ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

একান্ত সাক্ষাতকারে গাফ্ফার চৌধুরী

অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছাড়া বাংলাদেশে অন্য কিছু দাঁড়াবে না

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছাড়া বাংলাদেশে অন্য কিছু দাঁড়াবে না

মোরসালিন মিজান ॥ একুশে ফেব্রুয়ারির অমর গানের রচয়িতা প্রখ্যাত কলামিস্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেছেন, বাঙালীর ন্যাশনালিজম অসাম্প্রদায়িক। বাংলাদেশে অন্য কিছু কোনদিন দাঁড়াবে না। একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করেন তিনি। বলেন, প্রধানমন্ত্রী কোন কোন ক্ষেত্রে তার পিতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে বিএনপির তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। বাম দলগুলোর কোন কোন কর্মকা- নিয়ে অসন্তোষের কথা জানান। মিডিয়াতে একুশ ও একাত্তরের চেতনার বাস্তবায়ন ঘটানোর তাগিদ দেন বিশিষ্ট এই সাংবাদিক। দীর্ঘকাল ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশে আসেন তিনি। ধানম-িতে এক বন্ধুর বাসায় অবস্থানকালে জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা হয় তার। একান্ত সাক্ষাতকারের দ্বিতীয় পর্বে উঠে আসে বাংলাদেশের সমাজ রাজনীতি মৌলবাদ সাংবাদিকতাসহ নানা বিষয়। ফেলে আসা দিনের স্মৃতি অভিজ্ঞতা দর্শনের আলোকে বর্তমানকে বিশ্লেষণ করেন তিনি। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, বাঙালীর ন্যাশনালিজম অসাম্প্রদায়িক। ওইটিই দাঁড়াবে। অন্য কিছু এখানে দাঁড়াবে না। বিভিন্ন সময় বিপুল টাকা দিয়ে পয়সা দিয়ে চেষ্টা করা হয়েছে। সৌদি আরব থেকে টাকা এনে ঢালা হয়েছে। একটা অন্য ধরনের ইসলাম তৈরির চেষ্টা আমরা দেখেছি। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মভীরু। ধর্মান্ধ নয়। তাদের বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয়নি না। তা যদি হতো জামাতিরা ১৯৭১ সালে বিরাট ভোট পেত। সাত পার্সেন্ট ভোট নিয়ে বসে থাকতে হতো না। কিন্তু দেশে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা তো মাঝে মধ্যেই ঘটছে। জঙ্গী তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু থেমে নেই। হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার কথাই যদি ধরা যায়, এর কী ব্যাখ্যা? উত্তরে তিনি বলেন, এটা বোধহয় একটা গ্লোবাল ব্যাপার। আমেরিকায় ট্রাম্পের মতো ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হবে, কেউ ভেবেছিল? এখন সর্বত্রই একটা দক্ষিণপন্থী আবহাওয়ার প্রবল জোয়ার চলছে। আমরা যখন তরুণ ছিলাম, পঞ্চাশের বা ষাটের দশকে, তখন বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আবহাওয়ার প্রাধান্য ছিল। যারাই রাজনীতি করতেন একটা সমাজতান্ত্রিক ছাপ লাগাবার চেষ্টা করতেন। যারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতেন তারাও ইসলামিক সমাজতন্ত্র হিন্দু সমাজতন্ত্র এসব বলতেন। সেই যুগটা চলে গেছে। এখন একটা দক্ষিণ পন্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর প্রভাবে নানা ধরনের অশুভ শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটছে। এখন ইসলামের নামে আইএস হচ্ছে। খ্রিস্টানরা কট্টর পন্থা অবলম্বন করছে। কমিউনিজমের নামে মাফিয়াতন্ত্র হচ্ছে। তবে এ অবস্থা দীর্ঘকাল চলবে না বলে মনে করেন তিনি। বলেন, গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের যে দানব চেহারা সেটি পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। আরও ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে আমেরিকার বর্তমান বাহাদুরি থাকবে না। এবং তখন সমস্ত বিশ্বেই এর প্রভাব পরবে। বাংলাদেশে মৌলবাদীদের জঙ্গীবাদীদের যে আস্ফালন, সেটিকে টিকটিকির লেজ নাড়ানোর সঙ্গে তুলনা করেন তিনি। বলেন, মারা যাওয়ার আগে টিকটিকি এমন লেজ নাড়ে। মৌলবাদীরাও নাড়াচ্ছে। এরা বেশি দিন টিকবে না। এই তো কিছুদিন আগে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন হলো। তখন কত হুমকি-ধমকি। বিচার করলে আকাশ ফেটে যাবে। বিপ্লব হয়ে যাবে বাংলাদেশে। কী হলো শেষ পর্যন্ত? যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গ যেহেতু উঠলো, সেহেতু বলা, যে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তরে