ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানীদের ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে

প্রকাশিত: ০৪:৪৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

পাকিস্তানীদের ঔদ্ধত্য সীমা ছাড়িয়ে গেছে

বিগত ৪৬ বছরেও উগ্র আচার-আচরণ ও চরম জঙ্গী মানসিকতাসম্পন্ন মনোভাব থেকে পাকিস্তানীদের ঘৃণ্য কার্যকলাপের এতটুকু পরিবর্তন ঘটেনি। ইতিহাস বিকৃতি, পাপাচার ও মিথ্যাচারে পারদর্শী পাকিস্তানীদের বিষয়ে অনেকবার আমি লিখেছি। বেশ কয়েকবার আমি ওদের ‘পাপী’ পাকিস্তানীও বলেছি। পাকিস্তানের (পাপীস্তানও বলা যেতে পারে) সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই আসলে উগ্র জঙ্গীবাদ ও মিথ্যাচার নামের পাপাচারে বিশ্বাসী হয়ে এ কাজটিতে লিপ্ত হয়ে থাকে। অনেক সময় ‘পাপী’ শব্দটিও যেন ওদের অপরাধ ও অপকর্মের বিবরণ তুলে ধরতে নিতান্তই অপ্রতুল মনে হয়। ওদের শাসন, শোষণ, নিষ্পেষণ ও অত্যাচারের নির্মমতায় অতিষ্ঠ হয়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহ্বানে বাঙালীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যায়। ২৫ মার্চ বাংলার সিংহ পুরুষ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে শুরু হয়ে যায় দেশকে শত্রুমুক্ত করার সর্বাত্মক যুদ্ধ- স্বাধীনতার যুদ্ধ। বাংলার দামাল ছেলেরা জীবন বাজি রেখে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে দখলদার পকিস্তানীদের পর্যুদস্ত করে এ দেশ থেকে তাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে চরম পরাজয়ের গ্লানিতে ক্ষতবিক্ষত পাকিস্তানীরা বাংলাদেশ ও তার জনগণের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার এবং বিষোদ্গারের সকল সীমা-পরিসীমা ছাড়িয়ে যায়। তার সর্বশেষ সংস্করণ হলো পাকিস্তানী লেখক জুনায়েদ আহমেদের লেখা ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোডেড’ নামের কল্পকাহিনী ও নির্লজ্জ মিথ্যাচারে ভরপুর একটি বই। একাত্তরে প্রিয় মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে পরিচালিত মহান মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার এবং সে সময় হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার দায় উল্টো দেশপ্রেমিক মুক্তিবাহিনীর ওপর চাপিয়ে বিকৃত তথ্য-চিত্র সংবলিত বইটি জাজ্বল্য মিথ্যাচারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শুধু মিথ্যাচার করেই ঘৃণ্য পাকিস্তানীরা ক্ষান্ত হয়নি, ওরা সীমাহীন ঔদ্ধত্য ও ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে বাংলাদেশের গৌরবময় অভ্যুদয় নিয়ে ‘পাপী’ পাকিস্তানী লেখকের বইটি পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই পাকিস্তানে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে সযতেœ পাঠিয়ে এটি মূল্যবান দলিল হিসেবে সংরক্ষণের জন্য অনুরোধ করেন। পাকিস্তানী লেখকটির মতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মাত্র ৩৪ হাজার পাকিস্তানী সেন্য আত্মসমর্পণ করেছে বলে দাবি করেছে। আথচ সারাবিশ্ব জানে যে, ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্যের আত্মসমর্পণ তাদের গ্লানিকর পরাজয়ের স্বীকারোক্তিই বহন করে। এই উন্মাদ লোকটি এ দেশে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক নিহত হওয়ার ঘটনাটিকেও অতিরঞ্জিত বলে আখ্যায়িত করেছে। দুই লাখ নারী ধর্ষিত হওয়ার বিষয়টিকে মিথ্যাচার বলে অভিহিত করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে। অবশ্য বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও বছর দেড়েক আগে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। পাকিস্তানী লেখকের সঙ্গে তার কি অদ্ভুত মিল। সেজন্য অনেকেই বলছেন একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কে খালেদা জিয়ার প্রশ্ন তোলা পাকিস্তানী লেখককেও উৎসাহিত করেছে। এ দেশে অনেকে মজা বা বিদ্রƒপ করে পাকিস্তানীদের ‘পাকি’ বলে থাকে। এটা গালির মতোই শোনায়। যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশে পাকিস্তানীদের গাল দেয়ার সময় ‘পাকি’ বলা হয়। সব দিক দিয়েই আসলে পাকিস্তানীরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। কারণ, দেশটির অতীত এবং বর্তমান জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কর্মকা-। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের মহান বিজয় দিবসের দিন গত ১৬ ডিসেম্বর করাচীতে একটি আলোচনা সভায় পাপিষ্ঠ জুনায়েদ লিখিত বইটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। তবে আসমা জাহাঙ্গীরের মতো নগণ্য কিছু ভাল মানুষও ওই দেশটিতে আছেন। সাংঘাতিক বৈরী পরিবেশেও তারা সত্য কথা বলতে পিছপা হন না। তাদের এই জন্য শ্রদ্ধা জানাতে হয়। বইটিতে একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অনেক নারকীয় ঘটনার দায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়েছে। পাশাপাশি দুটি রিক্সার একটির ওপর চালক ও একজন যাত্রীর নিথর দেহ এবং অপর রিক্সাটির ওপর চালকের প্রাণহীন দেহ পড়ে থাকার মর্মান্তিক দৃশ্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাতের রক্তপিপাসু পাকিস্তানী হায়েনাদের নৃশংস হত্যাকা-েরই প্রমাণ বহন করে। এ ছবিটিসহ সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত ঘৃণ্য হানাদার পাকিস্তানী সেনাদের পৈশাচিক হত্যাকা-ের আরও কিছু ছবির ক্যাপশন পাল্টিয়ে তা মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে বলে নির্লজ্জ অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানীদের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের অনেক ছবি তখন ঢাকায় অবস্থানরত কয়েক বিদেশী সাংবাদিকের মাধ্যমে বিশ্বের কিছু বড় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যদিকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে নরপশুদের পৈশাচিক হত্যাকা- চালানোর কোন প্রতিক্রিয়ার কথা পাকিস্তানীদের মধ্যে হয়েছে বলে শোনা যায়নি। সত্তরের মধ্যভাগ থেকে একাত্তরের ২৫ মার্চ পর্যন্ত আমি প্রয়াত আবিদুর রহমানের (আবিদ ভাই) সম্পাদনা এবং বার্তা সম্পাদক প্রয়াত আবদুস সোবহানের (সোবহান ভাই) সুযোগ্য তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ইংরেজী দৈনিক ‘দ্য পিপল’ পত্রিকার বার্তা বিভাগে শিফট ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলাম। তাই বঙ্গবন্ধুর দুর্বার নেতৃত্বে পরিচালিত এ দেশের জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম ও নরপিশাচ পাকিস্তানীদের হিংসাত্মক কর্মকা-ের খবরগুলো সব সময়ই জানতে পারতাম। চরম দুর্ভাগ্য, বাঙালী জাতির যে, বেগম খালেদার জিয়ার মতো একজন ব্যক্তি তিন তিনবার (একবার অবশ্য ভুয়া) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদটি অলঙ্কৃত করেছেন। পাকিস্তানের প্রতি তার নিখাদ গভীর প্রেমের কথা সর্বজনবিদিত। এ দেশে অবস্থানরত তৎকালীন সাামরিক অফিসারদের মধ্যে যারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন তারা সে সময় কোন না কোনভাবে তাদের প্রিয় সহধর্মিণীদের নিয়ে ওপারে (ভারত) গিয়েছিলেন। বেগম জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমানও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। বিএনপির নেতা-নেত্রীরা স্বীকার না করলেও জিয়াউর রহমান সাহেবের কর্মকা- সম্পর্কেও কম-বেশি এ দেশের মানুষ জানেন। ১৯৯২ সালে আমি চতুর্থবারের মতো ঐক্যবদ্ধ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের একটি অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করি। ১৯৯১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম ছিলেন প্রধান অতিথি। মঞ্চে আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম। উনি এক ফাঁকে আমাকে বললেন যে, ‘দুঃখের কথা বলব কি ভাই, খালেদা জিয়াকে ওপারে (ভারত) নিতে আমরা তিন তিনবার লোক পাঠিয়েছিলাম। প্রতিবারই তারা ব্যর্থ হয়েছে। আসলে পাকিস্তানীদের প্রেমে মশগুল খালেদা জিয়া তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আরাম-আয়েশে দিন যাপন করছিলেন। বিষয়টি