ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম দেখে অভিভূত ৬ দেশের রাষ্ট্রদূত

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম দেখে অভিভূত ৬ দেশের রাষ্ট্রদূত

সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর থেকে ॥ প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা কার্যক্রম দেখে অভিভূত হলেন বিশ্বের উন্নত ছয় দেশের রাষ্ট্রদূতগণ। ‘ভিজিট বাংলাদেশ’ সফরের অংশ হিসেবে বুধবার দুপুরে খানসামা উপজেলার ৪নং খামারপাড়া ইউনিয়নের হকের হাটে অবস্থিত একটি কমিউনিটি ক্লিনিক সরেজমিন পরিদর্শন করেন তারা। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেনÑ দিনাজপুরের কৃতী সন্তান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী। সফরকারী দলে ছিলেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত ও সফরকারী দলের নেতা পিরেরা মাইডন, ইতালীর রাষ্ট্রদূত মারিও পালমা, জার্মানীর রাষ্ট্রদূত থমাস হেইরিজ প্রিন্স, নেদারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত লিওনি কুয়েলেনারে, ব্রিটেনের হাইকমিশনার এলিসন ব্ল্যাক এবং ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত মাইকেল হেসনিটি উইনথার। এছাড়াও ছিলেন ব্রিটিশ হাইকমিশনের চীফ প্রটোকল অফিসার এ কে এম ফজলুল হক। সফরকারী দলের সদস্যদের জানানো হয়, এই কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে ৮২ শতাংশ এলাকাবাসী সেবা নেয়। আর দিন হিসাবে গড়ে সেবা নেয়া মানুষের সংখ্যা ৩৫ জন। ক্লিনিকটি বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এবং সেখানে বিনামূল্যে সাধারণ রোগের ওষুধ পাওয়া যায় বলে দিন দিন এই সেবাগ্রহীতার সংখ্যাও বাড়ছে। এই কেন্দ্র থেকে সেবা নিয়ে মানুষ সন্তুষ্ট বলে পৃথক দুটি জরিপে জানা গেছে। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) জরিপে দেখা গেছে, বাড়ির পাশের ক্লিনিক থেকে ওষুধ আর পরামর্শ নিয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) জরিপ বলছে, সেবা নিয়ে ৯৮ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট। হকের হাট কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী মোকারম হোসেন বকুল মনে করেন, এই কমিউনিটি ক্লিনিক থাকার কারণে অনেকে আর উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান না। একই কথা বললেন পাকেরহাট স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা (ভারপ্রাপ্ত) কর্মকর্তা ডাঃ মোশায়ের রহমান। তিনি জানালেন, বছর চারেক আগে উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দৈনিক গড়ে সাড়ে ৪০০ রোগী বহির্বিভাগে সেবা নিতে আসত। এখন আসছে গড়ে ৩০০ জন। খানসামা উপজেলার ১৯টি ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু থাকায় উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগী কমেছে। হকের হাট কমিউনিটি ক্লিনিকের সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সফরকারী দলের অতিথিদের জানান, সেখানে এখন বিনামূল্যে ৩২ ধরনের ওষুধের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টি পরামর্শ দেয়া হয়। ক্লিনিকটিতে প্রসব সেবাও দেয়া হচ্ছে। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে এক হাজার ৮২১ জনকে প্রসব সেবা দেয়া হয়েছে। ক্লিনিকটির জন্য বছরে ওষুধের বাজেট ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম আলোচিত বিষয় ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ’ প্রকল্প বা কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প। জনগণের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার বাংলাদেশী এই উদ্যোগের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহলেরও আগ্রহ রয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান বাংলাদেশ সফরের সময় কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ দেখে গেছেন। এই উদ্যোগকে বিপ্লব আখ্যা দিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ‘কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ রেভল্যুশন ইন বাংলাদেশ’ (কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিপ্লব) নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য, উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে সব সময় সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান এবং সেবা গ্রহণকারী জনগণের মধ্যে একটি দূরত্ব থাকে। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের অবস্থানিক দূরত্ব ও সীমাবদ্ধতা, সেবা গ্রহণকারীর অর্থনৈতিক অবস্থা, অসচেতনতা এ দূরত্বের প্রধান নিয়ামক। চিকিৎসাসেবা গ্রহণ এবং গমনের জন্য অর্থের যেমন প্রয়োজন তেমনি নিজের বা পরিবারের কোনো সদস্যকে চিকিৎসা কেন্দ্রে নেয়ার জন্য কাজ বন্ধ রাখতে হয়। চিকিৎসা গ্রহণের বিষয়ে অসচেতনতা বা প্রাথমিক পর্যায়ে কোন চিকিৎসা গ্রহণ না করার প্রবণতাও এ দূরত্ব সৃজনে ভূমিকা রাখে। সেবা প্রদান ও সেবা গ্রহণের মধ্যকার দূরত্ব কমানোর জন্যই প্রধানমন্ত্রীর একটি অন্যতম প্রধান উদ্যোগ কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা। সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের কাজ শুরু করে। পাঁচ বছর মেয়াদে ১৮ হাজার ক্লিনিক স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সরকার কাজ শুরু করলেও ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিক চালু হয়। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে বন্ধ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো চালুর উদ্যোগ নেয়। এ পর্যন্ত ১৩ হাজার ৮৬৭টি ক্লিনিক স্থাপিত হয়েছে, এর ১২ হাজার ৯০৬টি পুরোদমে চালু রয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের জন্য স্থানীয় জনগণ এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ একরের বেশি জমি দান করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। চিকিৎসাসেবা গ্রাম পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্থায়ী কেন্দ্রের মাধ্যমে সেবা প্রদানের প্রয়োজনে প্রতি ৬ হাজার পরিবারের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ১৩ হাজার ৮৬৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক। প্রকল্পের মাধ্যমে সৃজিত এসব কমিউনিটি ক্লিনিকে একজন করে কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা কর্মী আছেন। প্রতি কমিউনিটি ক্লিনিকের এলাকায় আছে কমিউনিটি গ্রুপ ও সাব-গ্রুপ। প্রকল্প শেষে স্বাস্থ্য বিভাগের অপারেশন প্ল্যানের আওতায় বর্তমানে এসব কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালিত হচ্ছে। বিকেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে সফরকারী দলের রাষ্ট্রদূতগণ দিনাজপুর সদর উপজেলার মাসিমপুরে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী ‘বেদানা লিচু’র কয়েকটি বাগান পরিদর্শন করেন। এরপর সফরকারী দলের সদস্যগণ দিনাজপুরে অবস্থিত ঐতিহাসিক ‘রামসাগর দিঘী’ পরিদর্শন করেন।
×