ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

লে. কর্নেল মহিউদ্দিন সেরনিয়াবাত (অব)

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ ॥ অভিন্ন হৃদয়

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ ॥ অভিন্ন হৃদয়

(বৃহস্পতিবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যার পর) ২৫ মার্চ দুুপুরের পর থেকেই বিভিন্ন স্তরের মানুষ ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাইরে উপস্থিত হয়ে ক্ষোভ প্রকাশ ও স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দিচ্ছিল। বাড়ির ভেতরে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা এমনকি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সংসদে যোগ দিতে আসা বেশ ক’জন শীর্ষ নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও তার প্রতি সমর্থন জানান। বঙ্গবন্ধুর কাছে আরও খবর আসে যে সামান্য কিছু পাহারায় রেখে অধিকাংশ ইউনিটে সৈনিকদের দুপুর থেকে বাধ্যতামূলক বিশ্রামে পাঠানো হয়েছে। এরূপ বিভ্রান্তি ও আতঙ্কজনক খবরে ড্রইং রুমে পাঁয়চারিরত বঙ্গবন্ধু নিকটজনের কাছে অস্বস্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। যে সকল বেতার প্রকৌশলীদের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বিকেলে তাদের ডেকে পাঠানো হয়। তারা প্রস্তুত এমন তথ্যে বঙ্গবন্ধু সন্তোষ প্রকাশ ও তাদের ধন্যবাদ জানান। প্রকৌশলীদের সঙ্গে নিয়ে আসা একটি টেপ রেকর্ডার নিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর শোবার ঘরে যান। সেখানেই খুব সতর্কতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে ধারণ করা হয়- সংক্ষিপ্তাকারের স্বাধীনতার ঘোষণা। জীবনের বিভিন্ন সময়ে জেল খেটে অভ্যস্থ, রাষ্ট্রদ্রোহ আগরতলা মামলার অভিজ্ঞ আসামি শেখ মুজিবুর রহমান আজ খুব বেশি সতর্ক। তার চেয়েও বেশি সাবধান। তাই ঐ প্রকৌশলীদের তার এই বার্তা বহন, সংরক্ষণ, প্রচারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশ দেন। আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে এই বার্তাটি প্রকাশ পেলে পরিণতি হবে ভয়াবহ জেনেই তিনি সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করেন। সন্ধ্যার আধার প্রকৃতিকে গ্রাস করার কিছু পরই বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন যে প্রেসিডেন্ট গোপনে ঢাকা ছেড়েছেন। এমন সংবাদে তিনি নিশ্চিত হন যে তার অনুমান সত্য হলো। আলোচনার নামে এতদিন ইয়াহিয়া-ভুট্টো সময়ক্ষেপণ ও রাজনৈতিক ভাঁওতাবাজি চালিয়েছে। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতির আহ্বান জানিয়ে তিনি ৩২ নম্বর ধানম-িতে উপস্থিত শীর্ষ নেতৃবৃন্দ ব্যতীত আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের অন্য নেতাদের গুপ্তাশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বিদায় করেন। এরপরই তড়িঘড়ি করে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কতখানি সত্য তা প্রমাণিত হয়নি এবং বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় কখনও তা প্রকাশ করেননি। কিন্তু ২৫ মার্চ রাতে সর্বশেষ ঐ বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার সহকর্মীদের খুব দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া, আক্রান্ত হলে তাদেরকে সীমান্ত অতিক্রম এবং ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার বিস্তারিত দিক-নির্দেশনা দেন। উপস্থিত নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকেও তাদের সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য অনেক অনুনয় বিনয় করেন। কিন্তু নানা অজুহাত দেখিয়ে তিনি ৩২ নম্বরেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। সহকর্মীরা উপস্থিত