ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বেসরকারী খাতের সেবার মান ও সরকারের আকার নিয়ে ভাবা দরকার

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বেসরকারী খাতের সেবার মান ও সরকারের আকার নিয়ে ভাবা দরকার

কত ‘পদের’ সংগঠন যে দেশে আছে, আর এদের আয়োজিত সভা, আলোচনা যে প্রতিদিন কত তার হিসাব রাখা সত্যি মুশকিল। এর কলাম লিখতে গেলে হিসাব রাখতেই হয়। আর তা যদি হয় অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর তাহলে তো কথাই নেই। এই যেমন গত সপ্তাহে একটি আলোচনা সভায় অনেক রথী-মহারথী উপস্থিত ছিলেন। অর্থনীতি-ব্যবসা-বাণিজ্য-ব্যাংকিংয়ের ওপর তারা অনেক কথা বলেছেন। একজন সাবেক গবর্নর বলেছেন, দেশে ব্যাংকের সংখ্যা ব্যাঙের ছাতার মতো বাড়ছে অথচ সেবার মানে কোন উন্নতি নেই। যেখানকার সেবা সেখানেই। কথাটা কী মিথ্যা? না, মিথ্যা বলা যাবে না। যতই ব্যাংকের সেবা বাড়ছে ততই অবনতি ঘটছে ব্যাংকের সেবার, ততই খেলাপী ঋণও বাড়ছে। অথচ এটা কথা ছিল না। ১৯৮২-৮৩ সাল পর্যন্ত দেশে বেসরকারী খাতে কোন ব্যাংক ছিল না, ছিল একটি মাত্র ফিন্যান্স কোম্পানি যা এখন একটি প্রথম জন্মের বেসরকারী ব্যাংক। তখন সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ বেসরকারী খাতে ব্যাংক-বীমার অনুমতি দেন। সরকারী খাতের দুটো ব্যাংক ছেড়ে দেয়া হয় বেসরকারী খাতে। দেশে শুরু হয় নতুন উত্তেজনা। সরকারী ব্যাংক থাকার ফলে ব্যাংকিংয়ের কোন প্রতিযোগিতা নেই। অতএব সরকারী ব্যাংকগুলো অদক্ষতার ‘ডিপো’। তাদের ‘পণ্য’ বস্তুত সেকেলে পণ্য। এসব দিয়ে দেশের সেবা করা যায় না। সরকারী ব্যাংকে সেবার মান যাচ্ছেতাই। এক ঘণ্টা লাগে টাকা জমা দিতে, টাকা তুলতে। এমতাবস্থায় একমাত্র ওষুধ সকল ব্যাংক বিক্রি করে দেয়া এবং বেসরকারী খাতে ব্যাংকের অনুমতি দেয়া। এতে সেবার মানে শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হবে। দেশবাসী সেবায় সেবায় সয়লাব হতে পারবে। এই সেøাগান তুলে বেসরকারী খাতে দফায় দফায় অনেক ব্যাংক দেয়া হয়েছে। এখন সব ব্যাংক মিলিয়ে গোটা ষাটেক ব্যাংক আছে। আরও বেশ কয়েকটা পাইপ লাইনে আছে বলে জানা গেছে। শোনা যাচ্ছে এদের অনুমোদনও শীঘ্রই দেয়া হবে। শিক্ষা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ, নার্সিং কলেজ, ডেন্টাল কলেজ ইত্যাদির একই অবস্থা। শত শত হয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। অথচ সর্বত্র এখন প্রশ্ন উঠছে মান নিয়ে। শুধু বেসরকারী ব্যাংকের ‘অনাচার’ নয়, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অত্যাচারে মধ্যবিত্ত অতিষ্ঠ। তাদের শিক্ষক নেই, নিজস্ব জায়গা নেই, পড়াশোনা নেই, গ্রন্থাগার নেই, কমিটি নেইÑ নেই কিছুই, অথচ তারা ডিগ্রী দিচ্ছে, এই ডিগ্রীতে চাকরি পাওয়া যায় না। সরকারী কলেজগুলোরও একই অবস্থা। বহুদিন পর চরম মূল্য পরিশোধের পর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকার ৭টি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছে, অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও খুব ভাল যে নয় তা আন্তর্জাতিক কাগজপত্র ঘাঁটলেই পাওয়া যায়। এদিকে কয়েকদিন আগে প্রকাশিত একটি খবরে দেখা যাচ্ছে, দেশের সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকের বিরুদ্ধে সমান সমান অভিযোগ। অভিযোগের শীর্ষে থাকা ১০টি ব্যাংকের মধ্যে পাঁচটি সরকারী, পাঁচটি বেসরকারী। যে পাঁচটি বেসরকারী ব্যাংকের নাম দেখলাম তাদের কথা জনগণের মুখে