ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে গ্রন্থমেলা

জাফর ইকবালের হাসিমুখ ঘিরে অন্যরকম উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

জাফর ইকবালের হাসিমুখ ঘিরে অন্যরকম উৎসব

মোরসালিন মিজান ॥ বইমেলার কিছু দৃশ্য খুব চেনা। পুরনোও বটে। তবে শিশু-কিশোর দ্বারা পরিবেষ্টিত মুহম্মদ জাফর ইকবালকে নতুন মনে হয়। অটোগ্রাফ শিকারিদের ভিড়ের মাঝখানে বসে নিয়মিতই নিজের নাম সই করেন বিপুল জনপ্রিয় লেখক। বহু বছর ধরে দেখা যায় এই দৃশ্য। তবু নতুন মনে হয়। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২২তম দিনে হ্যামিলনের এই বাঁশিওয়ালার পিছু নেয়ার ইচ্ছে হলো। বিকেল ৪টার দিকে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন তিনি। চলছিল ভক্তদের সঙ্গে ছবি তোলার কাজ। বাচ্চাদের ভিড় ঠেলে তার কাছে পৌঁছা যে সে কথা নয়। তাই সাহায্য করতে এগিয়ে আসলেন অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা লেখকের সহধর্মিণী ড. ইয়াসমীন হক ও প্রকাশক তারিকুল ইসলাম রনি। কিন্তু তারা কতক্ষণে সফল হবেন এর নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছিল না। অগত্যা শিশুদের দলেই ঢুকে পড়তে হলো। বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়নের পাশের ফাঁকা জায়গায়টুকু অধিকার করে নিয়েছিলেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও তার ভক্তপাঠকেরা। বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়ে ঘিরে রেখেছিল তাকে। কেউ অটোগ্রাফ নিচ্ছে। কেউ ব্যস্ত সেলফিতে। এক সেকেন্ডের জন্য নিস্তার পাচ্ছিলেন না লেখক। দেখে রীতিমতো মায়া হচ্ছিল তার জন্য। কিন্তু তিনি নিজে ভীষণ খুশি বলেই মনে হলো। তার চেয়ে বড় কথা অভ্যস্ত। ছোটরা যেভাবে চাচ্ছিল সেভাবেই চালাচ্ছিলেন তিনি। ঘাড় ন্যুয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন। আবার অনুরোধ আসছিল, ‘স্যার একটা সেলফি নেব। প্লিজ স্যার। একটা...।’ আবেদন শেষ হতে না হতেই চোখ তুলে ক্যামেরার দিকে তাকাচ্ছিলেন। সঙ্গে সেই মিষ্টি হাসিটা। কয়েকদফা চেষ্টা করার পর তার কিছুটা কাছে যাওয়া সম্ভব হয়। এ অবস্থায়ই কথা বলার শুরু। প্রতিদিন কতগুলো অটোগ্রাফ দিতে হয়? হাতে ব্যথা হয় না? স্বভাবসূলভ ভঙ্গিতেই প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। বলেন, ‘কতগুলো অটোগ্রাফ গুনে বলা সম্ভব নয়। যতক্ষণ মেলায় থাকি ততক্ষণ দেই। না, অটোগ্রাফ দিতে হাত ব্যথা করে না। ক্লান্তি লাগে না।’ কয়েক মিনিট কথা বলতেই ভিড় ঠেলে কাছে আসেন রনি। জানান, লেখক মৌলবাদী জঙ্গীদের হাতে নিহত প্রকাশক দীপনের প্রতিষ্ঠান জাগৃতিতে যাবেন। তাকে বের করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রকাশক। কিন্তু জাফর ইকবাল হাঁটা শুরু করতেই পিছু নেয় অটোগ্রাফ শিকারিরা। খুদে পাঠকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েই সামনে এগোতে থাকেন তিনি। হাঁটতে হাঁটতে অটোগ্রাফ। হাঁটতে হাঁটতে ছবি তোলা। জাগৃতির সামনে আগে থেকেই একটি চেয়ার পাতা ছিল। সেখানে কয়েক মিনিট বসে স্টলের সামনে যান। কথা বলেন দীপনের স্ত্রী জলির সঙ্গে। ছোট্ট করে জানতে চান, কমেছে তো যন্ত্রণাটা? জলির উত্তর আর কানে আসে না। এক তরুণ এসে হাজির। তার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করে দিতে হবে। অনুরোধ করছিলেন। জবাবে নিজের মতো করেই বললেন জাফর ইকবাল। বললেন, ‘মোড়ক উন্মোচন ইম্পর্টেন্ট না। ভাল লেখাটা খুব ইম্পর্টেন্ট। ভাল লিখ। পরে একসময় লোকজন তোমার পেছনে ঘুরবে। অনেক বেশি বই পড়। তাহলে ভাল লিখতে পারবে।’ নিজের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি প্রায় দুইশ বই লিখেছি। একটা বইয়েরও মোড়ক উন্মোচন করা হয়নি। তাহলে আমার জীবনটা কি বৃথা গেছে?’ এই পর্বটি শেষ হলে সামনে আসেন আরেক নবীন লেখক কেতন শেখ। জাগৃতি থেকে প্রকাশিত একটি বই প্রিয় লেখকের হাতে তুলে দেন। তরুণ এই লেখক সম্পর্কে দারুণ সব প্রশংসা বাক্য উচ্চারণ করেন জাফর ইকবাল। তার বই পড়েছেন জানিয়ে বলেন, ‘ভেরি গুড।’ এভাবে কয়েক মিনিট। তার পর মেলার মূল প্রবেশদ্বার সংলগ্ন জাগৃতি থেকে বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়নের দিকে ফিরে যাওয়ার পালা। হঠাৎ দিক পরিবর্তন করায় ভিড় কিছুটা কমে আসে। এবার সুযোগটা কাজে লাগান তার সহধর্মিণী। লম্বা সময় দূরে দূরে থাকার পর প্রিয়জনের কাঁধে একটি হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটেন কিছু সময়। কিন্তু ভিড় বাড়তে সময় লাগে না। দেখতে দেখতে ছিটকে পড়েন ইয়াসমীন। সমাবেশের কেন্দ্রে থেকেই লেখকের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এই যে ছেলেমেয়েরা ঘিরে আছে আপনাকে। ঘিরে থাকে সব সময়। এর মাঝে ভাল দিকটি কী বলে আপনি মনে করেন? ‘এটা ফ্যাস্টিভ্যাল। উৎসব। বইমেলা বললে অনেকে মনে করে বেচাকেনা। ব্যবসা। বাণিজ্য। আসলে তো উৎসব। এটা আমার বেশ লাগে’, বলেন জাফর ইকবাল। আপনার পাঠক সব সময়ই বেশি। এবার কি আরও বেড়েছে? উত্তর একটু অবাকই হতে হয়। এত এত শিশুর চারপাশে রেখে তিনি বলেন, ‘ফর এক্সামপল, গত বছর এত ভিড় করত বই নিয়ে যে, আমি কুল পেতাম না। এখন আমি কিন্তু ক্যাজুয়ালি দিতে পারছি। তার মানে, ডেফিনিটলি অটোগ্রাফ কম দিতে হচ্ছে। কিন্তু ভিড় তো কম নয়।’ তাহলে? তিনি বলেন, ‘ওদের অনেকেই ছবি তুলতে আসছে। আমার মন্দ লাগে না।’ তবে তিনি যোগ করেন, ‘ডিরেকশনটা ভাল না আসলে। ওদের দোষ না। সময়টাই এমন। এখন ফেসবুকে ওদের বেশি সময় চলে যাচ্ছে। এটি মাদকের মতো। মাদক কখনও ভাল হয় না।’ আর যারা আপনার বই কিনছে, তাদের বেলায় কী বলবেন? ‘ওরা আরও অনেকের বই কিনত কিন্তু কিনছে না’, জবাব দেন লেখক। বিনয়ী উচ্চারণে বলেন, ‘আমার বই হালকা সহজ বই। ইজি বই। আমারগুলো নিচ্ছে। সিরিয়াস পাঠক হতে পারছে না।’ আপনার জাদুটা তাহলে কোথায়? উত্তরে তিনি বলেন, ‘খুবই সোজা। আমিও তো একসময় ছোট ছিলাম। আমার তখন যা ভাল লাগত, এখন আমি বড় হয়ে তা-ই লিখি। এবং এটা কাজে আসছে।’ কথার এক পর্যায়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান শ্রাবণের পাশের ফাঁকা জায়গায় চেয়ার টেনে বসেন তিনি। পাশে ড. ইয়াসমীনের জন্য চেয়ার। সেটিতে বসে বাকি কথা বলার সুযোগ করে দেন প্রকাশক। সব মিলিয়ে শিশু কিশোরদের জন্য আপনার পরামর্শ কী হবে তাহলে? জানতে চাইলে তিনি পাঠাভ্যাস বাড়ানোর ওপর জোর দেন। বাচ্চাদের পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘তোমার যেটা ভাল লাগে, পড়। গোয়েন্দা বই ভাললাগে গোয়েন্দা বই পড়। ডাকাতের বই পড়তে ভাললাগে, ডাকাতের বই পড়। যার যে বই পছন্দ, পড়বে। বই পড়া এবং না পড়ার মাঝে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।’ মেলার সার্বিক ভাল মন্দ নিয়েও আলোচনা হয় তার সঙ্গে। জানতে চাওয়া হয়, এবারের মেলা কেমন লাগছে? জবাবে বলেন, ‘আগে বাংলা একাডেমিতে খুব জায়গার টানাটানি ছিল, সেই তুলনায় বড় হয়েছে। তবে নতুন জায়গাটা আমার মনে হয় গুছিয়ে দেয়া হয়নি। কোন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানটি কোথায়, সহজে খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রকাশকরা কেউ বলছেন, আমি খুব ভাল জায়গা পেয়েছি। কেউ আবার হাতাশা প্রকাশ করে বলছেন, জায়গা খারাপ পড়েছে। এটা হওয়া ঠিক না। আর, যে জিনিসটা আমাকে একটু বদার করেছে, মেলার সেভনটি পার্সেন্ট বইয়ের লেখক নতুন। এটা খুব ভাল ব্যাপার হতে পারত। তা হয়নি। যদি এমন হতো, তাদের লেখা খুব ভাল। প্রকাশকরা তাদের খুঁজে খুঁজে বের করে বই প্রকাশ করছে তাহলে কী সুন্দর একটা ব্যাপার হতো। হয়েছে উল্টোটি। লেখকরা নিজের টাকায় বই বের করে বন্ধুদের মধ্যে বিতরণ করছে।’ এ ব্যাপারে প্রকাশকদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। কথার এই পর্যায়ে ভিড় ঠেলে কাছে আসে একদল কিশোর সাংবাদিক। একটার পর একটা প্রশ্ন তাদের। প্রথম প্রশ্নÑ ভিড়ের মধ্যে বসে থাকতে কেমন লাগছে? চটজলদি উত্তরÑ ‘খুবই ভাল লাগছে।’ ওমনি সবার হিহিহি..। এমন সরল বলায় হেসে ফেলে অন্যরাও। পরের প্রশ্নটিÑ স্যার, এমন কি কখনও হয়েছে যে, আপনি মেলায় এসেছেন কিন্তু আপনাকে ভক্তরা ঘিরে ধরেনি? উত্তরে তিনি বলেন, ‘তা বোধহয় হয়নি, বুঝছ? আজ সকাল সকাল এসেছিলাম বই কিনতে। সেটি আর পারা গেল না, দেখ।’ খুদেরা আবারও প্রশ্ন করেÑ আপনি কি কখনও বলেছেন, তোমরা কিছুক্ষণের জন্য দূরে যাও? বলেন? জাফর ইকবাল খুব ইতিবাচক জাবাব দেন। আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘এটা আমি করে দেখেছি। তখন ওরা আমাকে সুযোগ দেয়। আমার কথা শুনে।’ তাদের শেষ প্রশ্নটি ছিলÑ আপনি চান্স পেলে কী কী বই কিনতে চান? উত্তরে জাফর ইকবাল বলেন, ‘চান্স পেলে আমি নতুন বই কী বের হয়েছে, জানতে চাইতাম। তার পর কিনতাম। এখনও তো দেখতেই পারিনি!’ এভাবে মজার মজার প্রশ্ন। উত্তর। বেশ কাটে সময়টা। মেলার মাঝে আরেক মেলা। দেখে মন ভরে যায়। নির্বাচিত বই ॥ সাহিত্য প্রকাশ থেকে এসেছে বিশ্বখ্যাত লেখক ‘তলস্তয়ের নীতি গল্প।’ সঙ্কলন ও সম্পাদনার কাজ করেছেন এহ্সান চৌধুরী। তলস্তয়ের কালজয়ী একগুচ্ছ গল্পের অনুবাদ গ্রন্থটি সংগ্রহে রাখার মতো। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ ও অন্যান্য প্রবন্ধ।’ প্রকাশ করেছে পাঞ্জেরী। সঙ্কলন গ্রন্থে সাহিত্যে কীভাবে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, তার একটি সরল আলোচনা আছে। আছে বাঙালীর সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতির নানা দিক নিয়ে লেখকের নিজস্ব বিশ্লেষণ। একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে আনোয়ারা সৈয়দ হকের ‘কিশোর উপন্যাস সমগ্র ২।’ এর আগে লেখিকার কিশোর উপন্যাস সমগ্র ১ প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয়টি। এখানে পাঁচটি উপন্যাস। লেখিকার মতে, বিভিন্ন রস ও স্বাদের বিষয় নিয়ে সাজানো হয়েছে দ্বিতীয় খ-। শব্দশৈলী থেকে এসেছে অনন্য আজাদের ‘ভ্রƒণ।’ প্রথাবিরোধী লেখক হুমায়ুন আজাদের পুত্র অনন্য। তার লেখায়ও সমাজ সংস্কারের দাবি। নিজের মতো করে লিখেছেন প্রবাসী তরুণ। নতুন বই ॥ মেলার ২২তম দিনে নতুন বই এসেছে ৮২টি। মোড়ক উন্মোচন ॥ মেলার মোড়ক উন্মোচন মঞ্চে ৪১টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মূলমঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচী : বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন অধ্যাপক জিনাত হুদা অহিদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন মোঃ আবুল কাসেম এবং ড. শাহিনুর রহমান। সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। প্রাবন্ধিক বলেন, শিক্ষা সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার একটি বাহন, সামাজিক সংহতি বিনির্মাণ ও সুরক্ষার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িক দর্শন, বাঙালী জাতীয়তাবোধ, দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের আলোকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে আমূল পরিবর্তন করা প্রয়োজন। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছিল সাংস্কৃতিক সংগঠন গেন্ডারিয়া কিশলয় কচিকাঁচার মেলা’র পরিবেশনা। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী কাদেরী কিবরিয়া, তপন মাহমুদ, শামা রহমান, মহিউজ্জামান চৌধুরী, নীলোৎপল সাধ্য এবং শিখা আহমাদ।
×