থাকাকালে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লরি বোঝাই সেনাবাহিনীর মুভমেন্টের এবং রাত বাড়তে থাকলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আক্রমণের খবর আসতে থাকে। তার বুঝতে আর বাকি নেই যে এবারও পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা ছাড়ল না। কিন্তু এবার আর ১৯৫৪ সাল নয়। দীর্ঘ ২৪ বছরে তিনি বাঙালীদের রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট পরিপক্ব ও শিক্ষিত করে তুলেছেন। তারা এখন তার নেত্বত্বে ঐক্যবদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত। এমন পরিস্থিতিতে শেখ সাহেব শুধু উত্তেজিতই নয়, রীতিমতো বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। কোন মতেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের সঙ্গে আর একত্রে এবং এক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভেতর থাকতে তিনি রাজি নন। পিঠ এখন দেয়ালে ঠেকে গেছে। আর কোন মতেই পেছনে যাওয়ার পথ নেই। সেদিন কিন্তু এখনকার মতো টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা এত সহজ ছিল না। সম্ভবত তার পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি সেই সময়ে তার বাসায় অবস্থানরত ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিয়োজিত কাউকে পিলখানায় কর্তব্যরত বাঙালী ওয়্যারল্যাস অপারেটরকে লাইন মেলাতে নির্দেশ দেন। তার নির্দেশ মতো পিলখানায় যোগাযোগ করা হয়। উত্তেজিত বঙ্গবন্ধু উচ্চকণ্ঠে উক্ত অপারেটরকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সামরিক-বেসামরিক বাঙালীদের ওপর পাক বাহিনীর আক্রমণ এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করছেন এই মর্মে সংবাদ চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দসহ সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান। সেই আহ্বানে তিনি বাঙালী সেনা, ইপিআর, পুলিশ বাহিনীকেও জনগণের পাশে দাঁড়ানোর কথাটি উল্লেখ করেন। পিলখানা ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালী সদস্যরা তখন উদ্বিগ্ন, উত্তেজিত। অবাঙালী ইপিআরদের তৎপরতায় চারদিকে তখন ছিল টান টান উত্তেজনা। তারপরও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাঙালী ঐ সকল বীর অপারেটরগণ বিলম্ব না করে তার স্বাধীনতার বার্তা চট্টগ্রামে জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকীসহ সকল ইপিআর ছাউনীতে পৌঁছে দেন। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর তৎপরতা নিশ্চিত হয়ে বাঙালী প্রকৌশলীরাও রাত ১২টার পূর্বে ঢাকার বলধা গার্ডেনের পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষা করে তারা সেখানে সহজে বহনযোগ্য, হালকা একটি ট্রান্সমিটার নিয়ে প্রস্তুত হয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। তখন সময় ছিল ২৫ মার্চ রাত ১২টার কিছু বেশি। এমনি সময়ে সেনাবাহিনীর ট্যাংক ও বিশাল আকৃতির লরিগুলি চিৎকার ও গুলি ছুড়তে ছুড়তে ঢাকা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে ট্যাংক লরিগুলির শব্দে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি তখন। প্রকৌশলীগণের বুক ভয় ও উত্তেজনায় কাঁপছে। তারা বুঝতে পারেন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের এখনই চূড়ান্ত সময়। অবশেষ সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তারা রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা ফ্রিকোয়েন্সির পাশে সেট করত টেপ রেকর্ডারে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ধারণকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাটি কয়েকবার প্রচার করার পর দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। এদিকে সাধারণ মানুষ পাকবাহিনীর আশু বর্বরতার মাত্রা সম্পর্কে কোন ধারণাই করতে