ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হাবিবুর রহমান স্বপন

ভাষা ও নৃগোষ্ঠীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ভাষা ও নৃগোষ্ঠীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে হবে

নানান দেশের নানান ভাষা বিনা স্বদেশী ভাষা, মেটে কি আশা? মাতৃভাষা সবার কাছেই প্রিয়। ভাষা হচ্ছে ইতিহাসের দলিল এবং কবিতার জীবাষ্ম। দুনিয়ার সকল মানুষই মাটির ভাষায় কথা বলে। দেশ ও জাতির বড় সম্পদ তার ভাষা ও সাহিত্য। সব দেশে সব যুগে ভাষা ও সাহিত্য শিল্পকে অবলম্বন করেই সম্ভব হয়েছে সবরকম উন্নতি ও প্রগতি। বিদেশী বা ভিন্ন ভাষা কাজের ভাষা হতে পারে, তবে তা ভাবের ভাষা নয়। যেমনটি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ইংরেজী আমাদের পক্ষে কাজের ভাষা। কিন্তু ভাবের ভাষা নহে’। বিশ্বে মোট ভাষার সংখ্যা ৬ থেকে ৭ হাজার। দু’শ’ বছর আগে এই ভাষার সংখ্যা ছিল প্রায় দশ হাজার। সম্প্রতি দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র পড়ে জানলাম ইতোমধ্যেই বিশ্বের প্রায় দেড় হাজার ভাষা লোপ পেয়েছে। শুধু ভারতেরই দু’শতাধিক ভাষা লোপ পেয়েছে গত ৫০ বছরে। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, জীবিকার সন্ধানে মানুষের শহরে গমন এবং যাযাবর উপজাতি লোকদের মধ্যে তাদের ঐতিহ্যগত ভাষায় কথা বলার শঙ্কাই এর জন্য দায়ী। সমীক্ষাটি চালানো হয় চার বছর ধরে। এতে দেখা যাচ্ছে, ভারতে ২৩০টি ভাষা লোপ পেয়েছে। বিচিত্র ও দ্রুত আধুনিকায়নসমৃদ্ধ ভারতে সময়ের আবর্তে উত্তীর্ণ হয়েছে ৮৭০টি ভাষা। ভারতে এখনও ৪৮০টি উপজাতি ভাষায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কথা বলে। অলাভজনক ভাষা ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট লেখক গণেশ দেবী সম্প্রতি একটি বিদেশী বার্তা সংস্থাকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছেন, ‘আমি শঙ্কিত যে, ভারতে বিপুলসংখ্যক ভাষা লোপ পাচ্ছে। সমীক্ষাটি যেন-তেন প্রকারে শেষ করা হয়নি। তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবক ১২০ কোটি মানুষের বিশাল ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথা বলেন। শুধু তাই নয়, জরিপকর্মীরা বিভিন্ন ভাষার মানুষের কথা এবং লিখিত ভাষার দলিল সংগ্রহ করেন। বিলুপ্ত প্রায় ১০টি ভাষার দলিল-প্রমাণাদি পরীক্ষা করে দেখা গেছে এগুলোর মধ্যে রয়েছে লোকগীতি ও গল্প। ভারতে রয়েছে ১৯০টি উপজাতি গোষ্ঠীর বসবাস। ভারতের সংবিধানে রয়েছে ২৩টি রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি। এর মধ্যে হিন্দী প্রধান রাষ্ট্রীয় ভাষা। ব্যবসা ও শিআক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাচ্ছে ইংরেজী ভাষা। সব মানুষই অন্তত একটি ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। বিভিন্ন ধ্বনি পরপর সাজিয়ে তৈরি হয় শব্দ, আর অনেক শব্দ নানা বিন্যাসে সাজিয়ে গড়া অসংখ্য সব বাক্য নিয়ে তৈরি হয় একটি ভাষা। কিন্তু কোন্ ভাষায় কতগুলো বর্ণ এবং বাক্য হতে পারে, তার কোন সীমাবদ্ধতা নেই। ভাষার বক্তারা কতগুলো সীমিত সংখ্যক সূত্র কাজে লাগিয়ে অসীম সংখ্যক বাক্য বলতে ও বুঝতে পারেন। আধুনিক চম্স্কীয় ভাষা বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই সূত্রগুলোকে বলা