ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আপেলের জন্য শিশু নির্যাতন

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আপেলের জন্য শিশু নির্যাতন

সামান্য একটি আপেল চুরির জন্য মাত্র ১০ বছর বয়সী বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী একটি শিশুকে হাত-পা বেঁধে নির্মম নির্যাতনের বিষয়টি যেমন দুঃখজনক, তেমন মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। ঘটনাস্থল নাটোরের গুরুদাসপুর পৌরসভার চাঁচকৈড় বাজার। ক্ষুধার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে শিশু সাইদুল শনিবার সকালে স্থানীয় ফলের দোকান থেকে একটি আপেল চুরি করে দৌড় দেয়। দোকানি ও তার সহযোগীরা তা দেখতে পেয়ে শিশুটিকে ধরে ফেলে এবং গ্রিলের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে চালায় নির্মম নির্যাতন। পরে দুপুরের দিকে খবর পেয়ে পুলিশ এসে উদ্ধার করে শিশুটিকে। দুঃখজনক হলো, শিশুটির বাবা কৃষিশ্রমিক আবদুল মিয়ার পক্ষ থেকে আপেলের দাম মিটিয়ে দেয়ার কথা বলা হলেও রেহাই দেয়া হয়নি শিশুটিকে। কোন মামলাও হয়নি। দেশে সাম্প্রতিককালে শিশু নির্যাতন বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় পাঁচ দিন আগে নিখোঁজ ৪ শিশুর লাশ বিল এলাকা থেকে মাটিচাপা অবস্থায় উদ্ধার করেছে পুলিশ। সুন্দ্রাটিকি গ্রামের বাড়ির পাশে মাঠে খেলতে যাওয়ার পর নিখোঁজ হয় এই চার শিশু। ১৬ ফেব্রুয়ারি জনকণ্ঠে প্রকাশিত খবর, গাজীপুরে ঋণের টাকার জামিনদার না হওয়ায় ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীর ৪ বছরের শিশু পুত্রকে হত্যা করে এক সেলুন মালিক। রবিবার রাজধানীর ডেমরায় ১০ বছরের এক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকায় অপহরণের পর এক শিশুকে মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যার খবর আছে। রাজশাহীর পবা উপজেলায় মুঠোফোন চুরির অভিযোগে দুই কিশোরকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন করে ধারণ করা হয় ভিডিও চিত্র। পরে তা গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এক সেনা ও এক র‌্যাব সদস্যসহ ১৩ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। গ্রেফতারের খবরও আছে। এর বাইরেও প্রায় প্রতিদিনই ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়ায় শিশুহত্যা ও নির্যাতনের খবরা-খবর স্থান পায়। সাম্প্রতিককালে সংঘটিত সিলেটের শিশু রাজন হত্যা এবং খুলনায় রাকিব হত্যা বহুল আলোচিত ঘটনা, যা দেশব্যাপী রীতিমতো আলোড়ন তোলে। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে প্রবল ক্ষোভ ও ঘৃণা। গণমাধ্যমের চাপে পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ দুটো ঘটনায় দ্রুত আসামিদের গ্রেফতার করে চার্জশীট দিতে সক্ষম হয়। দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার সম্পন্ন হওয়ায় এ দুটো ক্ষেত্রেই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়। সঙ্গত কারণেই আশা করা গিয়েছিল যে, এর ফলে জনমনে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে এবং শিশু নির্যাতনকারীরা আইনের শাসনের ভয়ে তটস্থ থাকবে। বাস্তবে আদৌ এর কোন প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না, এটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। পৃথিবীকে যা কিছু সুন্দর ও বাসোপযোগী করে তোলে, তার মধ্যে মা ও শিশু অন্যতম। সেই মা ও শিশুই যখন কারণে-অকারণে সময়ে-অসময়ে নির্যাতন, হত্যা ও জুলুমের শিকার হয় তখন তা অবশ্যই নিন্দনীয়। আমাদের দেশে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন নিঃসন্দেহে আন্তরিক ও নিবিড়। সত্য বটে দেশের আর্থসামাজিক সমস্যা-সঙ্কট ও আর্থিক টানাপোড়েনে সর্বদাই এ বন্ধনটুকু ধরে রাখা যাচ্ছে না। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধেও কেন যেন অবক্ষয় ও ভাঙ্গন ধরতে শুরু করেছে। সমাজবিজ্ঞানীদের উচিত এর যথার্থ কারণ ও প্রতিকার খুঁজে বের করা। কেননা, শিশুর সঙ্গে কারও দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকে না। দেশে গত কয়েক বছরে শিক্ষার হার বেড়েছে আশাব্যঞ্জক হারে। সরকারের নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে দেশের সব শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়মুখী করার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবৈতনিক ও বিনামূল্যের বইয়ের আওতায় পরিচালিত। অনগ্রসর অঞ্চলে স্কুলে ধরে রাখার লক্ষ্যে শিশুদের জন্য মিড-ডে মিলেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিশুশিক্ষা ও কল্যাণের জন্য এসবই নিঃসন্দেহে ভাল উদ্যোগ। তবে সব ভাল উদ্যোগই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে যদি না সর্বস্তরে সচেতনতা আসে। শিশুদের প্রতি মা-বাবার যেমন কর্তব্য আছে, তেমনি আছে তার আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর। তাদের মধ্যে সবাই শিশুদের প্রতি সদয় হবে এমন ভাবা ঠিক নয়। সমাজে ভাল মানুষের পাশাপাশি দুর্বৃত্ত ও দুরাচার থাকবেই। বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় নানা অবক্ষয়ের মধ্যে অমানবিকতা ও পাশবিকতার বিষয়টি লক্ষণীয়। তা না হলে সামান্য একটি আপেল চুরির অপরাধে একদল বয়স্ক লোক শিশুকে বেধড়ক পেটাবে কেন? আর কেনইবা আত্মীয়তার বন্ধন থাকা সত্ত্বেও শিশুকে অপহরণ করেই শুধু ক্ষান্ত হবে না, মুক্তিপণ পাওয়ার পর মেরে ফেলবে! সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরী হয়ে পড়েছে।
×