ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপিতে গভীর হতাশা, আওয়ামী লীগ ধুঁকছে গ্রুপিং কোন্দলে

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বিএনপিতে গভীর হতাশা, আওয়ামী লীগ ধুঁকছে গ্রুপিং কোন্দলে

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী রাজনীতিতে বিভক্তি রেখা ক্রমেই গভীর হচ্ছে। এর প্রভাব প্রকটভাবে পড়েছে সকল অঙ্গ সংগঠনে। বিএনপির নিষ্ক্রিয়তায় মাঠে এখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ। নিজেদের মধ্যে মারামারি, সংঘাত। আওয়ামী লীগ যেন একের ভেতরে অনেক। এতে খুবই বিরক্ত দলটির তৃণমূলের সাধারণ কর্মী সমর্থকরা। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনের বিএনপি বলয়ে এখন গভীর হতাশা। দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় মনোবল হারিয়েছেন নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। নেই আন্দোলন সংগ্রাম বা উল্লেখযোগ্য তৎপরতা। রাজনীতির মাঠে এখন আওয়ামী লীগের প্রভাব একচ্ছত্র। যেহেতু শক্তিশালী প্রতিপক্ষ নেই সেহেতু ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরেই গড়ে উঠছে দল-উপদল। বড় নেতারা এ গ্রুপগুলোর নেতৃত্বে। একদা বহুধা বিভক্তি থাকলেও এখন তা পরিণত হয়েছে প্রধান দুই নেতার অনুসারীতে। শীর্ষ দুই নেতার মধ্যে একজন মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি সাবেক মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং অপর জন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ সর্বক্ষেত্রে মুখোমুখি অবস্থানে দুই নেতার অনুসারীরা। ব্যবসা ও সুযোগ-সুবিধা বাগিয়ে নিতে তারা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছে। মাঝেমধ্যেই ঘটছে গোলাগুলি বা রক্তক্ষয়ী ঘটনাও। কেন্দ্রের সতর্কবার্তা থাকলেও তা অকার্যকর। চট্টগ্রামে বিভিন্ন সংস্থার টেন্ডার বা ঠিকাদারি আয়ত্তে নিতে সক্রিয় মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক অনুসারী কিছু গ্রুপ। কয়েক বছর আগে রেলের টেন্ডার নিয়ে গুলিতে প্রাণ গেছে এক শিশুসহ ২ জনের। সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া দুগ্রুপের দুই নেতা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী। বিএনপি ও জামায়াতের রাজনীতি অনুপস্থিত থাকলেও নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ থেমে নেই। এসব মারামারি আদর্শিক রাজনীতির অংশ নয়। ‘মহিউদ্দিন ভাই’-‘নাছির ভাই’Ñ স্লোগানে চলছে তৎপরতা। চট্টগ্রামে নগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ দুই নেতার প্রভাবে বিভক্তি ছড়িয়ে পড়েছে অঙ্গ সংগঠনগুলোতেও। গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনেও ঘটেছে হাতাহাতির ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে, সংগঠনের নগর সভাপতি হাসিনা মহিউদ্দিন তার নেতৃত্ব ধরে রাখার পথ সুগম রাখতে প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের কাউন্সিলর ও ডেলিগেট কার্ড দেননি। ফলে সাধারণ সম্পাদক তপতী সেনগুপ্তার অনুসারীদের থাকতে হয় সম্মেলন স্থলের বাইরে। তারা জোরপূর্বক প্রবেশ করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে হাতাহাতি হয়। সে দিন প্রবেশ বঞ্চিতরা সম্মেলনের প্রধান অতিথি এ্যাডভোকেট ফজিলাতুন্নেসা ইন্দিরার গাড়ি আটকে দিয়ে প্রতিবাদ এবং তাদের অনুযোগের কথা জানায়। শেষ পর্যন্ত কাউন্সিলে হাসিনা মহিউদ্দিন পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে পাল্টা কমিটি ঘোষণা দেয় প্রতিপক্ষ। সেখানে তপতী সেনগুপ্তা জানান, হাসিনা মহিউদ্দিন কখনও আওয়ামী লীগ করেননি। তিনি চোরের মতো কাউন্সিল করেছেন। এ অংশটির প্রতি বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের সমর্থন রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কেননা, সম্মেলনের দিন তাদের সঙ্গে আ জ ম নাছিরের অনুসারী কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং নেতাকে দেখা গেছে। চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের বিভক্তি নতুন কোন বিষয় নয়। এ বিভক্তি কখনও দ্বিধা, কখনও ত্রিধা আবার কখনও বহুধা। নেতাদের মধ্যে কে কখন কোন বলয়ে তাও বোঝা মুশকিল। সাপে-নেউলে সম্পর্ক হতে দেরি নেই আবার তেলে-জলে মিশ খেতেও দেরি নেই। এক সময় মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন আফসারুল আমিন, খোরশেদ আলম সুজন এবং চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম। কিছুদিন পর দেখা যায়, অবস্থান পাল্টে ভিন্ন মেরুতে আফসারুল আমিন ও ছালাম। অপরদিকে ছিলেন নুরুল ইসলাম বিএসসি এবং আ জ ম নাছির উদ্দিন দীর্ঘ সময় ধরে এক বলয়ে। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বন্দর পতেঙ্গা আসনের সংসদ সদস্য এমএ লতিফের। বর্তমানে নুরুল ইসলাম বিএসসি এবং মহিউদ্দিনের মধ্যে দূরত্ব কমেছে বলে ধারণা করা হয়। কেননা, এই দুজনকে বিভিন্ন প্রোগ্রামে একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে। দ্বিধাবিভক্ত দুটি গ্রুপের মধ্যে একাংশের নেতারা এখন ক্ষমতাবান। তাদের কেউ মন্ত্রী, কেউ মেয়র, কেউ এমপি বা গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার চেয়ারম্যান। তবে সরকারের কোন পদে না থাকলেও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দল এবং অঙ্গ সংগঠনের ওপর মহিউদ্দিন চৌধুরীর এখনও যথেষ্ট প্রভাব। চট্টগ্রাম নগরীতে যতগুলো সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে তার প্রায় সবই সাবেক ও বর্তমান মেয়র অনুসারীদের মাঝেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুগ্রুপের সংঘর্ষেও এ দুই নেতার অনুসারীরা। আওয়ামী লীগ দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতাসীন। ক্ষমতার বলয়ে থাকায় দল ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতারা ব্যবসা পাওয়ার তৎপরতায় সক্রিয়। আর এ কারণেই মুখোমুখি বিভিন্ন গ্রুপ উপ-গ্রুপ। এরা হয় বর্তমান মেয়র নয়ত সাবেক মেয়রের অনুসারী। রেলের টেন্ডার নিয়ে গোলাগুলির ঘটনা ঘটনার পর গত ২২ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবনে ঘটেছে গোলাগুলির ঘটনা। কর্ণফুলী নদীর একটি ঘাট ইজারার টেন্ডার পেতে সক্রিয় দুটি গ্রুপের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলাকালে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়। মেয়র আ জ ম নাছির বিষয়টিকে স্রেফ ভুল বোঝাবুঝি দাবি করলেও ঘটনাটি যে মূলত, টেন্ডারবাজি তা পরিষ্কার। তিনি মেয়র হওয়ায় কর্পোরেশনে এখন তার অনুসারীদেরই আধিপত্য। সে দিনের ঘটনায় মুখোমুখি দুটি অংশই মেয়রের অনুসারী। চট্টগ্রাম মহানগরের মতো দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ এবং মহিলা আওয়ামী লীগেও ব্যাপক কোন্দল বিরাজমান। প্রবীণ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী এমপির মৃত্যুর পর জেলা কমিটির সভাপতি হন মোসলেম উদ্দিন আহমেদ। উপ-নির্বাচনে ওই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন তার জ্যেষ্ঠপুত্র শিল্পপতি সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ। বর্তমানে তিনি ভূমি প্রতিমন্ত্রী। দক্ষিণ জেলায় মোসলেম উদ্দিন আহমেদ এবং সাইফুজ্জামান চৌধুরীর রাজনীতি দুগ্রুপে বিভক্ত হয়ে আছে। বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে দুগ্রুপের মধ্যে একাধিক দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। দলের দুই শীর্ষ নেতার প্রভাবে সহযোগী সংগঠনগুলোতেও বিভক্তি ছড়িয়ে আছে। সর্বশেষ গত ২০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনেও দুই অংশের মধ্যে তুমুল হট্টগোলের ঘটনা ঘটে। সেখানে সাধারণ সম্পাদকের পদ না পেয়ে সম্মেলনস্থলেই জ্ঞান হারান মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী শাহিদা আক্তার জাহান। শুধু মহিলা আওয়ামী লীগেই নয়, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সকল সহযোগী সংগঠনেই বিভক্তি রেখা জোরালো। এসব ঘটনা চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। কর্মিসমর্থক মহল ক্ষুব্ধ, বিক্ষুব্ধ। প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও গ্রুপে গ্রুপে অপ্রীতিকর নানা ঘটনা ঘটেই চলেছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগের নামে যা চলছে তাতে সাধারণ মানুষের মনে সংগঠনটির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের যত শক্তিক্ষয় তার সবই নিজেদের মধ্যে লড়াই করে। কবে কখন বিএনপি-জামায়াত তথা আদর্শিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ লড়েছে তা স্মরণ করাও কঠিন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রদল বা ছাত্র শিবিরের সংঘাতের ঘটনা বিরল। তবে দুই নেতার অনুসারীরা প্রতিনিয়তই একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রয়েছেন। বিষয়টি এমনই যে, এক আওয়ামী লীগের ভেতরেই যেন রয়েছে অনেক দল। তারা দলীয় আদর্শিক রাজনীতির পরিবর্তে নেতার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত। দীর্ঘদিন ধরে দ্বিধাবিভক্তি ও আন্তঃসংঘাত থামাতে কেন্দ্রীয় উদ্যোগ প্রত্যাশা করেন সাধারণ সমর্থকরা।
×