ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি

রান্নাঘরের উত্তাপ ছড়াবে বাজার আর পরিবহনে

প্রকাশিত: ০৫:১৫, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রান্নাঘরের উত্তাপ ছড়াবে বাজার আর পরিবহনে

রশিদ মামুন ॥ গৃহস্থালি এবং সিএনজিকে নিরুৎসাহিত করাই গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির প্রধান উদ্দেশ্য বলে মনে করা হচ্ছে। গৃহস্থালিতে নতুন সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আর সিএনজির দাম বাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে জ্বালানি তেলের সমপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এতে করে এই দুই খাতের গ্রাহকরা প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হবে। সারাবিশ্বেই জ্বালানি তেলের দাম কমার ফলে অন্যান্য জ্বালানির দামও কমেছে। কিন্তু এর মধ্যে কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পর এবার দেশের প্রধান জ্বালানি গ্যাসের দরও বৃদ্ধি করা হলো। এতে রান্নাঘরের উত্তাপ যেমন বাড়বে। সেই সঙ্গে বাজার আর পরিবহন খরচ সবখানেই বাড়তি পয়সা গুনতে হবে মানুষকে। দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে আগামী সপ্তাহে আদালতের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে রিট আবেদন করতে যাচ্ছে কনজ্যুমার এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ক্যাব। সংগঠনটির উপদেষ্টা জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, এই দাম বৃদ্ধি ব্যবসায়ীদের স্বার্থে হয়েছে ভোক্তার স্বার্থে নয়। এখানে এলপিজির দর যৌক্তিক হলেই সাধারণ গ্রাহক স্বস্তি পেত। কিন্তু এখানে তা করা হয়নি। তিনি জানান, আগামী সপ্তাহে দাম বৃদ্ধি স্থগিত করার আবেদন করবেন আদালতে। গ্যাস বিতরণ কোম্পানির হিসাব বলছে সারাদেশের মোট গ্রাহকের ১২ ভাগ আবাসিক গ্রাহক। আবাসিক গ্রাহকের অন্তত ৭০ ভাগ তাদের বেঁধে দেয়া সীমার চেয়ে কম গ্যাস ব্যবহার করে। এতে করে বিপুল পরিমাণ গ্যাস সাশ্রয় হয়। বেঁচে যাওয়া গ্যাস দিয়েই সব রকমের অপকর্ম ধামাচাপা দেয় বিতরণ কোম্পানিগুলো। অথচ এবার আবাসিক গ্রাহকদের ওপর বেশি দাম বৃদ্ধির বোঝা চাপানো হয়েছে। এবার সব থেকে বেশি বৃদ্ধি করা হয়েছে আবাসিক গ্রাহকের গ্যাসের দর। সরকারের ওপর ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরেই আবাসিক গ্যাস বন্ধের দাবি তুলে আসছিলেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন রান্না করে খাওয়ার মানেই হচ্ছেÑ মূল্যবান গ্যাসের অপচয় করা। এর বিপরীতে তাদের এই গ্যাস দিয়ে দিলে তারা দেশে আরও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতেন। পরপর দুবার সরকার পরিচালনা করলেও এত দিন জ্বালানি বিভাগ তাদের কথা উপেক্ষা করেছে। কিন্তু এবার আনন্দের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এতে একদিকে সাধারণ মানুষ গ্যাস ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হলে এই গ্যাস ব্যবসায়ীরা পাবেন। অন্যদিকে এলপিজি ব্যবসা উৎসাহিত হবে। দেশের এলপিজি ব্যবসার ক্ষুদ্র অংশ সরকারের হাতে থাকলেও সিংহভাগ দখল করে আছে বেসরকারী খাত। এলপিজির দাম নির্ধারণের ওপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। এখন এলপিজির আন্তর্জাতিক বাজার দর কম হওয়ায় দেশীয় বাজারে কিছুটা কম দামে এলপিজি পাওয়া যায়। কিন্তু এলপিজির চড়া দামের সময় এসব নিয়ে মানুষকে হট্টগোল করতে দেখা গেছে। যদিও এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনেরই এলপিজির দর নির্ধারণ করে দেয়ার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কিছু করতে দেখা যায়নি কমিশনকে। বিগত কয়েক বছর ধরেই সরকার এলপিজি প্ল্যান্ট নির্মাণ করে সারাদেশে কম দামে এলপিজি সরবাহের কথা বলে আসছে। যদিও মানুষ সেই কম দামের এলপিজি আজও পায়নি। আবাসিক গ্রাহকের জন্যই বিতরণ কোম্পানি যা গ্যাস কিনছে তার থেকে বেশি বিক্রি দেখাতে পারছে। