ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজীব হত্যার মূল আসামি রানা শিবির ক্যাডার

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

রাজীব হত্যার মূল আসামি রানা শিবির ক্যাডার

গাফফার খান চৌধুরী ॥ ব্লগার প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যায় ফাঁসির দ-প্রাপ্ত শীর্ষ জঙ্গী রেদোয়ানুল আজাদ রানা ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। পরবর্তীতে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্্রীরের মাধ্যমে আরেক নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমে যোগ দেয়। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক হওয়ায় রোষানলে পড়ে রাজীব। এজন্য জঙ্গীরা রাজীবকে হত্যা করে। শুধু রাজীব নয়, এখন পর্যন্ত যারা জঙ্গীদের হাতে হতাহত হয়েছেন, তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। রানাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। জিজ্ঞাসাবাদকারী সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের পরিবর্তে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে গড়ে উঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। এ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক রাজীবকে (৩৭) ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর পল্লবী থানাধীন পলাশনগরের ৫৬/৩ নম্বর নিজ বাড়ির সামনেই জবাই করে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এ মামলায় ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক সাঈদ আহমেদ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রেদোয়ানুল আজাদ রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপকে মৃত্যুদ-, মাকসুর হাসান অনিককে যাবজ্জীবন, এহসান রেজা রুম্মান, নাঈম ইরাদ ও নাফিজ ইমতিয়াজকে ১০ বছর করে সশ্রম কারাদ-ে দ-িত করেন। একই সঙ্গে প্রত্যেককে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা এবং জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদ-ের আদেশ দেন। মামলার রায়ে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মাওলানা জসীমুদ্দিন রাহমানীকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা, জরিমানা অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদ- দেন। আর আসামি সাদমান ইয়াছির মাহমুদকে তিন বছরের সশ্রম কারাদ- ও দুই হাজার টাকা জরিমানা, জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাদ- দেন। আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, সোমবার আশরাফ নামের এক সহযোগীসহ গ্রেফতারকৃত ব্লগার রাজীব হত্যা মামলায় মৃতুদ-প্রাপ্ত আসামি রানাকে ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের করা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। মঙ্গলবারই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক মোহাম্মদ মুনিরুল ইসলাম এ মামলায় দুই আসামিকে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন। ঢাকার সিএমএম আদালতের বিচারক মাজহারুল ইসলাম শুনানি শেষে আসামিদের পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, রানা ভুয়া নাম ঠিকানা ব্যবহার করে রাজীব হত্যার পর পরই মালয়েশিয়ায় পালিয়ে ছিল। সেখানে প্রায় তিন বছর ছিল। সেখানেও জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটানোর জন্য কাজ করেছে। নিয়মিত জঙ্গী তৎপরতা চালাত সেখানে। সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় জঙ্গী তৎপরতা চালাতে গিয়ে গ্রেফতার হয় রানা। এরপর সে দেশের সরকার তাকে দেশে ফেরত পাঠায়। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর রানা আইএসে যোগ দিতে সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরে জঙ্গী প্রশিক্ষণ নিতে ফিলিপিন্সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতির সময় মালয়েশিয়ায় গোয়েন্দাদের হাতে গ্রেফতার হয়। রানা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়ে কয়েকটি সেল গঠন করে দেশে জঙ্গী কার্যক্রম শুরু করেছিল। রানার গঠিত একটি সেলই গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক রাজীব হায়দারকে হত্যা করে। অন্য আরেকটি সেল ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে হত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। মহিউদ্দিন হত্যাচেষ্টা মামলায়ও রানা অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি। ২০১৩ সালের শেষ দিকে রানার গঠিত সেলে দুইজন মিরপুরের একটি স্কুলের একজন সহকারী প্রধান শিক্ষককে হত্যার জন্য যাওয়ার সময় পুলিশের হাতে একজন গ্রেফতার হয়। গ্রেফতারকৃত জঙ্গী জিজ্ঞাসাবাদে রানার ছবি দেখে বলেছিল, তাদের দুইজনকে রানাই হামলার জন্য প্রস্তুত করেছিল। রাজীব হত্যার পর রানা ২০১৪ সালের শুরুর দিকে ছাত্র ভিসায় মালয়েশিয়ায় যায়। তার বাড়ি ফেনীতে হলেও গাজীপুরের মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট তৈরি করে। তবে সেখানে নিজের নাম, বাবা-মা ও জন্ম তারিখ ঠিক রাখে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে মালয়েশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। সম্প্রতি মালয়েশিয়ার গোয়েন্দারা তাকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠালে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। মালয়েশিয়ায় রানা পলাতক জঙ্গী জুন্নুন শিকদারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে। জুন্নুন শিকদার বর্তমানে সিরিয়ায় রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জুন্ননও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। জুন্নুন ২০১৪ সালে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান রাহমানীর সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছিল। জামিনে ছাড়া পেয়ে ২০১৫ সালের শেষ দিকে দেশ ছাড়ে। গুলশানের জঙ্গী হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে নিখোঁজ ১০ যুবকের প্রথম তালিকা দেয়া হয়, সেখানেও জুন্নুনের নাম রয়েছে। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, ফাবারী ও রানার ব্যক্তিগত যোগাযোগ কলেজ থেকেই। ফারাবী ও রানা দুজনই নটর ডেম কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের সমসাময়িক বর্ষের ছাত্র ছিল। দু’জন কলেজ জীবনেই শিবিরের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিল। তবে কলেজের পারিপার্শ্বিক কারণে প্রকাশ্যে শিবিরের রাজনীতি করার কোন সুযোগ ছিল না। একই আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়ার সূত্র ধরেই তাদের মধ্যে পরিচয়। সেই পরিচয় তাদের এখনও রয়েছে। দু’জনই দু’জন সম্পর্কে ভালভাবে জানে। এরপর কলেজের গ-ি পেরিয়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেই শিবিরের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে তারা দলীয় নির্দেশে প্রথমে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন হিযবুত তাহ্রীর এবং পরে আরেক নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
×