ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছোট কাগজ ॥ প্রগাঢ় ভালবাসা আর আবেগের ফসল

প্রকাশিত: ০৪:৫১, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ছোট কাগজ ॥ প্রগাঢ় ভালবাসা আর আবেগের ফসল

ছোট কাগজ বা লিটল ম্যাগাজিন। নামটি শুনে মনে হতে পারে ছোট কাগজ, এ আর এমন কি! কিন্তু কাজটি ছোট না। অনেক বড়, অনেক বড় মনের মানুষের কাজ। শিক্ষিত সমাজে এর প্রভাবও অনেক বেশি। এটি সৃষ্টির পেছনে অনেক কষ্ট, ত্যাগ-তিতিক্ষা, লাঞ্ছনা জড়িয়ে আছে। কিছু সাহিত্যপ্রেমী সৃষ্টিশীল মানুষের সাহিত্যের প্রতি প্রগাঢ় ভালবাসা ও আবেগ এবং অবর্ণনীয় কষ্টের ফসল এই লিটল ম্যাগাজিন। নবীন লেখকদের আশ্রয়স্থলও এই লিটল ম্যাগাজিন। কারণ প্রতিষ্ঠিত মাধ্যম বা পত্রিকাগুলোতে তাদের তেমন সুযোগ নেই। শিল্প-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে চলমান ধারার বাইরে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা ও মতামত ব্যক্ত করার মুদ্রিত বাহন হলো লিটল ম্যাগাজিন। সাধারণত এটি ছোট কলেবরে হয়। সব সময় যে ছোট হয়, তা নয়। অনেক সময় বড়ও হতে পারে। ছোট হওয়ার কারণ হচ্ছে, এই পত্রিকা যারা বের করেন, তারা সাহিত্যে নবাগত। সাহিত্যের প্রতি তাদের অনুরাগ আছে, এ নিয়ে প্রচুর পাগলামো আছে, কিন্তু অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই, সামর্থ্য নেই, পৃষ্ঠপোষকতাও নেই। এ ম্যাগাজিন অনিয়মিত এবং অবাণিজ্যিক। লিটল ম্যাগাজিন প্রতিনিধিত্ব করে সমমনা নবীন লেখক দলের, যাদের চিন্তা-ভাবনা-দর্শন চলমান ধারা থেকে ভিন্ন এবং অভূতপূর্ব। রংপুরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির মতো জাতীয় দিবসগুলোকে ঘিরে প্রকাশিত হয়ে আসছে লিটল ম্যাগাজিন। এ ম্যাগাজিনগুলো বাংলা সাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি অনেক কবি-সাহিত্যিকের জন্ম দিয়েছে। এমনি এক তরুণ কবি, লেখক-সাংবাদিক জাকির আহমদ। তিনি প্রায় ১৬ বছর ধরে রংপুর থেকে ‘রঙধনু’ নামে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করে আসছেন। তিনি বলেন, ২০০১ সাল থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর অসম্ভব কষ্টে পত্রিকাটি বের করছি। খরচ বাঁচাতে বলতে গেলে একাই সব কাজ করি। লেখা সংগ্রহের কষ্ট, লেখকদের সংঘবদ্ধ করার কষ্ট, বিজ্ঞাপন সংগ্রহের কষ্ট, পত্রিকা ছাপার কষ্ট, পাঠকের দরজায় পৌঁছে দেয়ার কষ্ট, বিজ্ঞাপনের টাকা না আদায়ের কষ্ট, অনেক সময় পত্রিকা-বিক্রির টাকা না পাওয়ার কষ্টÑ সবই নিজেকে করতে হয়। ১০৪ পৃষ্ঠার পাঁচ শ’ কপি ছোট পত্রিকা ছাপাতে কমপক্ষে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। সেটা নিজেকেই দিতে হয়। কেউ লাভের আশায় লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করে না। যেহেতু এই পত্রিকার কোন প্রচার নেই, সার্কুলেশন নেই, প্রচুর পাঠক নেই, তাই এর বিজ্ঞাপনও নেই। এর জন্য যেসব বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় তা আসে ব্যক্তিগত যোগাযোগ, সম্পর্কের ভিত্তিতে। খরচের তুলনায় তা অতি অপ্রতুল। কখনও কখনও পাঁচ শ’ টাকার বিজ্ঞাপন আদায় করতে তিন শ’ টাকা খরচ হয়। সময় নষ্ট হয় হাজার টাকার। তিনি বলেন, অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিন খুব স্বল্পায়ু নিয়ে জন্মায়। এর অকাল মৃত্যু এবং নিয়মিত প্রকাশিত না হওয়ার প্রধান কারণ এটি অবাণিজ্যিক। এমনকি কাগজ বিক্রি থেকে কোন টাকা আসে না। সবাই শুধু সৌজন্য সংখ্যার প্রত্যাশায় থাকে। জাকির বলেন, লিটল ম্যাগাজিন নবচেতনা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে এবং লেখক ও পাঠকদের মধ্যে সে নবচেতনাকে সঞ্চারিত করে। যারা সাহিত্য, দর্শন ও শিল্প-চেতনায় গতানুগতিক ধারার বিরোধী, তারা চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটায় নিজেদের তৈরি লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে সাহিত্যের নতুন চিন্তা, নতুন সাহিত্যিকের দল, নতুন সাহিত্যের ধারা ও সাহিত্যের নতুন ক্ষেত্র জš§ নেয়। নতুন যুগ তার নতুন ভাষায় কথা বলতে চায়। সেই ভাষাটা যারা দেয়, তারাই