হয় বক্তার মানসিক ব্যাকরণ। বক্তা যখন ছোটবেলায় ভাষা অর্জন করেন, তখন তার মধ্যে এই মানসিক ব্যাকরণের বোধ গড়ে ওঠে। এই ব্যাকরণের অংশ হিসেবে আছে ভাষাটির ধ্বনি ব্যবস্থা (ধ্বনিতত্ত্ব), শব্দের গঠন (রূপমূলতত্ত্ব), কিভাবে একাধিক শব্দ সংযুক্ত হয়ে পদগুচ্ছ বা বাক্য গঠন করে (বাক্যতত্ত্ব), ধ্বনি ও অর্থের মধ্যে সম্পর্ক (অর্থবিজ্ঞান) এবং ভাষার শব্দভা-ার। ভাষার শব্দগুলোর ধ্বনি ও অর্থের মধ্যে সম্পর্ক যাদৃচ্ছিক। ভাষা হলো সেই ব্যবস্থা যা ধ্বনির সঙ্গে অর্থের সম্পর্ক স্থাপন করে। ভাষা সম্পর্কে কোন মানুষের এই মানসিক বোধ, বাস্তব জীবনে তার ভাষার প্রয়োগ অপেক্ষা স্বতন্ত্র। মানুষ বাক বৈকল্যের শিকার হয়ে বা অন্য যে কোন কারণে ভাষা প্রয়োগে ভুল করতে পারে; কিন্তু এতে তার ভাষাবোধের কিছু হয় না। ব্যাকরণ বিভিন্ন রকম হতে পারে। বর্ণনামূলক ব্যাকরণে ভাষার বক্তার অচেতন ভাষিক জ্ঞানের একটি বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করা হয়। এটি ভাষার বক্তার মানসিক ব্যাকরণের একটি মডেল হিসেবে গণ্য করা যায়। বিধানমূলক ব্যাকরণে ভাষার ব্যাকরণ কী রকম হওয়া উচিত, তার বিধিবিধান দেয়ার চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় বিদেশী ভাষা শেখানোর উদ্দেশ্যে শিক্ষামূলক ব্যাকরণ লেখা হয়। ভাষা বিজ্ঞানীরা বিশ্বের হাজার হাজার ভাষা নিয়ে গবেষণা করে বের করেছেন যে, এদের মধ্যে বহু পার্থক্য থাকলেও এই পার্থক্যের পরিমাণ সীমিত। সব ভাষার ব্যাকরণেই কিছু বিশ্বজনীন অংশ আছে। ভাষা বিজ্ঞানীরা ভাষাসমূহের এই বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্যগুলোকে কতগুলো নিয়মনীতির সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। এই নিয়মনীতিগুলোর সমষ্টিগত নাম দেয়া হয়েছে বিশ্বজনীন ব্যাকরণ। ভাষা বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিশ্বজনীন ব্যাকরণ সব ভাষার ব্যাকরণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে এবং এর মানুষের সহজাত ভাষা অর্জন ক্ষমতার সরাসরি সম্পর্ক আছে। ‘ভাষা’ ধারণাটির কোন সুনির্দিষ্ট, যৌক্তিক ও অবিতর্কিত সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। কেননা যে কোন কিছুর সংজ্ঞা ভাষার মাধ্যমেই দিতে হয়। তাই ভাষার আত্মসংজ্ঞা প্রদান দুরূহ। তবে ভাষার একটি কার্যনির্বাহী সংজ্ঞা (ডড়ৎশরহম ফবভরহধঃরড়হ) হিসেবে বলা যায় যে, ভাষা মানুষের মস্তিষ্কজাত একটি মানসিক ক্ষমতা, যা বাকসঙ্কেতে রূপায়িত (ধ্বনিভিত্তিক বা লৈখিকরূপে) হয়ে একই সমাজের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। ভাষা মানুষে মানুষে যোগাযোগের প্রধানতম বাহন। ভাষার কতটুকু মানুষের কোন জন্মগত বৈশিষ্ট্য আর কতটুকু পরিবেশনির্ভর সে ব্যাপারে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানীদের মতভেদ আছে। তবে সবাই একমত যে, স্বাভাবিক মানুষ মাত্রেই ভাষা অর্জনের মানসিক ক্ষমতা নিয়ে জন্মায় এবং একবার ভাষার মূলসূত্রগুলো আয়ত্ত করে ফেলার পর বাকি জীবন ধরে মানুষ তার ভাষায় অসংখ্য নতুন নতুন বাক্য সৃষ্টি করতে পারে। এরকম অসীম প্রকাশ ক্ষমতাসম্পন্ন ভাষা একান্তই একটি মানবিক বৈশিষ্ট্য; মানুষ ছাড়া আর কোন প্রাণী এই ক্ষমতার অধিকারী নয়। প্রতিটি মানুষ ভাষা আয়ত্ত করার