ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাই জাতীয় ভাষানীতি

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

চাই জাতীয় ভাষানীতি

হাজার বছরের পথ পেরিয়ে আসা বাংলা ভাষা, মূলত বাঙালী জাতিসত্তার প্রতীক। এই ভাষার জন্য বাঙালী বুকের রক্ত ঢেলেছে রাজপথে। এই ভাষার পথ ধরেই ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন করেছে। বাংলা এখন বিশ্বের ত্রিশ কোটি মানুষের ভাষা। এই ভাষায় উন্নতমানের শিল্প সাহিত্য রচিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা পেয়েছে বাংলা একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির মাধ্যমে। বাংলা ভাষাসহ বাঙালীর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে এদেশে বহু মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছেন। বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য জাতির পিতা শেখ মুজিব ছিলেন আপ্রাণ সচেষ্ট। একাত্তর সালের পনেরোই ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি ঘোষণা করছি আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু হবে। বাংলা ভাষায় প-িতেরা পরিভাষা তৈরি করবেন; তারপর বাংলা ভাষা চালু হবে, সে হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুনÑ আমরা ক্ষমতা হাতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা চালু করে দেব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে। পরে তা সংশোধন করা হবে।’ স্বাধীনতার পর পর বঙ্গবন্ধু দাফতরিক ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জন্য নানা উদ্যোগও নিয়েছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক জান্তা শাসকরা ভাষার মর্যাদা দানে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু বাংলা ভাষার প্রাণশক্তি এত প্রবল, এত প্রচুর যে সামান্য ঔদাসীন্যে তার অবনমন ঘটবে না, ঘটেনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বাংলা ভাষাকে আরেক কঠিন অর্গল থেকে মুক্তি দেয়ার পথ প্রশস্ত করছেন। বলেছেনও তিনি, বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য বাঙালী রক্ত দিয়েছে। জেল, জুলুম, হুলিয়া মাথায় নিয়েছে। সেই ভাষাকে কঠিন অর্গল মুক্ত করাই হবে জাতি হিসেবে অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু বাংলা ভাষা এখনও অর্গলাবদ্ধ। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবি ওঠে স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পরও। আসলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়, কেবল আদালত ও দফতর এবং উচ্চশিক্ষা ছাড়া। বিদ্যালয়েও বাংলা অবহেলিত। ইংরেজী মাধ্যমের কাছে কুণ্ঠিত হয়ে থাকে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা এসেছে, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পেয়েছে বাংলা। ভাষা আন্দোলনের পঁয়ষট্টি বছর পরও সেই ভাষার উন্নতি ও সমৃদ্ধি কতটা অর্জিত হয়েছে, তার মূল্যায়ন হয় না। তাই ভাষার অবস্থা খুব শোচনীয় ও করুণ। চলছে চরম নৈরাজ্য। মনে হয় এসব দেখার দায়িত্ব কারও নেই। বানান রীতির অবস্থা তো ভয়াবহ। বাংরেজি ভাষার যথেচ্ছ ব্যবহারে উচ্চকিত এফএম রেডিও এবং টিভি। শেখ হাসিনাও এই ভাষা ব্যবহার পরিহারের জন্য বলেছেন। যার যেমন খুশি, তেমনভাবেই ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলা। আর মোবাইল কোন কোম্পানিগুলো তো রোমান হরফে বাংলা লেখার যে চল চালু করেছে, তা এক ধরনের আত্মবিশ্বাসী প্রবণতা। ভাষা সাম্রাজ্যবাদের দাপটে বিশ্বের অনেক ভাষার মতো বাংলা ভাষার অবস্থাও আজ ভাল নয়। একুশ শতকে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তার আর ডিজিটাল বাংলাদেশকালে বাংলা ভাষার ভবিষ্যত কী দাঁড়াবে, সে নিয়ে গবেষণা ও মূল্যায়ন নেই। কম্পিউটার ইংরেজীর আধিক্য বাংলা ভাষার বিকাশকে রুদ্ধ করে দিতে বাধ্য। রোমান হয়েও তার সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাষাগুলো যেসব সক্ষমতা অর্জন করেছে সেগুলো, বাংলা ভাষা ও হরফ তা এখনও অর্জন করতে পারেনি। বাংলা ভাষা এখন মূলত টিকে থাকার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। বাংলা ভাষার সুষ্ঠু বিকাশের জন্য প্রয়োজন একটি জাতীয় ভাষানীতি প্রবর্তন। প্রয়োজন জাতীয় ভাষা পরিকল্পনা, নতুবা ভাষা ক্রমশ মৃত্যুমুখে পতিত হতে বাধ্য।
×