ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বব্যাংকের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে, মামলার প্রয়োজন নেই

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বিশ্বব্যাংকের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে, মামলার প্রয়োজন নেই

পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের উত্থাপিত অভিযোগের ভিত্তিতে কানাডার আদালতে দায়ের করা মামলাটি খারিজ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই জোরালোভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই আলোচনার যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। কেননা বিশ্বব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান কোনরকম তথ্যপ্রমাণ হাতে না থাকা সত্ত্বেও বলা চলে অন্যায়ভাবে বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে এই প্রকল্পে হঠাৎ করেই অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়। ফলে একদিকে যেমন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রচণ্ড বিঘœ সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে তেমনি সরকারের ভাবমূর্তিও যথেষ্ট ক্ষুণœ হবার উপক্রম হয়। বিশ্বব্যাংকের এই ভিত্তিহীন অভিযোগকে কেন্দ্র্র করে আমাদের দেশের এক শ্রেণীর আলোচক, বিশেষ করে টিআইবি (ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) যে সমালোচনার ঝড় তুলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল তা আমরা সকলেই জানি। এসব নিন্দুকের অহেতুক অপপ্রচারে কান না দিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে সেসব সমালোচককে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন। সেইসঙ্গে বিশ্বব্যাংককেও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তাদের অতিমাত্রায় খবরদারির দিন শেষ হয়ে আসছে। এটা ছিল বিশ্বব্যাংকের প্রতি প্রথম চপেটাঘাত। কেননা তারা ভাবতেই পারেনি যে, তাদের প্রত্যক্ষ অর্থায়ন ছাড়া উন্নয়নশীল দেশে এতবড় একটি অবকাঠামো নির্মিত হতে পারে। এখন কানাডার আদালতে সঠিক তথ্যপ্রমাণের অভাবে মামলাটি খারিজ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাংকের মুখোশ জনগণের সামনে খুবই নগ্নভাবে উন্মোচিত হয়েছে। ফলে সরকারের এবং দেশের মানুষের যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে কথা বলার এবং তারা তা করছেনও। এই আলোচনার ধারাবাহিকতায় একাংশ থেকে জোরালো দাবি উঠেছে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা দায়ের করার জন্য। বিশ্বব্যাংককে পাশ কাটিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরপরই বিশ্বব্যাংক তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং সেজন্য তারা তাদের উর্ধতন কর্মকর্তাদের বাংলাদেশে পাঠায়। তারা ভবিষ্যতে উন্নয়ন প্রকল্পে আরও বেশি সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়ে সরকারের সঙ্গে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝি কিছুটা প্রশমনের চেষ্টা করেছেন। তার ওপর কানাডার আদালতের এই রায়ের পর বিশ্বব্যাংকের অবস্থান আরও বেশি পরিষ্কার হয়ে গেছে জনগণের কাছে। তাই মনে হয় না এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে আর কোন তিক্ততা সৃষ্টির অবকাশ আছে। বিশ্বব্যাংক সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং তাদের পরবর্তী ভূমিকা যদি আমরা একটু বিবেচনা করি তাহলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হলো উন্নত বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকার স্বার্থরক্ষা করা। যে কারণে তাদের প্রতিটা আর্থিক সহযোগিতা বা অর্থায়নের সঙ্গে এমন সব শর্ত জড়িত থাকে যাতে করে সেসব অর্থায়নে লোক দেখানো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংঘটিত হলেও দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সাধিত হয় না। ফলে সেই দেশ কখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। এত সব জানা সত্ত্বেও বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার মতো সময় এখনও আসেনি। বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তে পৃথিবীর অনেক দেশই ক্ষুব্ধ ও হতাশ হলেও কেউ স্পষ্ট করে সেটা বলতে পারে না। আমাদের দেশই মনে হয় প্রথম একটি দেশ যাদের কাছে বিশ্বব্যাংকের মুখোশ কিছুটা হলেও উন্মোচিত হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের সমান্তরাল কোন আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে না উঠবে ততক্ষণ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মোটেই সমীচীন হবে না। বিশ্বব্যাংকের এহেন পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণেই এর বিকল্প বা পরিপূরক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সক্রিয় উদ্যোগ অব্যাহত আছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছে না, কারণ কাজটা বেশ কঠিন। বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠার পেছনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো এক ভয়াবহ ঐতিহাসিক ঘটনা এবং বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক দুটো ধারা প্রবর্তনের বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাছাড়া আজকের বিশ্বব্যাংক বিগত সত্তর বছরের ফল। তাই এর পাশাপাশি কোন প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে গেলে সেই পরিমাণ শ্রম ও সময় দিতে হবে। তবে আশার কথা হলো এই প্রচেষ্টার ফল হিসেবে ব্রিকস ব্যাংক ইতোমধ্যে তার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু“করেছে। এই ব্রিকস ব্যাংক হলো ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন এবং সাউথ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বব্যাংকের সমান্তরাল একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের সবারই