মুখে। ‘মিডিয়ায়’ তাদের কত প্রশংসা শুনি। এখন দেখা যাচ্ছে কাজের বেলায় তারা ঠন ঠন। মানুষ যাবে কোথায়? শেয়ার বাজারে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী বসে আছে কুমতলব নিয়ে, কীভাবে মানুষের টাকা মারা যায়। সরকারী ব্যাংক চলে না, তাদের সেবার মান ভাল নয়- এ কথা বলে বেসরকারী ব্যাংক দেয়া হলো, এখন দেখা যাচ্ছে সেগুলোর অবস্থাও ভাল নয়। নতুন যে কয়েকটি ব্যাংক দেয়া হয়েছে তাদের অবস্থা যে শোচনীয় তার কথাও প্রতিদিন কাগজে ছাপা হচ্ছে। অথচ আশা ছিল এসব ব্যাংক ভালভাবে চলবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ব্যাংকে ব্যাংকে শ্রেণী-বিন্যাসিত (ক্লাসিফায়েড লোন) ঋণ বাড়ছে বিপরীতে। প্রধান নির্বাহীদের বেতন-ভাতা বাড়ছে। মেধার খোঁজে, প্রতিযোগিতার কথা হলে, দক্ষতার কথা বলে সাধারণ কর্মচারীদের চাকরি যাচ্ছে, হরেদরে আউটসোর্সিং করা হচ্ছে। অথচ এসবের কথা ছিল না। কথা ছিল আরও একটি। বেসরকারীকরণ যখন পুরোদমে শুরু হয়, ব্যবসায়ীদের নাকেমুখে যখন প্রতিযোগিতার কথা, মেধার কথা, দক্ষতার কথা তখন এও বলা হয়েছিল সরকার কোন ব্যবসা করবে না। সরকার ধীরে ধীরে ছোট হবে। সরকারের মেদ কমবে। সরকার অবকাঠামো তৈরি করবে। প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করবে। মেধার বিকাশ ঘটানোর ব্যবস্থা করবে। গ্যাস, বিদ্যুত, রাস্তাঘাট তৈরি করবে সরকার। আর দেবে সুষ্ঠু প্রশাসন। জনমনে শান্তি দেবে। এমতাবস্থায় সরকারের আকার (সাইজ) ধীরে ধীরে কমবে। এমনকি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের মতো মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন থাকবে না। কারণ অবাধ বাণিজ্যের জমানা হবে। শিল্প করবে বেসরকারী খাত। সরকার করবে শুধু নীতিমালা, দেবে সাপোর্ট। এর জন্য এত বড় বড় মন্ত্রণালয়, মন্ত্রী, অফিসার, সচিব, যুগ্ম সচিব ইত্যাদি থাকার প্রয়োজন নেই। আর এসব হলে সরকারের খরচ কমবে। বেতন-ভাতার খরচ কমবে, অবসর ভাতার প্রয়োজন কমবে। নতুন নিয়োগের দরকার কম হবে। যুবক-যুবতীরা খুঁজবে ব্যবসার লাইন। তারা হবে উদ্যোক্তা। তারা হবে স্টার্টআপের মালিক। যুবক-যুবতীরা চাকরির জন্য মন্ত্রীদের পেছনে ঘুরবে না। অনিয়ম করে, ঘুষ-দুর্নীতি করে চাকরিতে ঢুকবে না, প্রশ্নপত্র ফাঁসের জন্য জীবন-মরণ চেষ্টা চালাবে না। সুন্দর একটা দেশ হবে যা প্রতিযোগিতায় পূর্ণ, মেধায় ভরপুর। উজ্জ্বল একটা বাংলাদেশ আমরা দেখবÑ যা সম্পূর্ণই নতুন দেশ। কিন্তু আমরা কী দেখতে পাচ্ছি বেসরকারী ও সরকারী খাতে। বেসরকারী খাত বড় হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ ব্যবসা-বাণিজ্যই বেসরকারী খাতে। ব্যাংক-বীমা ব্যবসা, আমদানি-রফতানি ব্যবসাসহ সব ব্যবসাই আজ বেসরকারী খাতে। সেখানে দক্ষতা, মেধা, প্রতিযোগিতার স্থান কোথায়? যেখানে গড়ে উঠেছে ‘ক্রোনি ক্যাপিটেলিজম’ যা পরনির্ভরশীল পুঁজিপতি। ‘রেন্ট সিকিং’ সর্বত্র। এটা তো বাজার অর্থনীতির বেসরকারী খাত নয়। দল বেঁধে সব বেসরকারী ব্যাংক আমানতকারীর আমানতের ওপর সুদের হার কমাবে, নিজেদের মধ্যে ‘মিটিং’ করেÑ এটা কোন্ বাজার অর্থনীতি। