ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বইমেলার তাৎপর্য

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বইমেলার তাৎপর্য

বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে থাকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে। বলা যায়, মূলত পহেলা ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করলেও প্রকৃতপক্ষে ২১তম দিনটি বইমেলার শ্রেষ্ঠতম দিন। কেননা, এদিন মধ্যরাতের প্রায় প্রথম প্রহর থেকেই জনসমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে, সুবিশাল ও মহিমাম-িত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সবুজ চত্বরে, সুউচ্চ ও দৃষ্টিনন্দন স্বাধীনতার আলোকস্তম্ভের আশপাশে। এ সময়ে বই কেনার হিড়িকও পড়ে যায় সব বয়সীর মাঝে। নিঃসন্দেহে এটি একটি ভাল ও উদ্দীপনাদায়ক উদ্যোগ। দেশের প্রকাশক ম-লী, লেখক সম্প্রদায় সর্বোপরি বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ প্রায় উন্মুখ হয়ে থাকেন গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটির জন্য। স্বভাবতই বইয়ের বেচাকেনাও বেড়ে যায় বহুগুণ। তবে কিছু কথা, কিছু প্রশ্ন এখানে উঠতে পারে অনিবার্যভাবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মেলার ২০তম দিন সোমবার পর্যন্ত নতুন বই প্রকাশিত হয়েছে দুই হাজার ৪৮৪টি। এতগুলো বইয়ের মধ্যে মানসম্মত ও পাঠোপযোগী কয়টি? এমনকি যে একুশে ও ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমরা গর্ব করি এবং যেটি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত, সে সম্পর্কেও এবারের বইমেলায় গ্রন্থ এসেছে মাত্র ৯টি। এত দৈন্য, এত অপ্রতুলতা কেন? প্রকাশকরা বলছেন, এ বিষয়ে ভাল গবেষণা ও পান্ডুলিপির অভাব প্রকট। আজকাল লেখকরাও কেন যেন পাঠকপ্রিয় ও চটুল বই লেখতে সমধিক আগ্রহী। সিরিয়াস বই লেখালেখিতে তরুণদের তেমন আগ্রহ নেই বললেই চলে। তা কেন হবে? তরুণ প্রজন্ম যদি ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশ-কাল-কৃষ্টি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-সমাজ-নৃতত্ত্ব সম্পর্কে সম্যক না জানে, তাহলে সমৃদ্ধ ও স্বশিক্ষিত হবে কিভাবে? শুধু মোবাইল, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট, ফেসবুকে আসক্ত হলে তো একটি দেশের তরুণ প্রজন্ম বিজ্ঞান ও মননে যথার্থ অর্থে আধুনিক ও শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠতে পারে না। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বহু প্রত্যাশিত বইমেলা তরুণ প্রজন্মের সেই আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারছে না, অনেকটা এ কারণেই বইমেলার সাফল্য ও সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বইমেলার উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা কারও অভিপ্রায় হতে পারে না। অমর একুশে ও ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে যে স্বতঃস্ফূর্ত বইমেলার সূচনা ও বিবর্তন, তা এককথায় প্রশংসনীয় নিঃসন্দেহে। কেননা, একে ঘিরে গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ-শিশুসাহিত্যসহ সৃজনশীল লেখনী শিল্প ও প্রকাশনা শিল্পের সুবিশাল এক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে দেশে, যার অর্থনৈতিক ব্যাপ্তি ও পরিধি কম নয়। এখন সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের অবশ্য কর্তব্য হবে একে প্রকৃত অর্থে আন্তর্জাতিক পরিম-লে মানসম্মত ও প্রতিযোগিতামূলক করে তোলা। উদাহরণত বলা যায়, বইমেলায় বিষয়-বৈচিত্র্যের প্রকট অভাব লক্ষ্য করা যায়। অথচ, সারা বিশ্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কতই না এগিয়ে যাচ্ছে। মাতৃভাষার মাধ্যমেও এই চর্চা বাড়াতে হবে। তা না হলে আমরা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ব। এত দীর্ঘ সময়, প্রায় মাসব্যাপী বইমেলার প্রয়োজন আছে কি না, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। এতে বাংলা একাডেমির নিয়মিত গবেষণা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। তদুপরি বইমেলায় দেশীয় লেখকদের বই ছাড়া বিদেশী লেখকদের বই পাওয়া যায় না। এতে করে অন্য দেশে অন্য ভাষায় এমনকি বাংলা ভাষায়ও লেখকরা কী লিখছেন, কী চিন্তাভাবনা করছেন তা জানা যায় না। অথচ জ্ঞান-বিজ্ঞান বিতরণের জন্যই মানবকল্যাণে নিবেদিত। বাংলা একাডেমি ও দেশীয় প্রকাশক গোষ্ঠীকে এই কূপম-ূক ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে অমর একুশে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হলেও বাংলাদেশের বইমেলা আন্তর্জাতিক চরিত্র অর্জনে ব্যর্থ হবে।
×