ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

হাওড় ও উপকূলে কৃষি যন্ত্রপাতি ৭০ শতাংশ ভর্তুকি সরকারের

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

হাওড় ও উপকূলে কৃষি যন্ত্রপাতি ৭০ শতাংশ ভর্তুকি সরকারের

এমদাদুল হক তুহিন ॥ কৃষি যান্ত্রিকীকরণকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে দেশের হাওড় ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার কৃষককে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৭০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তা (ভর্তুকি) দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ফলে এখন থেকে হাওড় এলাকার ১০ জেলার ৩৪ উপজেলার ৩৪৭ ইউনিয়নের কৃষক কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের মাত্র ৩০ শতাংশ পরিশোধ করেই নির্দিষ্ট কিছু কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে পারবেন। একইভাবে কোম্পানি কর্তৃক নির্ধারিত মূল্যের মাত্র ৩০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করেই কৃষি যন্ত্র ক্রয়ের সুযোগ পাবেন দক্ষিণাঞ্চলের ১২ জেলার ৪০ উপজেলার ৪১৭টি ইউনিয়নের কৃষকরা। অর্থাৎ হাওড় ও দক্ষিণাঞ্চলের কৃষকরা এখন থেকে ১ লাখ টাকা মূল্যের কৃষি যন্ত্র ক্রয় করতে পারবেন মাত্র ৩০ হাজার টাকায়! অন্যদিকে হাওড় ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা বাদে সারাদেশের কৃষক এখন থেকে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে উন্নয়ন সহায়তা পাবেন ৫০ শতাংশ। সম্প্রতি একনেক সভায় এ সংক্রান্ত অনুমোদনের পর পাওয়া গেছে প্রশাসনিক অনুমোদও। এরপরই কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে দেশের প্রতিটি কৃষি অফিসকে এ সংক্রান্ত নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কর্মকর্তাদের ভাষ্য, কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে সরকারের দেয়া এ উন্নয়ন সহায়তার ফলে দেশে দ্রুত সময়ে যান্ত্রিকীকরণের প্রসার ঘটবে। একই সঙ্গে ফসল উৎপাদনে কমবে ব্যয়। বাঁচবে সময়। ফসলের উপযুক্ত দাম পেয়ে কৃষকের মুখে দেখা দেবে সোনালী হাসিও। কৃষি সম্প্রসারণের উর্ধতন কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারের এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জোরদার হয়েছে কঠোর নজরদারিও। এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মহাপরিচালক কৃষিবিদ মোঃ মনজুরুল হান্নান জনকণ্ঠকে বলেন, দেশের কৃষি এখন বাণিজ্যিকীকরণের দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিতে প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে শ্রমিক সঙ্কট। সঠিক সময়ে শ্রমিক না পাওয়ায় ফসল উৎপাদনেব বিরূপ প্রভাব পড়ছে। একটা ফসল কাটতে ৭ দিন বিলম্ব হলে কৃষক মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এটা প্রতি মৌসুমেই ঘটছে। এছাড়া আকস্মিক ঝড় ঝঞ্জাত রয়েছেই। কেবল হাওড় অঞ্চলে একদিনের বন্যায় মাঠের পর মাঠের ফসল তলিয়ে যাচ্ছে। যদি যান্ত্রিকীকরণ হয় তবে ওইসব মাঠের ফসল পূর্বাভাস পাওয়া মাত্রই কেটে ফেলা সম্ভব। ফলে যেসব অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য ঝঁকিপূর্ণÑ যেমন হাওড় ও দক্ষিণাঞ্চল; সেইসব এলাকায় কৃষককে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৭০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তিনি বলেন, এছাড়া অন্যান্য অঞ্চলে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে উন্নয়ন সহায়তা ৫০ শতাংশ। মূলত যন্ত্র ব্যবহারে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতেই সরকারের এই উদ্যোগ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, হাওড় ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার কৃষি বহুলাংশেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রভাবিত। হাওড় অঞ্চলে আকস্মিক বন্যার ফলে প্রতিবছরই তলিয়ে যাচ্ছে মাঠের পর মাঠ। এতে বছরে প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন ধানের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিতে প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে শ্রমিক সঙ্কট। একই সঙ্গে প্রচলিত পদ্ধতিতে চাষাবাদে ব্যয় বাড়ছে কৃষকের। এতে প্রতি মৌসুম শেষেই কৃষকের চোখেমুখে দেখা দিচ্ছে হাহাকার! কৃষিবিদরা মনে করেন কেবল যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমেই এ অবস্থার উত্তরণ ঘটতে পারে। ফলে সম্প্রতি হাওড় ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে উন্নয়ন সহায়তা ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭০ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ১ লাখ টাকার যন্ত্র ক্রয়ে ওই এলাকার কৃষককে ব্যয় করতে হবে মাত্র ৩০ হাজার টাকা। অন্যদিকে সারাদেশের কৃষক কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে উন্নয়ন সহায়তা পাবে ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ সারাদেশের কৃষক এখন থেকে কোম্পানির নির্ধারিত অর্ধেক মূল্যে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয় করতে পারবেন। জানা গেছে, উন্নয়ন সহায়তায় পাওয়া যন্ত্রগুলো হলোÑ রিপার (ধান ও গম), পাওয়ার থ্রেসার, কম্বাইন, হারভেস্টার, রাইস্ ট্রান্সপ্লান্টার, সিডার ও ফুট পাম্প। জানা গেছে, খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের (২য়) ডিপিপি মধ্য জানুয়ারিতে একনেক সভায় অনুমোদিত হয়। সম্প্রতি পাওয়া গেছে এ সংক্রান্ত প্রশাসনিক অনুমোদনও। এতে বলা হয়, ২য় সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী দেশের ৩০০টি উপজেলায় ১টি করে কৃষক গ্রুপের মাধ্যমে ভাড়ায় কৃষি যন্ত্র সেবা প্রদান কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। একই সঙ্গে আরও ১ বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি- ২য় পর্যায়ের প্রকল্পের। প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনও অনেকাংশে কৃষি উৎপাদনশীলতার ওপর নির্ভরশীল। বেশ কিছু ক্ষেত্রে কৃষি খাত যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলেও বাড়ছে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা। ক্রমবর্ধমান হারে কৃষি শ্রমিকের শহরমুখিতা, শ্রমিকের উচ্চমূল্য এবং সমাজে কৃষি কাজের নিম্ন মর্যাদার কারণে বাংলাদেশের কৃষি খাতে এখন তীব্র শ্রমিক সংকটের মুখোমুখি। বিশেষ করে রোপণ ও কর্তন এর ভরা মৌসুমে কৃষি শ্রমিকের অভাবে কৃষকগণ এক রকম অসহায় হয়ে পড়ে এবং উৎপাদন ব্যয়ও বেড়ে যায় উচ্চহারে। আবার উৎপাদিত ফসলের বিভিন্ন স্তরে অপচয় ও অদক্ষতার ফলে কৃষি কাজে লাভবান হচ্ছে না কৃষক। দেশের কৃষি খাতে যা বড় ধরনের নেতিবচক প্রভাব ফেলছে। সুতরাং কর্তন ও রোপণ কাজে দ্রুত যান্ত্রিকীকরণ এখন আবশ্যকীয় হয়ে পড়ছে। যান্ত্রিকীকরণের এরূপ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন সহায়তা প্রদানের হার ৩০ শতাংশ যথেষ্ট নয়।’ এতে আরও বলা হয়, ‘দেশের অন্যতম অরক্ষিত খাত হিসেবে স্বীকৃত হাওড় এলাকায় কৃষির উৎপাদনশীলতা সম্পূর্ণভাবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব তথা আকস্মিক বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, তাপমাত্রা, খেয়ালী বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল। বিচিত্ররূপে আকস্মিক বন্যা এখানে এখন নিয়মিত আকার ধারণ করছেÑ যা বাৎসরিক প্রায় দেড় লাখ মেট্রিক টন ধান ফসলের ক্ষতিসাধন করে আসছে। সুতরাং দ্রুত পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে সরকারীভাবে হাওড় এলাকায় রিপার, কম্বাইন হারভেস্টর, ট্রান্সপ্লান্টার, যন্ত্রের জরুরী সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে উন্নয়ন সহায়তার হার হাওর এলাকার জন্য ৭০ শতাংশ এবং দেশের অবশিষ্ট এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে।’ সামগ্রিক প্রসঙ্গে খামার যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি-২য় পর্যায়ের প্রকল্প পরিচালক শেখ মোঃ নাজিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য কৃষি যান্ত্রিকীকরণ। অবশ্য লাভজনক কারণে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ আবশ্যকও। উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনতে হলে যান্ত্রিকীকরণ করতে হবে। তাহলেই কৃষক তার পণ্যের উপযুক্ত দাম পাবে। তিনি বলেন, দেশে ফসলের কর্তন ও রোপণের সময় তীব্র শ্রমিক সঙ্কট তৈরি হয়। তাই যন্ত্র ক্রয়ে সরকারের পক্ষে এই সহয়তা। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে, দেশে দ্রুত যান্ত্রিকীকরণের প্রসার ঘটাতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রতি যেমন কড়া নির্দেশনা রয়েছে তেমনি রয়েছে কঠোর নজরদারিও।
×