ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতির উৎসবে স্নিগ্ধতা এনেছে সাহিত্য সম্মেলন

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সংস্কৃতির উৎসবে  স্নিগ্ধতা এনেছে  সাহিত্য  সম্মেলন

মনোয়ার হোসেন ॥ সাহিত্য কি শুধুই সাহিত্যপ্রেমীর মননের খোরাক? নাকি সাহিত্য বলবে সমাজ বদলের কথা। বলবে মানবিক দর্শনের কথা। দেখিয়ে যাবে সভ্যতার পথরেখা নির্মাণের দিশা। এমন নানা বিষয় উঠে এলো কালি ও কলম সাহিত্য সম্মেলনের সূচনা দিনে। এসব নিয়ে কথা বললেন ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচকরা। শুক্রবার দিনভর চলেছে সৃজন ও স্বরূপের সন্ধান। বাংলাদেশ ও ভারতের ৫০ জন কবি ও লেখকের অংশগ্রহণে শুরু হওয়া এ সাহিত্যসভায় প্রাণময় হয়ে ওঠে বেঙ্গল সংস্কৃতি উৎসব। সিলেটের আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে ১০ দিনব্যাপী উৎসবের তৃতীয় দিন শুক্রবার এ সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। ছুটির দিনের সকালে সৈয়দ মুজতবা আলী মঞ্চে সম্মেলনের উদ্বোধন হয়। উদ্বোধন করেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক। উদ্বোধনী আলোচনায় অংশ নেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক বেগম আকতার কামাল, পশ্চিমবঙ্গের প্রথিতযশা মঞ্চ অভিনেত্রী ও নির্দেশক শাঁওলি মিত্র এবং পশ্চিমবঙ্গের প্রাবন্ধিক ও গবেষক অমিয় দেব। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেনÑ উৎসবের আয়োজক বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত। সভাপতিত্ব করেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধরী।’ উদ্বোধনী বক্তব্যে হাসান আজিজুর হক বলেন, সংস্কৃতির উৎসবে এ সাহিত্য সম্মেলন যোগ করেছে বিশেষ তাৎপর্য। বাংলা সাহিত্যের অখ-তার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমার জন্ম পশ্চিমবঙ্গে। বাংলা সাহিত্যকে আমি কখনও খ-িতভাবে দেখি না। দশকওয়ারি কিংবা পূর্ব পাকিস্তান বা পশ্চিম পাকিস্তানÑ এভাবে বাংলা সাহিত্যকে বৃত্তবন্দী করা যায় না। বেগম আকতার কামাল বলেন, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সাহিত্য হচ্ছে মানুষের মিলনের কেন্দ্রবিন্দু। গল্প কিংবা কবিতার সুতোয় গাঁথা সাহিত্যের আশ্রয়ে স্থাপিত হয় বৈশ্বিক সংযোগ। কারণ, সাহিত্য বলে সত্য ও বাস্তবতার কথা। অমিয় দেব বলেন, সাহিত্য সংস্কৃতির বাইরে নয়। সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সাহিত্যের বিকল্প নেই। এই উৎসবে সেটার চমৎকার প্রকাশ ঘটেছে। তিনি আরও বলেন, এক সময় আমি ইংেেরজীতে কবিতা লিখতাম। কিন্তু বাংলা লেখার শ্রম ও মধুরতার কোন তুলনা নেই। সভাপতির বক্তব্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সংস্কৃতির বিকেন্দ্রীয়করণের উদহারণ হচ্ছে এ উৎসব। সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চায় সিলেটের সুনাম অনেক পুরনো। সবাইকে সাহিত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রযুক্তির কারণে এখন নাকি মানুষ বই পড়ে না। তবে প্রযুক্তি আগেও ছিল। তাই বলে সাহিত্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি। তাই অপরাধ প্রযুক্তির নয়, বরং প্রযুক্তির অপরাধ ঘটাচ্ছে এর মালিকরা। পুঁজিবাদ চিরকালই সাহিত্যের শত্রু। মুনাফা ছাড়া কিছু বোঝে না পুঁজিবাদ। সাহিত্য মানুষকে বিচ্ছিন্ন করতে চায় না, সংযুক্ত করতে চায়। কবিতা কিংবা কথাসাহিত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছেÑ দার্শনিকতা। জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্্দীন দু’জনেই কবিতায় লিখলেও তাঁদের পার্থক্য হচ্ছে, প্রকাশের দার্শনিকতায়। দার্শনিকতাই সাহিত্যকে দিয়েছে গভীরতা। আর