ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকার ওপর চাপ কমানোর পরামর্শ ডিসিসিআইয়ের

যানজটে বছরে ২০ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

যানজটে বছরে ২০ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ ঢাকা শহরের যানজটের কারণে প্রতিবছর ২০ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে হলে ঢাকার ওপর চাপ কমানোর পরামর্শ দিয়েছে দেশের অন্যতম বাণিজ্যিক সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। সংগঠনটির মতে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশ ঢাকায় বসবাস করছেন। প্রতিবছর গ্রাম থেকে ঢাকামুখী হচ্ছেন নতুন মানুষ। তাই ঢাকা শহরের ওপর থেকে এই চাপ কমাতে হলে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং সামাজিক সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেয়া প্রয়োজন। বৃহস্পতিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এবং পাওয়ার এ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) যৌথভাবে ‘ঢাকা’র অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক স্টেকহোল্ডার ডায়ালগের আয়োজন করে। পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান ডায়ালগটি সঞ্চালনা করেন এবং বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা ডায়ালগে ঢাকার অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। উদ্বোধনী বক্তৃতায় ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আবুল কাসেম খান জানান, ঢাকা শহরে যানজটের কারণে প্রতিবছর আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। এর পরিমাণ প্রায় ২০-৩০ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম ইকোনমিক করিডরকে ঢাকার বিকেন্দ্রীকরণের একটি অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। সময় এসেছে ঢাকা শহরের পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক সেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তার প্রতি মনোযোগী হওয়ার। এজন্য প্রয়োজন গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন বিশেষ করে সারাদেশে কার্যকর রেল সংযোগ স্থাপন ও রেলের আধুনিকায়ন। ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ঢাকার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করা প্রয়োজন, যা নীতিনির্ধারণী মহলকে তাদের পরিকল্পনা প্রণয়নে সহযোগিতা করবে। তিনি বলেন, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে সমভাবে ঢাকা এবং মফস্বল অঞ্চলের উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির বিকাশে তৈরি পোশাক খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তবে সময়ে এসেছে অন্যান্য সামাজিক সেবা খাতসমূহ বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আবাসন এবং পর্যটন প্রভৃতির ওপর গুরুত্বারোপের। তিনি বলেন, এসএমই খাতের বিকাশে সহায়ক নীতিমালা প্রণয়ন করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ২০১৬ সালে পিপিআরসি পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের বসবাসকারী প্রতিটি পরিবারের মাসিক গড় আয় ৩৮ হাজার টাকা। তিনি সরকারের উন্নয়নমুখী সুশাসনে নীতিমালা প্রণয়নের আহ্বান জানান। তিনি ঢাকার সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়নে রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, ব্যবসায়ী সম্প্রদায়, স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট অন্য স্টেকহোল্ডাদের নিয়মিত সমন্বয় সভা আয়োজনের প্রস্তাব করেন। বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্টিন রামা তার উপস্থাপিত তথ্যচিত্রে বলেন, বিশ্বের দ্রুত বিকাশমান শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। তিনি বলেন, সরকারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং অনেক সংস্থার অংশীদারিত্বের কারণে এ শহরের অবকাঠামো ও সেবা খাতের উন্নয়ন বিঘিœত হচ্ছে। তিনি জানান, ঢাকা শহরের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা প্রচুর তবে তা অর্জনে সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন খুবই জরুরী। মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকাস্থ জাপানীদের শিল্প ও বাণিজ্য এ্যাসোসিয়েশনের (সো কো কাই) উপদেষ্টা আব্দুল হক বলেন, সেবা প্রদানকারী সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের গাফিলতির কারণে উন্নয়ন কর্মকা- সময়মতো সম্ভব হচ্ছে না, পাশাপাশি পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান বাড়াতে হবে। ঢাকা শহরের যানজট নিরসন করতে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এছাড়া ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থায় যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে তা মানসম্মত কিনা সে বিষয়েও সিটি কর্পোরেশনের নজরদারি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, নানা ধরনের প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জ থাকার পরও বিদেশীরা এখানে আসতে চায়। বিশেষ করে জাপানের প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনা জরুরী হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, হলি আর্টিজান ঘটনার পর তারা চলে গেলেও সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে আবার জাপানীরা বাংলাদেশে কাজ শুরু করেছেন। এখন তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকা চেম্বারের সদস্য এম এস সিদ্দিকী বলেন, ঢাকা শহর হতে সরকারের মোট রাজস্বের ৩৩ শতাংশ সংগৃহীত হলেও এখানকার অবকাঠামো ও সামাজিক সেবাসমূহের মান কাক্সিক্ষত পর্যায়ের নয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রকৌশলী নূর উল্ল্যাহ জানান, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রাজউক, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার মতো স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সমন্বয় একান্ত অপরিহার্য। ঢাকা চেম্বারের সদস্য নিয়ামত উল্ল্যাহ মজুমদার বলেন, সরকার রাজস্ব ও ভ্যাট আহরণের ক্ষেত্রে মনোযোগী হলেও ব্যবসায়িক কর্মকা- চালু রাখার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন ও সেবা প্রদানের বিষয়ে খুবই উদাসীন। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম ঢাকার অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিষয়ে একটি সমন্বিত গবেষণা পরিচালনার প্রস্তাব করেন। তিনি আরও বলেন, সরকার কর্তৃক বিশেষায়িত শিল্প এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি ঐ অঞ্চলে বসবাস, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও যোগাযোগ খাতের উন্নয়ন খুবই আবশ্যক। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. জাফরউল্ল্যাহ চৌধুরী সরকারী নীতিমালায় অসঙ্গতি দূরীকরণ এবং একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে সরকারের নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানান। নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন দেশের সম্ভাবনাময় তরুণ জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক কর্মকা-ে আরও বেশি হারে সম্পৃক্ত করার ওপর জোরারোপ করেন।
×