ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ বাঙালীর শোকের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি। একইসঙ্গে গৌরবের। এবারও যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালিত হয়েছে। সারা দেশের মতো বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকায় ছিল নানা আনুষ্ঠানিকতা। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ঢল নেমেছিল মানুষের। প্রভাব পড়েছিল অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। হ্যাঁ, এখনও সেই রেশ। বৃহস্পতিবার ২৩তম দিনে দৃশ্যমান হয়েছে ভাষার প্রতি প্রেম আর বইয়ের জন্য ভালবাসা। শেষ পর্যায়ে মেলা। তাই বই সংগ্রহে দারুণ ব্যস্ত পাঠক। নির্বাচিত বই ॥ মেলায় আসা সিরিজ গ্রন্থগুলোর খুব উল্লেখযোগ্য একটি ‘বাউল-ফকির পদাবলি।’ এতে ভাটি বাংলার ১২ বাউল-ফকিরের পদাবলী সংযুক্ত করা হয়েছে। প্রত্যেকের ১০০ করে মোট ১২০০ সৃষ্টি। পৃথক ১২ খ-ে প্রকাশ করেছে অন্বেষা। সংগ্রহ সম্পাদনার কাজ করেছেন প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ গবেষক সুমনকুমার দাশ। লোকবিদের উর্বর ভূমি সিলেটে থেকে কাজ করেন তিনি। সেই ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হলো বাউল-ফকির পদাবলী। গ্রন্থমালার বিভিন্ন খ-ে অন্তর্ভুক্ত সাধকরা হচ্ছেন লালন, পাগলা কানাই, মেছের শাহ, দুদ্দু শাহ, শেখ ভানু, পাঞ্জু শাহ, হাসন রাজা, দীনহীন, মনোমোহন দত্ত, উকিল মুনশি, জালাল উদ্দীন খাঁ ও দীন শরৎ। গানের পাশাপাশি বইতে তাদের গানের বিশ্লেষণ ও সংক্ষিপ্ত জীবনী সংকলিত হয়েছে। অনন্যা থেকে মেলায় এসেছে ইমদাদুল হক মিলনের উপন্যাস ‘নয়মাস।’ এই লেখকের অনেক বই। নানা বিষয়ে লিখছেন। তবে এটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক রচনা। বর্তমানে দাঁড়িয়ে একাত্তরকে দেখানোর প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়। বর্ণনা শুনে মূল চরিত্র পাকিস্তানী কিশোরী বাংলাদেশের মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। মুক্তিযুদ্ধের নতুন এই উপস্থাপনা উপন্যাসটিকে আলাদা করেছে বৈকি। জার্নিম্যান বুকস্ থেকে মেলায় এসেছে ‘সাত দেশের কবিতা।’ চীন, জর্জিয়া, ভিয়েতনাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সার্বিয়া এবং সুইডেনের উল্লেখযোগ্য কবিদের কবিতা থেকে অনুবাদ করেছেন কবি মুহাম্মদ সামাদ। সাবলীল অনুবাদ। মূল কবিতার মতোই আচ্ছন্ন করে রাখে। প্রবন্ধ সংকলন ‘বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা’ প্রকাশ করেছে অনুপম। লেখক সুভাষ সিংহ রায়। রাজনীতির মানুষ। তবে প্রচলিত চর্চার বাইরে গিয়ে নিজের চিন্তা নির্মাণ করেন। যথেষ্ট গবেষণাধর্মী। বিশ্লেষণপ্রিয়। তাই তিনটি মাত্র প্রবন্ধের বই স্বতন্ত্র আবেদন নিয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয়। অনিকেত রাজেশের কাব্যগ্রন্থ ‘বৃষ্টি হচ্ছে কোথাও।’ এসেছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দেশ থেকে। তরুণ কবি তার কাব্যপ্রতিভা দিয়ে সমীহ আদায় করে নিয়েছেন পাঠকের। নতুন কবিতাগুলোও সুখপাঠ্য। জান্নাতুন নাঈম প্রীতির উপন্যাস ‘প্রেমিক’ প্রকাশ করেছে শব্দশৈলী। ভিন্ন ধারার লেখালেখির কারণে অনলাইনে বিশেষ পরিচিতি অর্জন করেছেন প্রীতি। নারীর অধিকারের পক্ষে তার স্পষ্ট ও প্রতিবাদী উচ্চারণ। নতুন উপন্যাসে এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি। নতুন বই ॥ এদিন নতুন বই এসেছে ৭২টি। বইগুলোর মধ্যে গল্প ১০, উপন্যাস ৬, প্রবন্ধ ২, কবিতা ২২, গবেষণা ২, ছড়া ২, শিশুসাহিত্য ৩, জীবনী ২, রচনাবলী ২, মুক্তিযুদ্ধ ৩, ভ্রমণ ২, ইতিহাস ১, রম্য/ধাঁধা ১, ধর্মীয় ১, অনুবাদ ১ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর আরও ১২টি নতুন বই রয়েছে। মোড়ক উন্মোচন ॥ মেলার মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে ৩১টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ॥ বৃহস্পতিবার বিভিন্ন অঙ্গনের গুণীজনের নামে পুরস্কার ঘোষণা করেছে মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। ২০১৬ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকস্কে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০১৭, ২০১৬ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে গুণমান ও শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য রফিকুন নবীর ‘দেশসেরা জগৎসেরা শিল্পীকথা’ গ্রন্থের জন্য প্রথমা প্রকাশন, পাভেল রহমানের ‘সাংবাদিকতা আমার ক্যামেরায়’ গ্রন্থের জন্য মাওলা ব্রাদার্স, রণজিৎ কুমার ম-লের ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়’ গ্রন্থের জন্য পুথিনিলয়কে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০১৭, ২০১৬ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য চন্দ্রাবতী একাডেমিকে রোকনুুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০১৭ এবং ২০১৭ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাতিঘর, সংবেদ ও পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেডকে শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০১৭ প্রদান করা হয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি মেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে এসব পুরস্কার পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে তুলে দেয়া হবে। মূল মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘অনুবাদ সাহিত্য : সাহিত্যের অনুবাদ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন কবি ড. মুহাম্মদ সামাদ, কবি শামীম আজাদ এবং সাদাফ্ সায। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস। প্রাবন্ধিক বলেন, আমাদের দেশে এখন অনুবাদকর্মে অনেকেই উদ্যোগী হয়েছেন; তার অর্থ এই নয় যে প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট অনুবাদকর্ম হচ্ছে। এর প্রধান কারণ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অভাব এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা। যা কিছু হচ্ছে তার সিংহভাগই ব্যক্তিক উদ্যোগে। এই ব্যক্তিক অনুবাদ-উদ্যোগগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক আওতায় আনা জরুরী। এছাড়া সরকারী উদ্যোগে অনুবাদ কেন্দ্র সৃষ্টি করা এবং নিযুক্তিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সাহিত্য ও গবেষণাকর্মের অনুবাদ সম্পন্ন করাও এখন অত্যন্ত জরুরী। আলোচকবৃন্দ বলেন, বাংলাদেশের সাহিত্যের আন্তর্জাতিক প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে অনুবাদের কোন বিকল্প নেই। যথার্থ অনুবাদের মাধ্যমেই আমাদের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও চিন্তাভা-ার বিশ্বদরবারে পৌঁছতে পারে। তবে অনুবাদকর্মের ক্ষেত্রে আক্ষরিক অনুসরণের পরিবর্তে ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক জ্ঞানের সংযোগ অনুবাদকের জন্য অপরিহার্য বিষয়। এ বিষয়ে আমাদের নবীন অনুবাদকদের আরও সচেতন ও উদ্যোগী হতে হবে। সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বলেন, সাহিত্যের অনুবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সঙ্গে জটিল প্রপঞ্চ। সাহিত্যমান অক্ষুণœ রেখে বিষয়ানুগ থাকা অনুবাদকের পক্ষে সহজ কাজ নয়। এ বিষয়ে যেমন ভাষাজ্ঞানের যথার্থতা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন জ্ঞানকা-ের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে ছিল স্পর্শ এবং সুর সংগীত চক্র।। সংগীত পরিবেশন করেন আবদুল আউয়াল, শারমিন সুলতানা, সুমন চন্দ্র দাস, মির্জা শামসুল আলম, সুধীর ম-ল, জাকির হোসেন, জামাল দেওয়ান, বিমল বাউল এবং দেলোয়ার হোসেন বয়াতী।
×