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বলে দিয়েছেÑ ‘নাথিং ডুয়িং’ আমানতের ওপর সুদ আর কমানো যাবে না। যদি এটাই কেন্দ্রীয় ব্যাংককে করতে হয় তাহলে বাজার অর্থনীতি কীভাবে হলো। দেখা যাচ্ছে সেবা দরকার নেই, সেবার মানের দরকার নেই, যথেচ্ছভাবে চলবে বেসরকারী খাত, তারা দেশে শিল্প করবে না, বিদেশে করবে। এটা কেমন কথা। রাজস্ব বোর্ডের একটি খবরে দেখলাম ‘বন্ড’ সুবিধাপ্রাপ্ত কোম্পানিগুলো নাকি বছরে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করে। তারা বিদেশ থেকে বিনা শুল্কে মাল আমদানি করে খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয়। এরা কারা? অধিকাংশই পোশাক ব্যবসায়ী নয় কি? যদি রাজস্ব বোর্ডের গবেষণা সত্য হয় তাহলে দক্ষতা কোথায়, প্রতিযোগিতা কোথায়, মেধা কোথায় যা বাজার অর্থনীতির ভিত্তি। এসব দেখেশুনে মনে হয় আমরা অনেক কিছুতেই বিভ্রান্ত হচ্ছি। এই যে কথা ছিল সরকারের আকার ছোট হবে তার কী হলো। আমরা কী দেখতে পাচ্ছি। আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারী খাত ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। শত শত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপ-সচিবের পদ। জায়গা নেই, বসার ঘর নেই তবু তাদের পদোন্নতি। অবসরে গেছেন তারা। তাদের জায়গায় জায়গায় সম্মান দিয়ে বসানো হচ্ছে। প্রতিবছর নিয়োগ পাচ্ছে শত শত কর্মচারী-কর্মকর্তা। এসবের তো কথা ছিল না। এটা অনলাইনের যুগ, কম্পিউটারের যুগ। ঢাকা থেকে হাঁক দিলে পঞ্চগড়ে বসে শোনা যায়। যে কোন সরকারী কর্মকর্তা ইচ্ছা করলে উপজেলা চেয়ারম্যানদের নাম পর্যন্ত মুখস্থ রাখতে পারে। মোবাইল হাতে হাতে যে কোন নির্দেশ দেয়া যায় মুহূর্তের মধ্যেই। যে কোন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় মুহূর্তের মধ্যেই। রাস্তাঘাট উন্নত। ঢাকা থেকে ৫-৬ ঘণ্টা বড়জোর ৬-৭ ঘণ্টায় বাংলাদেশের যে কোন প্রান্তে পৌঁছা যায়। বাস সার্ভিস খুবই উন্নত। এই সরকারের আমলে রেলপথের ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে। চট্টগ্রাম যাওয়া যায় ৪ ঘণ্টায়। এমতাবস্থায় প্রশাসনিক স্তর বাড়ানোর কারণ কী হতে পারে? একের পর এক বিভাগ হচ্ছে। বিভাগের জন্য জমি লাগে। এমনিতে জমি যাচ্ছে অর্থনৈতিক (১০০টি) জোন করতে। ব্যবসায়ীরা নিয়ে নিচ্ছে জমি। ভূমিদস্যুরা নিয়ে নিচ্ছে জমি। তারপর যদি বিভাগের পর বিভাগ হয়, জেলায় জেলায় নতুন দফতর হয়, উপজেলায় হয় তাহলে কৃষি জমির কী হবে? সরকারের আকার বড় হওয়ার কারণে সচিবের পদ বেড়ে হয়েছে সিনিয়র সচিব। এসবে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু তাদের বেতন-ভাতার কী হবে? রাজস্ব বাজেট এবং উন্নয়ন বাজেট ঘেঁটে দেখা দরকার। রাজস্ব বাজেট সব খেয়ে ফেলছে, উন্নয়নের টাকা থাকছে না। বিপদে পড়ছে রাজস্ব বোর্ড। তাদের বিশাল বিশাল টার্গেট দেয়া হচ্ছে। কোত্থেকে আসবে টাকা। বাজেটের সঙ্গে বাস্তবতা হয়ে পড়ছে ভিন্ন। ট্যাক্সের জ্বালায় মানুষের অশান্তি বাড়ছে। যাদের আয়কর হওয়ার কথা নয়। তাদেরও অগ্রিম আয়কর দিতে হচ্ছে। অথচ ধনীরা কোন কর দিচ্ছে না। প্রতিবছর যে সর্বোচ্চ করদাতার নাম ছাপা হয়, তাতে প্রকৃত বড় বড় ধনীর নাম কোথায়? এখন সরকারের আকার বাড়াতে গিয়ে যদি কর তোলা না যায়, আবার বেতন গড়ে দ্বিগুণ তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াল? যেখানে বেসরকারী খাতে বেতন বাড়ার কথা সেখানে বেতন বৃদ্ধি স্থবির, যেখানে লোকের চাকরি যায়, টেকনোলজি যত উন্নত, অনিশ্চয়তা তত বেশি। বিপরীতে সরকারী চাকরি পূর্ণ-নিশ্চিত। বেতন-ভাতা নিশ্চিত- পারফরমেন্সের কোন বালাই নেই। এসবের পরিবর্তন হওয়া দরকার নয় কি? সরকারের ‘সাইজ’ নিয়ে ‘সিরিয়াসলি’ ভাবা দরকার নয় কি? দরকার নয় কী ক্রমবর্ধিষ্ণু বেসরকারী খাতের দক্ষতা নিয়ে ভাবার? লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×