ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভাষার সঠিক ব্যবহার ও উচ্চারণে নতুন‍ প্রজন্মকে সচেতন হওয়ার আহ্বান

প্রকাশিত: ০২:২০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভাষার সঠিক ব্যবহার ও উচ্চারণে নতুন‍ প্রজন্মকে সচেতন হওয়ার আহ্বান

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা শ্রদ্ধা নিবেদনকালে পবিত্র শহীদ মিনারকে অবমাননার জন্য বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, এরা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন না। এরা দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় কীভাবে উপলব্ধি করবে। এদের মন তো স্বাধীন বাংলাদেশে নেই, এদের মন পড়ে থাকে হাজার মাইল দুরের পেয়ারের পাকিস্তানে। এ কারণেই শহীদ মিনারে কোথায় ফুল দিতে হয় তা জানে না। যারা (বিএনপি-জামায়াত) দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না, বঙ্গবন্ধুর খুনী ও যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানায়, আন্দোলনের নামে মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে, জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করে, তাদের কাছে দেশের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের কোন মূল্য থাকতে পারে না। বুধবার বিকেলে রাজধানীর খামারবাড়িস্থ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ২১ ফেব্রয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছে এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। অথচ পরাজিত পাকিস্তানীদের সুরে দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত নেত্রী, যিনি দু’বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি (খালেদা জিয়া) পাকিস্তানের সুরে সুরে বলেন ৩০ লাখ মানুষ নাকি মারা যায়নি! পাকিদের প্রতি তাঁর কতো প্রেম তা দেখুন। তিনি বলেন, ভাষার প্রতিও বিএনপি নেত্রীর এতটুকু সম্মান নেই। শহীদ মিনার অত্যন্ত পবিত্র স্থান। শহীদ মিনারের যে স্থানটিতে (বেদী) রাষ্ট্রের প্রধান রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকারসহ সবাই শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন, সেই স্থান মাড়িয়ে বিএনপি নেত্রী দলবল নিয়ে উঠে গিয়ে ফুল দিয়েছেন। বেদী ছেড়ে উনি কোথায় ফুল দিলেন? নিজের পায়ে কী ফুল দিলেন? মধ্যরাতে বেরোনোর কারণে উনি (খালেদা জিয়া) বেতালা থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁর দলের নেতারা তো তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদনের ঠিক জায়গাটা দেখিয়ে দেবেন। তাঁর সঙ্গে দলের নেতারাও মধ্যরাতে বেতালা ছিলেন কিনা জানি না। যেখানে সবাই শ্রদ্ধা জানালেন, বিএনপি নেতা তার ওপর উঠে শহীদের মর্যাদা ও পবিত্রতা নষ্ট করে দিয়ে আসলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য অধ্যাপিকা মেরিনা হোসেন, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার ও কবি নির্মলেন্দু গুণ। আলোচনা সভা পরিচালনা করেন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ ও উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই সকল ভাষা শহীদদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নিরাবতা পালন করা হয়। বিকাল তিনটায় আলোচনা সভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন ওয়ার্ড-থানা থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকে। বেলা দুইটার মধ্যে কৃষিবিদের হলরুম কানায় কানায় পুর্ন হয়ে যাওয়ায় প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বক্তৃতা শোনেন নেতাকর্মীরা। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীও উল্লেখ করে বলেন, ‘হল রূমটি ছোট। তাই অনেকে ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। বাইরে দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুনতে হচ্ছে। কিন্তু তারা আমার দৃষ্টির বাইরে থাকলেও রয়েছেন আমার মনের ভেতরে। দলের প্রতিটি নেতাকর্মীকে বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ মেনে জনগণের কল্যাণে কাজ করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ যে আদর্শ নিয়ে স্বাধীনতা হয়েছে, সেই আদর্শ সবাইকে ধারণ করে দেশকে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ গড়ে তুলতে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। কী পেলাম বা কী পেলাম না, সেটি বড় কথা নয়। বরং দেশ ও দেশের মানুষকে কী দিতে পারলাম সেটিই বড় কথা। তিনি বলেন, সততাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় শক্তি। পদ্মা সেতু নিয়ে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। আমি এবং আমার পরিবারই ছিল সেই ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্য। তবে সততার শক্তি ছিল বলেই আমরা সেই ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করতে পেরেছি। যা আজ প্রমাণিত হয়েছে। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে করে বঙ্গবন্ধুর এই কন্যা দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা দেন, দেশ ও দেশের মানুষের সম্মান এতটুকু ক্ষুন্ন হোক তা আমার এবং আমার পরিবারের দ্বারা কখনো হবে না। বাংলাদেশ যে উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ও অন্ধকার থেকে আলোর পথে যাত্রা শুরু করেছে, কোন শক্তিই তা আর পেছনের দিকে টেনে ধরতে পারবে না ইনশাল্লাহ। শেখ হাসিনা বলেন, বাঙালী জাতি বীরের জাতি। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে বিজয়ী করার জাতি। বাঙালী জাতি কখনো মাথা নিচু করে চলবে না, কারোর কাছে ভিক্ষা নিয়ে চলবে না। কারোর কাছে হাত পেতে বা মাথা নিচু করে চলতে পারে না। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, ’৭৫-এ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারীরা বাঙালী জাতিকে বিশ্বের কাছে ভিক্ষুকের জাতি জানিয়ে ভিক্ষা এনে নিজেদের পকেট ভারি করেছে। বাঙালীর কঙ্কালসার দেহ দেখিয়ে নিজেরা বিদেশ থেকে ভিক্ষা এনে নাদুসনুদুস হয়েছে। বিশ্বের কাছে আমাদের দেশের মানুষকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল যে, তারা নিজেরা কিছু করতে পারে না, শুধু ভিক্ষা করে খায়। তিনি বলেন, বাঙালীরা যে সবই পারে আমরা তা প্রমাণ করেছি। তাই দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছি, খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তুলেছি। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি নেত্রী (খালেদা জিয়া) বলেছিলেন, খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ন হওয়া ভাল না, বিদেশ থেকে ভিক্ষা পাওয়া যাবে না। জবাবে বলেছিলাম- ‘আপনারা (খালেদা জিয়া) তো দেশ চালাননি। দেশের কঙ্কালসার মানুষকে দেখিয়ে নিজেদের পকেটে পুড়েছেন। আপনারা ভিক্ষুকের সর্দার ছিলেন, জনগণের নয়। তিনি বলেন, আমরা ভিক্ষুকের সর্দার হতে চাই না। জনগণের মৌলিক চাহিদা যদি পুরণ করতে না পারি তবে ক্ষমতা থেকে কী লাভ। তাই আমরা দেশকে খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছি। আমরা কারোর কাছে হাত পাতবো না, মাথানত করবো না। সেইভাবেই দেশকে আমরা গড়ে তুলছি। বিএনপি-জামায়াত জোটের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এরা কখনোই দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। বঙ্গবন্ধুর খুনী ও যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী-উপদেষ্টা বানায়, মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে, শত শত পবিত্র কোরআন শরিফ পোড়ানো, জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করাই হচ্ছে বিএনপির আসল চরিত্র। আন্দোলনের নামে তারা দেশে কী বীভৎস্য কর্মকান্ডই না তারা ঘটিয়েছে। বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে, ট্রাকে, বেবিট্যাক্সিতে পেট্টোল বোমা মেরে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করাই নাকি তাদের আন্দোলন! তিনি বলেন, যাদের মধ্যে ন্যুনতম মনুষত্ব্যবোধ নেই, যারা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করতে পারে- তাদের কাছ থেকে জাতির ভাষা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ কী আশা করতে পারে দেশবাসী। এদের কাছে এসবের কোনই মূল্য নেই। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনের পথ বেয়েই এসেছে আমাদের মহার্ঘ স্বাধীনতা। আর আমাদের প্রতিটি অর্জনই করতে হয়েছে লড়াই-সংগ্রামের পথ বেয়ে। বার বার আঘাত এসেছে, কিন্তু বাঙালী জাতি আন্দোলন করেই রূখে দাঁড়াতে হয়েছে। আর বাংলাদেশের যতো অর্জন এসেছে, সেই অর্জনের প্রতিটি আন্দোলনের পেছনে রয়েছে আওয়ামী লীগের অবদান। নতুন প্রজন্মকে বাঙালীর আন্দোলন-সংগ্রাম, সঠিক ইতিহাস ও অতীত সম্পর্কে অবগত করতে দেশের বিদগ্ধজনদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে উদ্বৃত করে বলেন, সেখানে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন- নতুন প্রজন্মকে বাঙালীর সঠিক ইতিহাস ও অতীত জানাতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর এই বক্তব্য আজও আমাদের জন্য প্রযোজ্য। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল, সেটি জানতে দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের মধ্যেও অনেকে আছেন তাদের মুখ থেকে শুনতে পেয়েছি- বঙ্গবন্ধু জেলে থেকে ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রাখলেন কীভাবে? শুধু পাকি প্রেমিরাই নন, আমাদেরও অনেকে এ নিয়ে এই ভুলটি করেছেন। এ সময় ভাষা আন্দোলনের সময় পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনীর রিপোর্টে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর কী কী ভূমিকা ছিল তা অনুষ্ঠানে একে একে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে চলা আন্দোলন বেগবান করতে বঙ্গবন্ধুর ছাত্রলীগ গঠন, ছাত্রলীগ, তমুদ্দিন মজলিসসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন, ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় অনুষ্ঠিত মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্ব করা, ভাষার আন্দোলন করতে গিয়ে বার বার বঙ্গবন্ধুর কারাবরণ, কারাবন্দী থেকেও ভাষার আন্দোলন সারাদেশে বেগবান করতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকার কথাও একে একে তুলে ধরেন তিনি। একইসঙ্গে ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত বাঙালীর প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামের প্রকৃত অতীত ইতিহাস নতুন প্রজম্মের সামনে তুলে ধরতেও তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী পুনর্বার বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার ও উচ্চারণে দেশের নতুন প্রজন্মকে আরও সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, মাতৃভাষায় শিক্ষায় যেভাবে গ্রহণ করা যায়, অন্য কোন ভাষায় তা হয় না। তবে গোটা বিশ্বই এখন গ্লোবাল ভিলেজ। তাই মাতৃভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষাও শেখার সুযোগ থাকতে হবে। তবে ইদানিং দেখছি একটি শ্রেণীর যেন ফ্যাশনে ও প্রবণতায় পরিণত হয়েছে বাংলাকে ইংরেজি একসেন্টে (উচ্চারণ) কথা বলা। বাংলাকে ইংরেজি ধ্বনিতে বলার এই প্রবণতা অবশ্যই পরিত্যাগ করতে হবে। এটি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নিজের মাতৃভাষাকে বিকৃত করে অন্যদেশের ভাষার আদলে কথা বলার প্রবণতা দূর করতে সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে।
×