সহজাত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্ম নেয় এবং ঐ মানুষটি যে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক পর্যায়ের নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবেশবেষ্টিত ভাষিক সমাজের অন্তর্গত, সেই সমাজে সে দৈনন্দিন ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে তার নিজস্ব ভাষাজ্ঞান বিকশিত করে। ভাষা মূলত বাগযন্ত্রের মাধ্যমে কথিত বা ‘বলা’ হয়; কিন্তু একে অন্য মাধ্যমে তথা লিখিত মাধ্যমেও প্রকাশ করা সম্ভব। এছাড়া প্রতীকী ভাষার মাধ্যমেও ভাবের আদান-প্রদান হতে পারে। ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো একটি ভাষিক প্রতীক এবং এর দ্বারা নির্দেশিত অর্থের মধ্যকার সম্পর্ক যাদৃচ্ছিক। একই বস্তু বা ধারণা কেন বিভিন্ন ভাষায় ভিন্ন ধরনের ধ্বনিসমষ্টি দ্বারা নির্দেশিত হয় (যেমন-একটি গৃহপালিত চতুষ্পদ প্রাণীর নাম বাংলায় গরু, ইংরেজী ভাষায় ঈড়ি কাউ, ফরাসি ভাষায় ঠধপযব ভাশ্, ইত্যাদি কেন হয়, তার পেছনে একেকটি ভাষার বক্তাসমাজের ভেতর সমঝোতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রীতিনীতি ছাড়া আর কোন কারণ নেই। মানুষের ভাষার সঙ্গে অন্য প্রাণীদের যোগাযোগের ‘ভাষার’ একটা বড় পার্থক্য হলো ভাষার সাহায্যে মানুষ বিভিন্ন ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারে, যা প্রাণীরা পারে না। যেমন-মৌমাছিদের নাচ কেবল মধু আহরণের সুবিধার জন্যই কাজে লাগে। আর উল্লুক জাতীয় বানরের ভাষিক দক্ষতা অন্য প্রাণীদের চেয়ে বেশি হলেও বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, সামগ্রিকভাবে তাদের ভাষা একটি দুই বছরের মনুষ্য শিশুর ভাষার চেয়ে উন্নত নয়। শিশুদের ভাষা অর্জনের পদ্ধতি বিশ্বজনীন ব্যাকরণের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয়। শিশুদের জোর করে ভাষা শেখানো লাগে না। যে কোন মানব ভাষার উন্মুক্ত সংস্পর্শে আসলেই শিশুরা দ্রুত তা শিখে ফেলতে পারে। শিশুরা কতগুলো নির্দিষ্ট ধাপে ভাষা শেখে। খুব কম বয়সেই ভাষা অর্জনের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়। চার বা পাঁচ বছর বয়সের মধ্যেই শিশুরা ভাষার সম্পূর্ণ ব্যাকরণ (এখানে ব্যাকরণ বলতে স্কুলপাঠ্য ব্যাকরণ বই নয়, ভাষার বাক্য গঠনের অন্তর্নিহিত মানসিক নিয়মগুলো বোঝানো হয়েছে) আয়ত্ত করে ফেলে। এ থেকে বোঝা যায় যে, শিশুরা বংশগতভাবেই ভাষা অর্জন ও ব্যবহারের ক্ষমতা নিয়মে জন্মায় এবং এই ক্ষমতা বিশ্বজনীন ব্যাকরণের অংশ। বধির শিশুরা প্রতীকী ভাষা শেখার ক্ষেত্রেও অনুরূপ দক্ষতা দেখায়। অর্থাৎ ভাষা অর্জনের ক্ষেত্রে ধ্বনি শোনা বা উৎপাদন করা পূর্বশর্ত নয়। প্রতীকী ভাষাগুলো দৃষ্টি ও ইঙ্গিতভিত্তিক হলেও এগুলো কথ্য ভাষাগুলোর চেয়ে কোন অংশে অনুন্নত বা গাঠনিক দিক থেকে কম জটিল নয়। যদি ভাষাকে কেবল যোগাযোগের উপায় হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তবে এটি মানুষের জন্য সীমাবদ্ধ একটি বৈশিষ্ট্য নয়। কিন্তু মানুষের ভাষার এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য প্রাণীদের যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলোতে দেখা যায় না। মানুষের ভাষার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো তার সৃষ্টিশীলতা-প্রাথমিক ভাষিক এককগুলোকে সংযুক্ত