মনে থাকার কথা যে, এই ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক যাত্রার ঘোষণা হওয়া মাত্র ব্রাজিলের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ভয়ঙ্কর উত্থান-পতন শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে ব্রাজিলের ক্ষমতাসীন সরকারের পতন ঘটে এবং আমেরিকার পছন্দের দল ক্ষমতায় আসে। কেননা আমেরিকার নাকের ডগার কোন দেশকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী কোন সংস্থার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে দেবে না। কিউবার কাছ থেকে এই শিক্ষা আমেরিকা ভালভাবেই গ্রহণ করেছে। এমনকি ইউক্রেনের ঘটনা নিয়ে রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তার পেছনেও এই ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন এবং সাউথ আফ্রিকা) এবং ব্রিকস ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ অনেকাংশে দায়ী বলে ধারণা করা হয়। উল্লেখ্য, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার যত ক্ষতি হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলোর। কারণ, সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুধু থমকেই যায়নি, এক ধরনের অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। অবশ্য নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো ঘটনা ইউরোপে বেশ পুরনো। আর এ কারণেই আমেরিকার ভ্রান্ত নীতির খেসারত ইউরোপের দেশগুলোকে সবচেয়ে বেশি দিতে হয়েছে। তথাপিও এই অঞ্চল তথাকথিত রাশিয়া জুজুর ভয়ে আমেরিকার লেজুরবৃত্তি করে চলছে। এতসব আন্তর্জাতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা এক রকম নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, বাংলাদেশের উচিত হবে না এই মুহূর্তে পদ্মা সেতুর বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের মুখোমুখি দাঁড়ানো এবং ক্ষতিপূরণ চেয়ে এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা। তাছাড়া আন্তর্জাতিক সংস্থা হিসেবে এই প্রতিষ্ঠান এমনিতেই এক ধরনের দায়মুক্তি ভোগ করে থাকে। এই দায়মুক্তির কারণ দেখিয়ে বিশ্বব্যাংক কানাডার আদালতেও এই মামলা থেকে নিজেদের অব্যাহতি চেয়েছিল। যেহেতু বিশ্বব্যাংক নিজেরাই এই দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনকারী, তাই আদালত মামলাটি চালিয়ে গিয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়, যা বিশ্বব্যাংকের জন্য ভয়ানক এক লজ্জার ঘটনা। প্রকৃত সত্য প্রকাশ হয়েছে এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দেশে ও বিদেশে উজ্জ্বল হয়েছে। এতেই সন্তুষ্ট থেকে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে বরং তাদের সঙ্গে সহযোগিতার ভাব বজায় রেখেই বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে আগামী দিনে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উন্নতির যে মহাসড়কে আছে এবং যখন দীর্ঘমেয়াদী অনেক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তখন শুধু বিশ্বব্যাংকই নয়, সকল আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কৌশলগত কারণে সব অন্যায়ের যেমন প্রতিবাদ করা যায় না, আবার সব অপরাধের তেমনি বিচার করাও সবসময় সম্ভব হয় না। এটা ব্যক্তি এবং রাষ্ট্র উভয়ের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। এখানে উল্লেখ্য, এই পদ্মা সেতু দুর্নীতি মামলার আরেক সংক্ষুব্ধ পক্ষ ছিল কানাডার এক নামকরা কোম্পানি এসএনসি লাভালিন। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগের কারণে কোম্পানিটি মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাদের যথেষ্ট সুনাম ক্ষুণœ হয়েছে এবং ব্যবসারও যথেষ্ট ক্ষতি সাধিত হয়েছে। কানাডার আদালতে অভিযোগটি প্রমাণ না হওয়ায় এবং মামলাটি খারিজ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের মতো তারাও বেশ উপকৃত হয়েছে এবং একই সঙ্গে আনন্দিতও। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে এই কোম্পানির স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোন বিষয় নেই। কেননা উন্নত দেশের একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি হিসেবে তারা বিশ্বব্যাংক থেকে কোন ঋণ সুবিধা পায় না। তথাপিও একটি সংক্ষুব্ধ এবং ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ হিসেবে কোম্পানির পক্ষ থেকে এই বিষয়ে কোন মন্তব্যই করতে দেখা যায়নি, আর বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করা তো অনেক পরের কথা। তারা ভাল করেই জানে যে, অনেক আন্তর্জাতিক কাজ তারা করে থাকে যেগুলোর অর্থায়ন হয় বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে। সুতরাং এসব বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে অহেতুক তিক্ততা সৃষ্টি করলে ভবিষ্যতে লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাই বেশি থাকে। বিশ্বব্যাংকের কৃতকর্মের, বিশেষ করে ভিত্তিহীন দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টি আজ মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। পাশাপাশি এটাও প্রমাণ হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশকে ঢালাওভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বলে অপপ্রচার করা হলেও অনেক দুর্নীতির অভিযোগই ভিত্তিহীন এবং সঠিক নয়। তাই যারা দুর্নীতি দুর্নীতি বলে চিৎকার করে, বিশেষ করে টিআইবি, তারা এখান থেকে শিক্ষা নেবে এবং ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে মন্তব্য করার আগে সতর্ক থাকবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। এটাই বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তে বড় প্রাপ্তি। তাই বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে আর মামলা করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১৭ লেখক : ব্যাংকার, টরনটো, কানাডা
×