ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

আগামী বছর জ্বালানি খাতে যোগ হচ্ছে এলএনজি

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

আগামী বছর জ্বালানি খাতে যোগ হচ্ছে এলএনজি

রশিদ মামুন ॥ কাতারের রাস গ্যাসের কাছ থেকে সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়ায় তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে সরকার। কাতারের সরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই গ্যাস কেনা হবে। গত সপ্তাহে জ্বালানি বিভাগ থেকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয়া হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, এলএনজি আমদানির জন্য ২০১১ সালে কাতার সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। ওই সময়েই কাতার বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এলএনজি সরবরাহ করতে সম্মত হয়। প্রতিদিন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে এলএনজি সরবরাহ করার বিষয়ে দেশটির জ্বালানি মন্ত্রণালয় সরকারকে আশ্বাস দেয়। কিন্তু দেশে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে অনাকাক্সিক্ষত দেরির কারণে এলএনজি আমদানিতে পিছিয়ে পড়ে পেট্রোবাংলা। আগামী বছর মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের জ্বালানিখাতে এলএনজি যোগ হচ্ছে। মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি মহেশখালিতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ এলএনজি ক্রয় করে আনবে। এক্সিলারেট এনার্জি এলএনজিকে পুনরায় গ্যাসের রূপান্তর করে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করবে। এক্ষেত্রে রিগ্যাসিফিকেশন চার্জ পাবে এক্সিলারেট। জ্বালানি বিভাগের উপ-সচিব জনেন্দ্র নাথ সরকার স্বাক্ষরিত গত ৯ ফেব্রুয়ারির চিঠিতে বলা হয় সরকার জি টু জি ভিত্তিতে কাতারের রাস গ্যাসের কাছ থেকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এলএনজি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ অবস্থায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণের জন্য পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করা হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু না হয় ততদিন নিয়মিত প্রতিমাসে জ্বালানি বিভাগে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানায়, ধারণা করা হচ্ছে বছরে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিকটন এলএনজি আমদানি করা হবে। যার আনুমানিক মূল্য হতে পারে ২২৮ কোটি ডলার বা ১৮ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিদিন ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটের গ্যাস ঘাটতি রয়েছে। দেশের দ্বৈত জ্বালানির অধিকাংশ বিদ্যুত কেন্দ্রে এখন গ্যাস সরবরাহ করা হয় না। সার উৎপাদনেও গ্যাসের ঘাটতি রয়েছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য এলএনজি আমদানির কোন বিকল্প নেই। গ্যাস সংকটের কারণে বর্তমানে আবাসিকে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। শিল্প খাতেও নতুন সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। বহু উদ্যোক্তা কারখানা স্থাপন করে গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদনে যেতে পারছেন না। আবার অনেক উদ্যোক্তা গ্যাস সংকটের কারণে বিনিয়োগেই আসছেন না। বলা হচ্ছে, দেশে গ্যাসের বর্তমান মজুদের মাত্র আট টিসিএফ অবশিষ্ট রয়েছে। দেশের মোট প্রমাণিত মজুদ ২০ টিসিএফ এরমধ্যে ১২ টিসিএফ এরমধ্যে উত্তোলন করা হয়ে গেছে। দেশের জ্বালানি পরিস্থিতিতে যা বড় শঙ্কার কারণ। সরকার বলছে ২০৩০ সালেই বর্তমান মজুদ শেষ হয়ে যাবে। পেট্রোবাংলা বলছে, নতুন ক্ষেত্র না পেলে আর আগামী বছর শেষের দিকে গ্যাসের দৈনিক উৎপাদন কমতে শুরু করবে। বিকল্প ব্যবস্থা না করলে ২০২০-২০২২ সালের দিকে সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। গত কয়েক বছরে দেশের স্থলভাগে বড় কোন মজুদের খবর দিতে পারেনি পেট্রোবাংলা। আর বাইরে বাপেক্স যে দ্বিতীয় মাত্রার জরিপ পরিচালনা করছে সেখানেও বড় কোন সুখবরের কথা কেউ বলছেন না। কেবল মাত্র ভোলার পুরাতন গ্যাস ক্ষেত্রর মজুদ আগের ধারণার চেয়ে বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই দাবিও কতটা যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অতীতে কূপ খননের আগে আগাম গ্যাস আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়ে বিপাকে পড়েছে বাপেক্স। শুধু নতুন গ্যাস ক্ষেত্রেই নয় পুরাতন গ্যাস ক্ষেত্রেও বাপেক্সের জরিপ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়ায় বঙ্গোপসাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। কয়েক দফা দরপত্র ডেকেও যথেষ্ট সাড়া পায়নি পেট্রোবাংলা। উপরন্তু মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপস দ্বিতীয় মাত্রার ভূকম্পন জরিপের পর দুটি ব্লক ফেলে চলে গেছে। ওই জরিপেও গ্যাস পাওয়ার ২০ ভাগ সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছিল। অপর দিকে জরিপের ফলাফলে গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনার ৮০ ভাগই ঋণাত্মক বলে উল্লেখ করা হয়। এ ধরনের ঝুঁকি পূর্ণ (হাইরিস্ক) জোনে কোন কোম্পানি বিনিয়োগ করে না। পেট্রোবাংলা কনোকো ফিলিসের সঙ্গে বিনিয়োগ করতে চেয়েও পিছিয়ে আসে ওই সময়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সাগরে-তেল অনুসন্ধান ব্যয়বহুল বিষয়। সারাবিশ্বে তেলের দাম কমে যাওয়ায় এলএনজি এবং কয়লার দামও কমে গেছে। এতে করে কোন কারণে বহুজাতিক কোম্পানি বঙ্গোপসাগরে তেল গ্যাস না পেলে অন্য কোন যায়গার বিনিয়োগ থেকে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে না। ফলে তেল এবং গ্যাসখাতে বিশ্বজুড়েই এক ধরনের বিনিয়োগ মন্দা চলছে। সঙ্গত কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। উৎপাদন-অংশীদারিত্ব চুক্তিতে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করার পরও বড় কোম্পানিগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। দেশে বিদ্যুত উৎপাদনের প্রধান জ্বালানি প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। বিগত ২০১৩-১৪ অর্থবছরে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৭২ দশমিক ৪২ শতাংশ। সেখানে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮ দশমিক ৪০ শতাংশে। দেখা যায় ২০০৯ সালে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুত উৎপাদন হতো ৮৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এভাবে গ্যাসের সংস্থান কমে যাওয়ায় পর্যায়ক্রমে বিদ্যুত উৎপাদনে গ্যাসের ব্যবহার কমছে। এই অবস্থায় এলএনজি আমদানির উদ্যোগকে জোরালো করা হচ্ছে। বেসরকারী খাতে এখন পর্যন্ত ৫টি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়াও আরও কয়েকটি কোম্পানি এলএনজি টার্মিনাল করার জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেবলমাত্র রাস গ্যাসের সঙ্গে এলএনজি ক্রয়ের চুক্তি করতে যাচ্ছে সরকার।
×