সাহিত্যের দার্শনিকতায় ন্যায় ও অন্যায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দার্শনিভাবেই সমাজ বদলের দায়িত্ব নেবে সাহিত্য। পুুঁজিবাদকে অসুখ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। একটি নদীতে ঢেউ ও বালুÑদ্’ুটোই থাকে। পুঁজিবাদের আগ্রহ ঢেউয়ের পরিবর্তে বালুর প্রতি। বালুর আগ্রাসনে বিনষ্ট হবে নদী। তাই লেখকদের দাঁড়াতে হবে ঢেউয়ের পানে। তিনদিনের সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম দিনে সকাল থেকে সন্ধ্যায় অবধি অনুষ্ঠিত হয় চারটি অধিবেশন। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা ও সম্ভাবনা শীর্ষক অধিবেশনের মূল বক্তা ছিলেন হাসান আজিজুল হক। কবি আসাদ চৌধুরী সভাপতিত্বে মূল বক্তা ছিলেনÑ হাসান আজিজুল হক। আলোচনায় অংশ নেন পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক অনিতা অগ্নিহোত্রী এবং প্রাবন্ধিক ও গবে সুরেশ রঞ্জন বসাক। সমাজ বাস্তবতা ও বাংলাদেশের সাহিত্য শীর্ষক অধিবেশনে মূল বক্তা ছিলেন বেগম আকতার কামাল। অমিয় দেবের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ও লেখক আহমাদ মোস্তফা কামাল। সাহিত্যে ঐতিহ্যচেতনা ও স্বরূপসন্ধান শীর্ষক অধিবেশনে মূল বক্তা ছিলেন আসামের কবি ও প্রাবন্ধিক তপোধীর ভট্টাচার্য। আলোচনায় অংশ নেন কবি সাজ্জাদ শরিফ, তরুণ কবি ও লেখক স্বকৃত নোমান এবং আসামের গবেষক সৌমেন ভারতীয়া। সভাপতিত্ব করেন লেখক সনৎকুমার সাহা। লেখক ওয়াসি আহমেদের সভাপতিত্বে সাহিত্যে নারীজীবন শীর্ষক অধিবেশনে মূল বক্তা ছিলেন কবি রুবী রহমান। আলোচনায় অংশ নেন কলকাতার কবি ও কথাসাহিত্যিক মন্দাক্রান্তা সেন, কলকাতার প্রাবন্ধিক অশোক মুখোপাধ্যায় ও কথাসাহিত্যিক শাহীন আখতার। আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠিত হবে সৈয়দ শামসুল হক স্মারক অধিবেশন। মুহম্মদ জাফর ইকবালের সভাপতিতে এতে আলোচনা করবেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, প্রশান্ত মৃধা, আবুল মোমেন প্রমুখ। দিনভর সাহিত্য সম্মেলন শেষে সন্ধ্যায় জমজমাট হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক আয়োজনে সাজানো উৎসবটি। সবার চোখ ও কান নিবিষ্ট হাসন রাজা মঞ্চের পানে। বিকেল থেকেই নিবন্ধের মাধ্যমে বাড়তে থাকে শ্রোতা-দর্শকের আনাগোনা। সন্ধ্যা পেরুতেই বিপুলা আয়োজনটি উপভোগে ভিড় জমায় অগণন মানুষ। সিলেটের বাইরেও সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জের শিল্পানুরাগীরা উপভোগ করেছেন সাংস্কৃতিক পরিবেশনা। এ দিনের সান্ধ্যকালীন উৎসবে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেনÑ তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। বিশেষ অতিথি ছিলেন ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এবং বাংলাদেশ প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক প্রধান ইনাম আহমদ চৌধুরী। হাসানুল হক ইনু বলেন, জবরদখলকারীরা এ দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চায়। আর যখন সমাজে অত্যাচার ও অবিচার হয় তখন প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় শিল্প। সেই উদাহরণ হচ্ছেÑ এই উৎসব। জঙ্গী হামলা যে আমাদের সংস্কৃতির প্রবহমানতাকে দমাতে পারেনি তার প্রমাণ হচ্ছে এ উৎসব। উদ্বোধনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হয় পরিবেশনা পর্ব। এদিন রাগাশ্রয়ী বাংলা গান শুনিয়ে শ্রোতাদের অন্তরে প্রশান্তি ছড়িয়ে দেন পশ্চিমবঙ্গের কণ্ঠশিল্পী বর্ণালী চট্টোপাধ্যায়। নজরুলসঙ্গীত ও সেকালের গান শোনান সুবীর নন্দী ও ঝুমা খন্দকার। সব শেষে ছিল জীবনমুখী গানের পরিবেশনা। শ্রোতাদের অপার আনন্দে ভাসিয়ে গান শোনান কৃষ্ণকলি ও তার দল।
×