করে অসীম সংখ্যক বৈধ বাক্য সৃষ্টির ক্ষমতা, যে বাক্যগুলোর অনেকগুলোই হয়ত আজও কেউ বলেনি বা শোনেনি। ভাষা বিজ্ঞানীরা ভাষা সম্পর্কে গবেষণা করে অনেক সত্য বের করেছেন, যেগুলো সব ভাষার জন্য প্রযোজ্য: যেখানেই মানুষ আছে, সেখানেই ভাষা আছে। আদিম ভাষা বলে কিছু নেই। সব মনুষ্য ভাষাই সমান জটিল এবং মহাবিশ্বের যে কোন ধারণা প্রকাশে সমভাবে সক্ষম। যে কোন ভাষার শব্দভা-ারকে নতুন ধারণা প্রকাশের সুবিধার্থে নতুন শব্দ গ্রহণ করে সমৃদ্ধ করা যায়। সব ভাষাই সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। কথ্য ভাষাগুলোর ধ্বনি ও অর্থের মধ্যে সম্পর্ক এবং প্রতীকী ভাষাগুলোর ইঙ্গিত ও অর্থের মধ্যে সম্পর্ক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাদৃচ্ছিক। সব মনুষ্য ভাষাতেই কতগুলো সসীম সংখ্যক ধ্বনি বা ইঙ্গিত থাকে যেগুলো জোড়া লাগিয়ে অর্থপূর্ণ একক বা শব্দ তৈরি করা হয় এবং এই শব্দগুলোকে আবার জোড়া লাগিয়ে অসীম সংখ্যক সম্ভাব্য বাক্য তৈরি করা যায়। সব ভাষার শব্দ ও বাক্যগঠনের সূত্রগুলো প্রায় একই ধরনের। প্রতিটি কথ্য ভাষার বিচ্ছিন্ন ধ্বনি-একক আছে, যেগুলোকে কতগুলো ধ্বনিবৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা যায়। প্রতিটি কথ্য ভাষায় স্বরধ্বনি ও ব্যঞ্জনধ্বনি আছে। সব ভাষাতেই ব্যাকরণিক ক্যাটাগরি বিশেষ্য, ক্রিয়া ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। সব ভাষাতেই পুং বা স্ত্রী, মানুষ, জীবিত ইত্যাদি বিশ্বজনীন আর্থিক বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়। সব ভাষাতেই না-বাচকতা, প্রশ্নবোধক, আদেশ দেয়া, অতীত বা ভবিষ্যত নির্দেশ করা ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে। মানুষের ভাষায় ভাষায় যে পার্থক্য তার কোন জৈবিক কারণ নেই। যে কোন সুস্থ-স্বাভাবিক মানব শিশু পৃথিবীর যে কোন ভৌগোলিক, সামাজিক, জাতিগত বা অর্থনৈতিক পরিবেশে যে কোন ভাষা শিখতে সক্ষম। মানুষের মুখের ভাষা অনেকগুলো ধ্বনি নিয়ে গঠিত। এই ধ্বনিগুলোর নিজস্ব কোন অর্থ নেই। যেমন- ক্, অ, প্, আ, ল্... এই ধ্বনিগুলো উচ্চারণ করলে কোন কিছু বোঝা যায় না। কিন্তু ধ্বনিগুলো একত্রে যখন ‘কপাল’ শব্দ হিসেবে উচ্চারণ করা হয়, তখন একজন বাংলাভাষী লোক এদের মধ্যে অর্থ খুঁজে পান। ভাষার আরেকটি বৈশিষ্ট্য এর জটিল আন্বয়ক বা বাক্যিক ব্যবস্থা, যার নিয়মগুলো ভাষার শব্দগুলো কোন্টির পর কোন্টি কী ক্রমে বসে বিভিন্ন পদগুচ্ছ, খ-বাক্য ও বাক্য গঠন করবে, তার দিক নির্দেশ দেয়। ভাষা অর্জন বলতে সেই প্রক্রিয়াকে বোঝায় যার মাধ্যমে শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা এক বা একাধিক ভাষা শিখে থাকে। এটি ভাষা বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাক্ষেত্র। মাতৃভাষা অর্জন একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং ভাষাবিজ্ঞানী এর প্রকৃতি সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি জানতে পারেননি। ছোট শিশুদের মধ্যে প্রবৃত্তিগতভাবেই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, যা তাদের শিশু বয়সেই মাতৃভাষা অর্জনের উপযোগী করে তোলে। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে আছে বাগনালীর গঠন, যার মাধ্যমে শিশু তার মাতৃভাষার বিভিন্ন শব্দ উৎপাদন করে। এছাড়া শিশুদের সাধারণ ব্যাকরণিক মূলনীতিগুলো এবং বাক্যগঠনের স্তরগুলো বোঝার ক্ষমতা থাকে। শিশুরা কোন নির্দিষ্ট ভাষা শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয় না। বরং যে ভাষা তাদের আশপাশে বলা হয়, তারা সেই ভাষাই শিখে ফেলে, এমনকি যদি তাদের পিতা-মাতা অন্য কোন ভাষাতে কথা বলে, তা হলেও। প্রাথমিক ভাষা অর্জনের একটি কৌতূহলোদ্দীপক বৈশিষ্ট্য হলো শিশুরা প্রথম প্রথম বাক্যের গঠনের চেয়ে অর্থের ওপর বেশি জোর দেয়। যেই পর্যায়ে তারা সচেতনভাবে সুসংগঠিত বাক্য বলতে শুরু করে, সেই পর্যায়েই মনুষ্য শিশুরা ভাষিক দক্ষতায় পশু-পাখি-মাছ জাতীয় প্রাণীদের ছাড়িয়ে যায়। যদিও দ্বিতীয় ভাষা অর্জন বলতে আক্ষরিকভাবে মাতৃভাষা অর্জনের পরে অপর একটি ভাষা অর্জনকে বোঝায়, প্রায়শই এই পরিভাষাটি দিয়ে বয়ঃসন্ধিকালের পরে দ্বিতীয় একটি ভাষা অর্জনের ঘটনাকে বোঝানো হয়ে থাকে। শিশুরা একাধিক ভাষা অর্জনে তেমন কোন কষ্টের সম্মুখীন হয় না। কিন্তু বয়ঃসন্ধির পরে দ্বিতীয় কোন ভাষা শিখতে মানুষকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয় এবং প্রায়শই সেই ভাষাতে সে উচ্চস্তরের দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। মানুষ যদি দ্বিতীয় ভাষাটি বক্তা সম্প্রদায়ে ও তাদের সংস্কৃতিতে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়, তবেই সে ভাষাটি সবচেয়ে সফলভাবে আয়ত্তে আনতে পারে। এছাড়া যেসব সংস্কৃতিতে দ্বিতীয় ভাষা শেখার ওপর জোর দেয়া হয়, সেখানেও দ্বিতীয় ভাষা অর্জন সহজ হয়। উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকান বহু দেশে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ফরাসী ভাষা অর্জনের ঘটনাকে উল্লেখ করা যায়। দ্বিভাষিকতা বলতে দুইটি ভাষা দক্ষভাবে প্রয়োগের ক্ষমতা এবং বহুভাষিকতা বলতে দুইয়ের বেশি ভাষার দক্ষ প্রয়োগের ক্ষমতাকে বোঝায়। বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলেই দ্বিভাষিকতা প্রচলিত। দ্বিভাষী বা বহুভাষী মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ভাষার দক্ষতার তারতম্য পরিলক্ষিত হয় : কেউ হয়ত একটি ভাষায় ভাল লিখতে এবং অপরটিতে ভাল বলতে পারেন ইত্যাদি। সভ্যতার আলো যত প্রসারিত হচ্ছে ভাষা এবং উপজাতীয় জনগোষ্ঠীগুলো ততই আধুনিকতার ছোঁয়া পাচ্ছে। জীবিকা বা কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে শহরে ভিড় করছে নানা জাতিগোষ্ঠী বা উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর লোকেরা। যাদের মাতৃভাষা লোপ পাচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে যাযাবর জনগোষ্ঠী এবং পাহাড় বা বনাঞ্চল থেকে শহরে চলে যাওয়া উপজাতীয় নৃগোষ্ঠীর মানুষ। যাযাবররা তাদের জীবনপদ্ধতি ত্যাগ করে শহরে আশ্রয় নিয়ে শহরের মূল ধারা থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার আশঙ্কায় তাদের নিজস্ব সামাজিক আচার ও সংস্কৃতি এবং ভাষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তারপরেও অযাযাবর গোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ করে যারা তাদের মাতৃভূমিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভোগ করছে তারা ব্যতিক্রম ধারায় পড়ে। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা হারিয়ে যাওয়ার বিভিন্ন কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে তারা শিক্ষা গ্রহণের জন্য মাধ্যম হিসেবে নিজের মাতৃভাষা পাচ্ছে না। যে দেশে তারা বসবাস করে সে দেশের মূল বা প্রধান অথবা দ্বিতীয় ভাষায় লেখাপড়া করতে হয়। এভাবে একটি প্রজন্ম শিক্ষিত হয়ে শহরে চলে যাচ্ছে। সেখানে তারা মূল ধারার সঙ্গে মিশে ক্রমান্বয়ে মাতৃভাষা ভুলে যাচ্ছে। অর্থাৎ তার চর্চা না থাকায় ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আবার উপজাতীয় জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে শিক্ষিত হয়ে তাদের কৃষ্টি-কালচার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম মূল ধারার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীও হ্রাস পাচ্ছে। বাংলাদেশের অনেক উপজাতীয় জনগোষ্ঠী লোপ পেয়েছে এবং পাচ্ছে। উন্নত দেশসমূহে বিশেষ করে ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকার বহু উপজাতীয় জনগোষ্ঠী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরবের যাযাবর গোষ্ঠীদেরও আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর তারা তাঁবুতে বসবাস করে না। একইভাবে আফ্রিকা এবং এশিয়া মহাদেশের বহু উপজাতীয় জনগণ এখন শহরে চলে যাচ্ছে জীবিকার প্রয়োজনে। ভাষা টিকে থাকে দলিল বা লিখিত কোন কিছুর মধ্যে। তবে সেটার চর্চাও থাকতে হবে। আন্দামান-নিকোবার দ্বীপের ‘জারোয়া’ এবং আমাজানের ‘আওয়া’ উপজাতি লুপ্ত হতে বসেছে। বিশ্বে এখন এমন কিছু উপজাতীয় মানুষ আছে তাদের সংখ্যা মাত্র ১০ জন। আবার ভাষাভাষীর সংখ্যাও তেমনই। আমরা এমন একটি জাতি যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। তবে এটাও ঠিক বাংলা ভাষায় কথা বলে প্রায় ২৭ কোটি মানুষ। সংখ্যাটিও ভাষা টিকে থাকার জন্য সহায়ক। আমাদের বহু আত্মীয়স্বজন বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গেছে। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বাংলা বলতে বা পড়তে পারে না। এভাবেই তো ভাষা বিলুপ্ত হয়। আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ (সাহিত্য, সঙ্গীতসহ যাবতীয় শিল্পকলা) এবং বিশ্বের মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করে আছে। তাই আমরা ভরসা করে বলতে পারি বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হবে না। আমাদের ভাষাকে আরও যতেœর সঙ্গে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে হবে। বিজ্ঞান চর্চা করতে হবে আমাদের মাতৃভাষায়। এতে ভাষার স্থান মজবুত হবে। কেউ সহজে ধাক্কা দিয়ে বাংলা ভাষাকে সরাতে পারবে না। আমরা ছোট সময়ে আমাদের প্রতিবেশী মুচি, ডোম, মেথর, বেহারা, বেদে ইত্যাদি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষকে নিজেদের মধ্যে তাদের ভাষায় কথা বলতে শুনেছি বা দেখেছি। এখনও তাদের পরবর্তী বংশধরদের অনেকে আছে, তাদের আর পূর্ব পূরুষের ভাষা বা মাতৃভাষা বলতে শুনি না। তারা এখন শিক্ষিত হয়ে মূল ধারার সঙ্গে মিশে গেছে। এভাবেই ভাষা বিলুপ্ত হচ্ছে। সেইসঙ্গে বিলুপ্ত হচ্ছে উপজাতি জনগোষ্ঠী। ভাষা ও উপজাতীয়দের রক্ষার জন্য কোন সুনির্দিষ্ট টেকসই পরিকল্পনা জাতিসংঘের আছে কি না আমার জানা নেই। সেটা থাকা আবশ্যক মনে করি। [email protected]
×