পারেনি। তারা পথে পথে গর্ত খুড়ে, রাস্তা কেটে, গাছের গুঁড়ি ফেলে, টায়ারে আগুন জ¦ালিয়ে পাক বাহিনীকে প্রতিরোধের বিফল চেষ্টা করে। তাদের অনুমান ছিল এই প্রতিরোধে হয়তো সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে। কিন্তু পাক বাহিনীর অগ্রাভিযানের গতি এই প্রতিরোধের কারণে কিছুটা বিলম্বিত হলেও বাঙালীদের অনুমান ও মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যেখানে সামান্য প্রতিরোধ সেখানে ও তার আশপাশে ভয়াবহ হত্যাকা- ঘটিয়ে লাশের ওপর দিয়ে তারা উম্মাদের মতো এগিয়ে যাচ্ছিল। ঢাকায় তাদের আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল- রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার ইপিআর সদর দফতর অর্থাৎ বাঙালীদের দ্বারা সম্ভাব্য সশস্ত্র প্রতিরোধের স্থান। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় তথা আন্দোলন- সংগ্রামের সূতিকাগার এবং সর্বোপরি এই আন্দোলন সংগ্রামের সদর দফতর অর্থাৎ মূলমন্ত্রণা দাতা ও জাতির রাজনৈতিক গুরু শেখ মুজিবর রহমানের ৩২ নং ধানম-ির বাসভবন। রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ইপিআর সদর দফতরে ঐ রাতে যারা ডিউটিরত ছিল, প্রাথমিক হামলা বীরত্বের সঙ্গে প্রতিহত করলেও সেনাবাহিনীর জনবল ও অস্ত্র বলের কাছে তারা পরাস্ত হতে বাধ্য হয়। যারা ঘুমিয়ে ছিল তাদের প্রায় সকলে এবং প্রতিরোধকারীদের অধিকাংশ শাহাদাৎ বরণ করেন। কয়েকজন আহত অবস্থায় স্থান ত্যাগ করতে সক্ষম হন। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষক ও কর্মচারীদের বাসা বাড়িতে ঢুকে তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। ঢাকা শহরে ঐ রাতেই তাদের এই হত্যাকা-ের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও হিটলার-মুসোলিনি সেদিন ঠিকই হার মেনেছিল পাক সেনাবাহিনীর এই বর্বরতার কাছে। ঢাকার অলিতে-গলিতে, রাস্তা-ঘাটে হাজার হাজার মানুষের লাশ দেখে ভীতসন্ত্র¿স্ত কুকুর ও কাকের চিৎকারে চারিদিকে সৃষ্টি হয়েছিল এক বিভীষিকাময় পরিবেশÑ এ যেন কেয়ামতের রিহার্সেল। এ চিত্র শুধু ঢাকা নয়, যশোর, কুমিল্লা, জয়দেবপুর, রংপুর, সৈয়দপুর, কুষ্টিয়া ও চট্টগ্রামের। অর্থাৎ ঐ সকল স্থানে বাঙালী সেনা, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনী যেহেতু পাকবাহিনীর নৃশংস হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এমন সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় রেখে পাকবাহিনী ঢাকার বাইরেও নিষ্ক্রিয় করার লক্ষ্যে প্রথমেই তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালী বীরযোদ্ধারা এদের হামলা প্রতিহত করলেও খুব বেশি সময় টিকে থাকতে পারেনি। অনেকে প্রাণ হারায়, বাকিরা অস্ত্র নিয়ে স্থান ত্যাগ করে। তাদের এই প্রতিরোধ যুদ্ধের খবর পেয়ে ঐ রাতেই পাশ্ববর্তী গ্রাম থেকে সাধারণ জনগণ যার যা কিছু আছে যেমন- ঢাল, সুড়কি, বল্লম, খন্তা, কোদাল নিয়ে ছুটে আসে। কিন্তু তাদেরও অনেকে শত্রুবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের কাছে প্রাণ হারায়। রাত প্রায় একটার দিকে কমান্ডো বাহিনীর মেজর বিল্লালের নেতৃত্বে একদল কমান্ডো গুলি ছুড়তে ছুড়তে ৩২ নম্বর ধানম-ির বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তাদের প্রধান শত্রু বঙ্গবন্ধুকে আটক করে। এর পরই মেজর বিল্লাল তার ওয়্যারলেস সেট-এর মাধ্যমে জানিয়ে দেয় ‘বিগ বার্ড ইন দ্য কেইজ’। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাস ও পরে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। পাক বাহিনীর এই তৎপরতার বিপরীতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ চট্টগ্রামে পৌঁছলে গভীর রাতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর বাসায় দলীয় নেতা-কর্মীরা ভিড় জমান। দলীয় নেতাদের নির্দেশে উপস্থিত আওয়ামী লীগের কর্মীদের একটি বড় অংশ এই সংবাদ প্রচারের জন্য বেরিয়ে পড়েন। তারা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদ ঐ রাতেই ট্যাক্সি, রিক্সা নিয়ে মাইকে পাড়ায় পাড়ায় প্রচার করতে থাকে। নগর সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নানসহ কয়েকজন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। সেখানে পৌঁছে তারা অতিরিক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিকটস্থ বাসাবাড়ি থেকে ডেকে আনেন। সম্পূর্ণ বিষয়টি দ্রুত এগিয়ে চলছিল। সূর্যোদয়ের পূর্বেই চট্টগ্রাম বেতারকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নাম দিয়ে আব্দুল হান্নান সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি জাতির উদ্দেশে প্রচার করেন। এরপর ২৭ মার্চ দুপুর পর্যন্ত কিছুটা বিশৃঙ্খলভাবে অন্তত ৭/৮ জন বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তখন খুব কম লোকের কাছেই রেডিও ছিল। রাতের ঐ সময়ে কোন অধিবেশনও চলছিল না। চট্টগ্রাম বেতারের ধারণ ক্ষমতাও ছিল খুবই সীমিত। ফলে ঐ গভীর রাতে কম লোকই এই নবজন্ম লাভকারী বেতারের প্রচার শুনতে পেয়েছিল। তবে ২৬ মার্চ তারিখ লোক মুখে ছড়াতে ছড়াতে অনেকেই জেনে ফেলে এবং তারাও এই নতুন বেতার কেন্দ্রে কান পেতে স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদ জেনে ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। একইভাবে বলধা গার্ডেনে স্থাপিত যন্ত্র থেকে বঙ্গবন্ধুর কন্ঠে ঘোষণা দেশি বিদেশী কিছু সাংবাদিক এবং নিজেদের এইচএফ ওয়্যারলেস সেটÑ এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোকজন শুনতে পেয়েছিল। ২৬ মার্চ দুপুর বেলা ১ টায় পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণে পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানান। এরপরই তিনি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ স্বরে এবং স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই এই ব্যক্তি (শেখ মুজিব) ক্রমাগত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে। সে ও তার দল পাকিস্তানের শত্রু। অনেক আগেই তাকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত ছিল যা করা হয়নি এবং সে দায় কিছুটা হলেও তার (ইয়াহিয়া) নিজের। তবে, জাতিকে তিনি এই মর্মে আশ^স্ত করেন যে, এবার এই ব্যক্তিকে বিনা শাস্তিতে যেতে দেয়া হবে না। ঐ বক্তৃতায় ইয়াহিয়া খান দেশে সকল রাজনৈতিক কর্মকা- স্থগিত এবং আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। দেশী-বিদেশী সকল সাংবাদিকদের বরাত দিয়ে ২৬ মার্চ বিকেলে ও ২৭ মার্চ তারিখে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ওয়াশিংটন পোস্ট, বাল্টিমোর সান, লন্ডন টাইম্স, আনন্দবাজার পত্রিকাসহ বিশে^র বিভিন্ন প্রেস এবং আকাশবাণী, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, জাপান রেডিওসহ বিশে^র বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার সংবাদ প্রচারিত হয়। বিশে^র বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত ঐ সকল সংবাদ বাংলায় অনুবাদ করলে মোটামুটি যা হয় তা হলো- ‘পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তার পুর্বাঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করেছেন এবং ঢাকার রাস্তায় ট্যাংক যুদ্ধ শুরু হয়েছে। শেখ মুজিবকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেপ্তার করেছে। তবে তার ভাগ্যে কি ঘটেছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’ ২৭ মার্চ তৎকালীন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ একটা মাত্রা যোগ করে মাত্র। বাঙালীরা বুঝতে পারে যে, বাঙালী সশস্ত্র সেনা সদস্যরাও তাদের পাশে রয়েছে। চলবে...
×