হচ্ছে লিটল ম্যাগাজিনের লেখক। রংপুর থেকে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ‘দুয়ার’-এর সম্পাদক পরিবার পরিকল্পনার মাঠ কর্মী সাথী বেগম বলেন, আমার লেখার হাতেখড়ি লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে। এক সময় রংপুর থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে লিখতাম। লেখা ছাপা হলে যারপরনাই আনন্দ পেতাম। এ থেকে লেখার অনুপ্রেরণা পাই। সেই অনুপ্রেরণা আমাকে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশের সাহস যুগিয়েছে। আমার হাত দিয়েই প্রচুর নতুন লেখক সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আফসোস করে বলেন, আজকাল ছেলেমেয়েরা মোবাইল ফোন আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভার্চুয়াল জগতে ডুবে আছে। তারা সাহিত্য চর্চা করে না। ফলে তাদের জীবন বোধ অগভীর, সমাজ সচেতনতা ও দায়বদ্ধতা নেই বললেই চলে। এ ধরণের ছেলেমেয়েদের খুব সহজেই বিপথে ঠেলে দেয়া যায়। হচ্ছেও তাই। প্রকৃত অর্থে যারা শিল্প সাহিত্যের সঙ্গে জড়িত থাকে তাদের পক্ষে বিপথে যাওয়া সম্ভব নয়। তিনি বলেন, অনেকেই খুব আবেগ নিয়ে লিটল ম্যাগ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু অর্থে যখন টান পড়ে, আবেগ তখন হাওয়ায় মিশে যায়। লিটল ম্যাগাজিন টিকিয়ে রাখতে গেলে সমাজের সর্বস্তরের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন ’৭১-এর আগে এবং পরে ‘বিপ্লবী কণ্ঠ’ ও ‘জনতার কণ্ঠ’ নামে দুটি ছোট কাগজ বের করতেন। তিনি বলেন, তখন পত্রিকা ছাপানোর জন্য তেমন পৃষ্ঠপোষক পাওয়া যেত না। আমরা সরকারী অফিসের সাইক্লোস্টাইল মেশিন থেকে বিনামূল্যে ছাপিয়ে নিতাম। পরিচিত, বন্ধু, বড় ভাইদের কাছে আবদার করে টাকা তুলতাম। নিজেরা চাঁদা দিতাম। খরচ মেটাতে পুশ সেল করতাম। আমাদের মিশন ছিল, যে করেই হোক পত্রিকা বের করতে হবে, মানুষকে জাগাতে হবে। ’৭৬-৭৭ সালের দিকে প্রকাশিত সংসপ্তক, শনিতে সূর্যোদয়, শিকল ছেঁড়া সূর্য্য, প্রতিরোধ পত্রিকার সম্পাদক আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা এর মধ্য দিয়ে সাহিত্য চর্চা করতাম। আমাদের জ্যেষ্ঠ ও সমসাময়িক যারা লিটল ম্যাগাজিনে লেখালেখি করতেন তাদের অনেকেই অনেক বড় মাপের লেখক হয়েছেন। রংপুরের ছেলে আনিসুল হক, সৈয়দ সামছুল হক, রফিকুল হক দাদুভাই, অধ্যাপক আলীম উদ্দিন ও অধ্যাপক শাহ আলম তার বড় প্রমাণ। কিন্তু এখন সাহিত্য চর্চার চেয়ে আত্ম প্রচার বেশি হচ্ছে। মানসম্মত ছোট পত্রিকার সংখ্যা কম। প্রচুর ভুল বানানে, ভুল শব্দে নি¤œমানের ছোট পত্রিকা বের হচ্ছে। অসাহিত্যিকরা সাহিত্য চর্চা করছে শুধু নিজেকে জাহির করতে। এ প্রবণতা ভাল নয়। ষাটের দশকে বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিনগুলোকে কেন্দ্র করে সাহিত্য-আন্দোলন শুরু হলে তা ছড়িয়ে পড়ে মফস্বল শহরে। রংপুর জেলা শহর থেকেও তখন বেশ কিছু ছোট কাগজ বের হতো। সে সময় যে ক’জন লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে প্রয়াত চারণ সাংবাদিক ও গ্রামীণ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ মোনাজাত উদ্দিন অন্যতম। তিনি রবি বাসরীয় সাহিত্য আসর থেকে ‘শব্দ’ নামে লিটল ম্যাগাজিন বের করতেন। এটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তার অকাল মৃত্যুর পর সেটি বন্ধ হয়ে যায়। তার সঙ্গে আরও যারা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, তাদের মধ্যে মাহফিল হক (বর্ষার পদাবলি, কবি সভা), কাইসুল হক (কালান্তর), শেখ আমানত (অভিযাত্রিক), রকিবুল হাসান বুলবুল (উচ্চারণ, শব্দ), আবুল কালাম আজাদ (শতাব্দীর আহ্বান), আবু ইউসুফ আতাউর রহমান, নূরুল ইসলাম কাব্যবিনোদ (ছান্দসিক), আনোয়ার হোসেন রাজু এবং অধ্যাপক আলীম উদ্দিন, অধ্যাপক শাহ আলম, অধ্যাপক ড. শাশ্বত ভট্টাচার্য প্রমুখ। তারা বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে নক্ষত্রের মতোই সেগুলো কিছুদিন জ্বলে শেষ পর্যন্ত নিভে গেছে বা দু’-একটি মিটিমিটি জ্বলছে। তবে সে ম্যাগাজিনগুলো প্রচুর নুতন লেখক সৃষ্টি করেছে। Ñআবদুর রউফ সরকার, রংপুর থেকে
×