ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

লে. কর্নেল মহিউদ্দিন সেরনিয়াবাত (অব)

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ ॥ অভিন্ন হৃদয়

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ ॥ অভিন্ন হৃদয়

(শেষাংশ) ২৫ ও ২৬ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম পর্বে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, সৈয়দপুর ও এর আশপাশ এলাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় এবং এই সকল এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে নেয়। এরপর দ্বিতীয় পর্বে তারা জেলা, মহকুমা ও থানা পর্যায়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে যেখানেই নিরস্ত্র জনতার বাঁশের লাঠি, বল্লম, তীর-ধনুকের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে, সেখানেই ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে এক বিভীষিকাময় ও ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এমন নাজুক অবস্থায় আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ ও প্রায় সকল সাংসদ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মোতাবেক ভারতে পৌঁছে যান। তারা প্রথমেই বিএসএফের মাধ্যমে ভারতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। ১০ এপ্রিল ’৭১ তারিখে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ভোটে নির্বাচিত সাংসদদের সম্মতিক্রমে প্রথমে একটি স্বাধীনতার ঘোষণা আদেশ জারি এবং এই আদেশে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাকে ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই ঘোষণার এক সপ্তাহ পর ১৭ এপ্রিল ’৭১ মুজিবনগর আম্রকাননে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক (পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডে জড়িত) কে পররাষ্ট্্র ও কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়ে একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার দায়িত্ব দেয়া হয় আওয়ামী লীগ দলীয় সাংসদ কর্নেল এম,এ,জি ওসমানী (অব.) কে। বঙ্গবন্ধু মুজিব তখন পাকিস্তানের কারাগারে থাকা সত্ত্বেও মূলত তিনিই ছিলেন এই জাতির নেতা, চালিকাশক্তি ও ঐক্যের প্রতীক। বঙ্গবন্ধুর এভারেস্ট অপেক্ষা উচ্চতর জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার, তার প্রতি আনুগত্য ও সম্মান প্রদর্শনের জন্যই তার অনুপস্থিতিতে তাকেই রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, যা পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। বঙ্গবন্ধুর প্রতি মানুষের ভালবাসা ছিল এতটা প্রবল ও আবেগপূর্ণ যে দেশের মানুষ বিশেষত গ্রামের মা-বোনেরা, যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ কখনও চর্মচক্ষু দিয়ে তাকে দেখেনি, তারা মুজিবরের জন্য নিয়মিত রোজা রাখত, নামাজ শেষে দু’হাত তুলে আল্লাহর কাছে তার জীবন ভিক্ষা চাইত। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও নিজ নিজ ধর্মানুযায়ী সৃষ্টিকর্তার কাছে তার জন্য প্রার্থনা করতেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ছিল মুক্তিযোদ্ধা ও দেশবাসীর জন্য অনুপ্রেরণা। আর তাই যুদ্ধের নয় মাস প্রতিদিন সকল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর সেই অগ্নিঝড়া ভাষণের অংশবিশেষ (বজ্রকণ্ঠ) ও বঙ্গবন্ধুর ওপর রচিত অসংখ্য গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারের মাধ্যমে জাতির মনোবল চাঙ্গা করা হতো। ১৭ এপ্রিল ’৭১ প্রবাসী সরকার গঠিত হওয়ার পরই তারা বিশ^ জনমত সৃষ্টি, ভারত-রাশিয়া-পোল্যান্ডসহ সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র-গোলা বারুদ সংগ্রহ, লাখ লাখ বাঙালী শরণার্থী, যারা প্রাণের ভয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় নিচ্ছিল তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভারত সরকারের কাছে ধর্ণা দেয়া, ভারতের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ মানুষের মধ্যে থেকে তরুণ-যুবকদের নির্বাচন ও মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং প্রশিক্ষণ শেষে তাদের পুনরায় নিরাপদে দেশের ভেতরে দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় পাঠানোর সকল আয়োজন করতে হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে মোট এগারোটি সেক্টরে ভাগ করত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ ত্যাগকারী বাঙালী অফিসারদের ঐ সকল অঞ্চলে যুদ্ধে নেতৃত্বদানের দায়িত্ব দেয়ার ব্যবস্থাও করতে হয়েছিল। দেশের অভ্যন্তরে পাক বাহিনীর গুলির মুখে অবস্থানকারী বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মনোবল অটুট রাখার দায়িত্বও ছিল তাদের। কেননা তাদের মনোবল ভেঙ্গে গেলে এবং তাদের সহযোগিতা ব্যতীত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। দেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করে একাধিক রাজনৈতিক দল যখন একটি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সফল করতে পারে না, সেখানে ভিন্ন দেশে অবস্থান করে চীন-মার্কিন-মধ্যপ্রাচ্য সমর্থন পুষ্ট একটি সরকার ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা এবং সেই বিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করা মোটেও সহজ ছিল না। কিন্তু তা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও সাধারণ মানুষের আস্থা, প্রবাসী সরকারের প্রতিটি সদস্যের মেধা, অক্লান্ত পরিশ্রম ও আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস ও বুক ভরা দেশপ্রেম এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন ও সম্পৃক্ততার জন্য। এখানে উল্লেখ্য যে, এই দেশ জন্ম দিয়েছে অসংখ্য দেশপ্রেমিক, রাজনীতিক ও বিপ্লবীকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভিন্ন তারা কেউই এভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে সমগ্র জনগণ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও সম্পৃক্ত করতে পারেনি। মার্চ থেকে ডিসেম্বরÑ এই বাংলায় বর্বর হানাদার পাক বাহিনী লাখ লাখ বাঙালীর রক্তে হোলি খেলেছে, লাখ লাখ ঘরবাড়ী জ¦ালিয়ে দিয়েছে, লাখো মা বোনের সম্ভ্রমহানির মতো মহাপাপ করেছে। তারপরও ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ তারিখে পৃথিবীর মানচিত্রে হাজার বছর যে জনপদটি কেবল কলোনী হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল, তা অবশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তিরানব্বই হাজার পাকবাহিনী সদস্য নতজানু হয়ে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধুর বিশাল ব্যক্তিত্ব ও ইমেজের কারণে মাত্র তিন মাসের মধ্যে ভারতের মিত্র বাহিনীর সকল সদস্য এই দেশ থেকে ফেরত যায়, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। অতএব বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস।
×