টারে তল্লাশি চালায় বিদ্রোহীরা। যাদের বাসায় পায়, তাদের হত্যা করে। আর যাদের বাসায় পায়নি, সেসব বাসায় লুটপাট ও তছনছ করে। একটি কোয়ার্টারের নিচে থাকা চারটি গাড়ি পুড়িয়ে দেয় বিদ্রোহীরা। অনেক বাসায় আগুন ধরিয়ে দেয়। লাখ লাখ রাউন্ড গুলি ছুড়ে বিদ্রোহীরা। বিডিআরের নিহত সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের স্ত্রীকে বাসায় হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহীরা ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করে। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার পর বিদ্রোহীরা শুরু করে পৈশাচিক আচরণ। তারা মৃতদেহ ম্যানহোলে ফেলে দেয়। পরবর্তীতে বেশ কয়েক জনের লাশ বুড়িগঙ্গা নদীতে ভেসে ওঠে। অনেকের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করে। হত্যাযজ্ঞের পর দ্রুত লাশ গুম করতে মৃতদেহগুলো খুবই আপত্তিকর অবস্থায় যত্রতত্র গণকবরে পুঁতে ফেলা হয়। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ১৯৭২ সালের বিডিআর আইনে বিদ্রোহীদের বিচার সম্পন্ন হয়। বিচার কার্যক্রম সরাসরি মিডিয়ায় প্রচার ও মিডিয়ার সামনেই করা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজ মুখে অথবা নিজ খরচায় নিয়োগকৃত আইনজীবীর মাধ্যমে তার বক্তব্য আদালতে তুলে ধরেন। যেসব বিদ্রোহী তা করেননি তাদের জন্য বিডিআরের তরফ থেকেই অভিযুক্তদের আইনী সহায়তা দেয়া হয়। আর হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় রাজধানীর তৎকালীন লালবাগ থানার ওসি নবজ্যোতি খীসা হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে লালবাগ থানায়ই পৃথক ২টি মামলা দায়ের করেন। মামলা ২টি পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। ফৌজদারি আইনে মামলা ২টির তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দেন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দ। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ওইদিন পিলখানায় প্রায় ১১ হাজার বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিল। হত্যাযজ্ঞ মামলায় মোট ২২০৫ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। মামলার তদন্তে ৭৯৭৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মামলায় ৫৪১ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। আসামিদের মধ্যে ২০ জন পলাতক। তদন্তে বেরিয়ে আসে, বিডিআর হত্যাযজ্ঞে পিস্তল, এলএমজি, এসএমজি ও গ্রেনেডসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৩৭শ’টি অস্ত্র ও অস্ত্র অনুযায়ী গোলাবারুদ ব্যবহৃত হয়েছে। বিদ্রোহের সময় পিলখানা থেকে ১শ’ ৯৯টি গ্রেনেড, ৬৪টি পিস্তল ও ৫টি রাইফেলসহ প্রায় ৩শ’টি অস্ত্র খোয়া গেছে। মামলায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু (পরবর্তীতে মৃত), আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী, যুবলীগ নেতা লেদার লিটন, ডিএডি তৌহিদুল আলম ও নাসিরসহ ৮৫০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে ৩ জনের মৃত্যু হয়। স্বাভাবিক কারণেই তাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ায় পুরনো ঢাকার বকশীবাজার আলীয়া মাদ্রাসা ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন মাঠে ঢাকার জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাস বসিয়ে হত্যাযজ্ঞ ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়েরকৃত পৃথক মামলা ২টির বিচার কাজ সম্পন্ন হয়। রায়ে ১৫২ জনকে মৃত্যুদ- এবং বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করা হয়। পরবর্তীতে কারাবন্দী অবস্থায় বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর মৃত্যু হয়। এদিকে বিডিআর বিদ্রোহের মতো কোন বাহিনীতে আর যাতে বিদ্রোহের ঘটনা না ঘটতে পারে, এজন্য বিডিআর বিদ্রোহের সাজার মেয়াদ পরির্তন করে সাত বছরের পরিবর্তে মৃত্যুদ- করা হয়। রক্তের দাগ লেগে কলঙ্কিত হওয়ায় বাহিনীটির নাম পরিবর্তনের পাশাপাশি লোগো পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয়। বাহিনীতে যোগ করা হয় নারীদের। এছাড়া পোশাকসহ আমূল পরিবর্তন করা হয় বাহিনীটির। দিন দিন বাহিনীর সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, বিডিআর বিদ্রোহের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিডিআর বিদ্রোহীদের ক্ষমা করার আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা শুরু হয়। টানা ২ দিনের বিদ্রোহের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। তবে ততক্ষণে ঘটে যায় ইতিহাসের বর্বরোচিত সেই জঘন্য হত্যাযজ্ঞ। বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহম্মদ মোহসীন রেজা জানান, নানা অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পিলখানা হত্যাকা-ে শহীদ ব্যক্তিবর্গের শাহাদাতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। শহীদ ব্যক্তিবর্গের রুহের মাগফিরাত কামনায় পিলখানাসহ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর সকল রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর খতমে কোরআন, বিজিবির সকল মসজিদে এবং বিওপি পর্যায়ে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় আজ সকাল নয়টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতির ও প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধানগণ (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। রবিবার ২৬ ফেব্রুয়ারি বাদ আসর পিলখানার বীর উত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনে শহীদ ব্যক্তিবর্গের আত্মার মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপির। এছাড়া স্বরাষ্ট্র সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক, শহীদ ব্যক্তিবর্গের নিকটাত্মীয়গণ, পিলখানায় কর্মরত সকল অফিসার, জুনিয়র কর্মকর্তা, অন্যান্য পদবীর সৈনিক এবং বেসামরিক কর্মচারীগণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন।
×