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি) দাম বৃদ্ধির যে প্রস্তাব জমা দিয়েছে সেখানে দেখানো হয়েছে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানি ১ দশমিক ৮২ শতাংশ, জালালাবাদ বিতরণ কোম্পানি শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ, কর্ণফুলী ৪ দশমিক ২৯, বাখরাবাদ ৪ ও পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানির সিস্টেম গেইন ছিল ৫ শতাংশ। এই ধরাবাহিকতা শুধু এবারের নয় প্রত্যেকবারই গ্যাস বিতরণ কোম্পানি এমন সিস্টেম গেইন করে। এর আগে ২০০৯ সালে আবাসিকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে এক চুলায় ৪০০ টাকা দুই চুলায় ৪৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর ২০১৫ সালে এক চুলায় ৬০০ টাকা এবং দুই চুলায় ৬৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার এই দাম বৃদ্ধি করে এক চুলায় ৯০০ এবং দুই চুলায় ৯৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গত ৯ বছরের মধ্যে এবারই সর্বাধিক গ্যাসের দর বেড়েছে আবাসিকে। অধ্যাপক শামসুল আলম এ প্রসঙ্গে জানান, আমরা এসব বিষয়ে বারবার এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। তিনি দাবি করেন আবাসিক গ্রাহকের সীমা ধরা হয় ৯২ সিএফটি কিন্তু তারা ব্যবহার করেন ৪২ সিএফটি। শীতের সময় এটা গড়ে ২০ সিএফটিতে নেমে আসে। এসব বিষয়ে বারবার বলার পরও কমিশন কর্ণপাত করে না। কমিশনের মূল্যায়ন কমিটি গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই বলে মতামত দিলেও কমিশন গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করছে। এটি গণশুনানি বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দাম বৃদ্ধি করার যে নীতি তাকে প্রশ্নবিদ্ধই করছে না বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। ফলে এই দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া প্রহসনমূলক বলে মনে করেন তিনি। এর বাইরে সিএনজির দরও পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর আগে গত সাত বছরে গ্যাসের দাম না বাড়লেও সিএনজির দাম বাড়ানো হয়েছে। এই পরিমাণ ২০০ শতাংশ। ২০১৫ সালে প্রতি ঘনমিটার সিএনজি ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করা হয়। দেশে উৎপাদিত গ্যাসের ৫ শতাংশের কম ব্যবহার করে সিএনজি খাত সরকারকে মোট গ্যাস মূল্যের ২২ ভাগ এর বেশি রাজস্ব দেয় সিএনজি খাত। এরপরও বৃহস্পতিবার আবারও ১৪ দশমিক ২৮ ভাগ সিএনজির দাম বৃদ্ধি করা হলো। যার অর্ধেকটা মার্চেই কার্যকর হবে। সরকার সিএনজিকে নিরুৎসাহিত করলেও জ্বালানি তেলের দামও কমাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে অনেক দিন স্থিতিশীল থাকলেও তেলের দাম দেশীয় বাজারে কমানো হচ্ছে না। সংদীয় কমিটির বৈঠকে পর্যন্ত সদস্যরা বলছে জ্বালানি তেলের দাম না কমায় এলাকায় তাদের কথা শুনতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ তাদের প্রশ্ন করছে কেন সরকার তেলের দাম কমাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত জ্বালানি তেলের দাম জানুয়ারি থেকেই কমানোর ঘোষণা দেন। কিন্তু জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এই দাবি নাকোচ করে দেন। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তেলের দাম কমছে না। এতে করে সরকার তেল এবং গ্যাস দুই দিক থেকেই ব্যবসাবান্ধব অবস্থায় রয়েছে। এবার গ্যাসের দাম স্পর্শ করেছে বিদ্যুত খাতকেও। অতীতে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয়ে প্রভাব পড়বে বিবেচনায় বিদ্যুত খাতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়নি। কিন্তু এবার বিদ্যুতে শতকার ১২ ভাগের ওপরে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদ্যুত উৎপাদনের ৬০ শতাংশই জ্বালানি খরচ। প্রসঙ্গত, কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন পর্যায়ে প্রভাব পড়বে। এই প্রভাবের ফলে পিডিবির লোকসান বাড়ায় বিদ্যুতের দামও বৃদ্ধি করতে হবে।
×