নিয়ে আমি আগেও লিখেছি আবারও লিখতে হচ্ছে যে, খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় সকল কূটনৈতিক রীতিনীতি ও স্বীকৃত শিষ্টাচার ভঙ্গ করে পাকিস্তানী (আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত জেনারেল) জেনারেল জানজুয়ার মৃত্যুর পর শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন। বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল বলে পত্রপত্রিকায় এসেছিল। তাই বেগম জিয়ার পাকিস্তান প্রেম যে কতটা গভীর তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে জানজুয়া ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে কথা বলতে গিয়ে সংসদ নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া যেভাবে একাত্তরে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিদেশী প্রভুদের (পাকিস্তান) সুযোগ করে দিয়েছিলেন, তারই প্রতিফলন হচ্ছে মিথ্যাচার করে বই ছাপিয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর দুঃসাহস দেখাচ্ছে পাকিস্তান।’ সংসদ অধিবেশনের শুরুতেই পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে বিষয়টির অবতারণা করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর মদদে পাকিস্তানের জুনায়েদ আহমেদের লেখা ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোডেড’ বইটিতে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক এ দেশের গণহত্যাকে মুক্তিবাহিনীর হত্যাকা- বলে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বইটি সংসদে দেখিয়ে তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে এর প্রতিবাদ জানান। তিনি ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা প্রদানেরও দাবি জানান। এ সময় সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরাও নিজ নিজ আসনে দাঁড়িয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানান। তোফায়েল আহমেদের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘দীর্ঘ ২৪ বছর লড়াই-সংগ্রাম ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করছি। কারোর হুইসেলে আমাদের স্বাধীনতা আসেনি। একাত্তরে জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে, তা সবারই জানা। বাংলাদেশজুড়ে হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা শুধু দেশেই নয়, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বহু দেশেই তার তথ্য রয়েছে। এখন পাকিস্তান তাদের সেই কৃতকর্ম উল্টো মুক্তিবাহিনীর ওপর চাপিয়ে দিয়ে নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের জন্য এটি লজ্জার বিষয়। এমন বই লেখা এবং তা বাংলাদেশে পাঠানোর সাহস তারা (পাকিস্তান) কোথা থেকে পেল!’ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী যার স্বামী অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন সেই নেত্রী খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়নি! যে কথাটি দেশের প্রত্যেকটি মানুষ জানে ও স্বীকার করেন। আর সেখানে সেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া গণহত্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।’ সংসদ নেত্রী বলেন, শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেই বিদেশী প্রভুদের সুযোগ করে দেয়া- এটাই বোধ হয় তার (খালেদা জিয়া) ইচ্ছা ছিল। তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি- পাকিস্তান বইটি ছাপিয়ে সেটা আবার বাংলাদেশে পাঠায়। এত বড় দুঃসাহস তারা কোথা থেকে পেল সেটাই আমাদের প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বলেছেন, ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। সেজন্য যথাযথভাবে সংসদে একটি প্রস্তাব আনার কথাও বলেছেন। সেইসঙ্গে আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখা না রাখা নিয়েও গভীরভাবে ভাববার জন্য আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ থাকল। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×