সেই দেশটির পক্ষ অবলম্বন করেছিল যুদ্ধাপরাধীরা। তাদের প্রধান অংশটির বিচার সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ। পুরো বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারটা এক সময় মনে হয়েছিল অসম্ভব ব্যাপার। কারণ, জামায়াত আর বিএনপি মিলে মানুষের মনে একটা মানসিক বলয় তৈরি করে দিয়েছিল। খালেদা জিয়া কাদের মোল্লা, সাঈদী, নিজামী, কামারুজ্জামানদের নাম ধরে বলেছিলেন এরা যুদ্ধাপরাধী না। আওয়ামী লীগ মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করছে। আমেরিকার মতো পরাশক্তি বিচারের বিরোধিতা করেছিল। সৌদি আরবসহ অন্যান্য দেশও কম চেষ্টা করেনি। এমনকি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটি শ্রেণী তৈরি হয়ে গিয়েছিল যারা যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থন দিয়ে গেছে। বিচার নিয়ে ডেভিড বার্গম্যানের অপপ্রচারের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই লোক তো ড. কামাল হোসেনের জামাতা। সে কীভাবে এই পরিবারে প্রবেশ করল? তবে আশার কথা যে, এ রকম নানা বিপত্তির মুখেও থেমে যাননি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার জীবনের ওপর বহু হামলা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হতে পারে। তবু রিস্ক নিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার করেছেন। পিতার সাহস কিছুটা পেয়েছেন শেখ হাসিনা। তাই কি? বাবার সাহসের পুরোটা পেয়েছেন, জবাব দেন বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যাকে খুব কাছ থেকে দেখা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বলেন, কোন কোন ক্ষেত্রে তো পিতাকে অতিক্রম করে গেছেন। উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এই যে সাকা চৌধুরী, তাকে ফাঁসি দিতে পারতেন বঙ্গবন্ধু? ইমপসিবল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সফট হার্টেড মানুষ। চাচা বলে পায়ে পড়লেই হয়ত ছেড়ে দিতেন। বহু লোককে দেখেছি, অন্যায় করে এসে পায়ে পড়েছে। ওমনি মাফ। কিন্তু শেখ হাসিনা ইজ এ ডিফারেন্ট ম্যাটারিয়াল। তিনি সেদিকে যাননি। এ কারণেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা গেছে। আলোচনায় ঘুরেফিরেই আসে যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে দেশের অন্যতম বড় দল বিএপির ভূমিকা। দলটির নেতৃত্বের সমালোচনা করে তিনি বলেন, একুশ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তাদের মধ্যে নেই। বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের শুধু সমর্থন দেয়া নয়, মন্ত্রী করেছে। ২১ বছর মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় ছিল। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় বেশকিছু বুদ্ধিজীবীকে এরা ক্রয় করেছে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছিল মিথ্যাকে সত্য করা। এত কিছুর পরও যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয় সেটি বন্ধে সন্ত্রাস করেছে তারা। ব্রিটেনের দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেন, যদি কেউ কোন দল ওখানকার ফ্যাসিস্ট ন্যাশনাল পার্টির সঙ্গে আঁতাত করত তাহলে ক্ষমতায় যাওয়া তো দূরের কথা উল্টো বিচার হতো তাদের। এখনও জার্মানিতে কেউ যদি ‘হায় হিটলার’ বলে তার জেল হয়। এখানে খালেদা জিয়া এবং তার পার্টি যে কাজ করেছেন, তার এবং তার পুত্রের বিচার হওয়া উচিত। দুর্নীতির মামলা নয়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হওয়া উচিত ছিল তাদের বিরুদ্ধে। এখনও চক্রান্ত হচ্ছেÑ নিজের এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সাঈদীকে যাবজ্জীবন দেয়াটা আমি মনে করি ভুল হয়েছে। তার ছেলে যে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছে এটারও বিহিত করা উচিত। লন্ডনে একজন মাত্র ন্যাশনাল ফ্রন্টের সদস্য এমপি হয়েছিল, সে পার্লামেন্টে ঢুকতে পারেনি। তারা একটা কাউন্সিলের মেম্বার হয়েছিল। সমস্ত কাউন্সিলের কর্মচারীরা তাকে বয়কট করে চলে গেছে। ব্রিটেন তো গণতন্ত্রের পাদপীঠ। কেউ বলেনি, তাতে করে গণতন্ত্র ব্যাহত হয়েছে। সরকারের উচিত যুদ্ধাপরাীদের পুত্র-কন্যাকে কোন জনপ্রতিষ্ঠানে প্রতিনিধিত্ব করতে না দেয়া। আলোচনার এ পর্যায়ে উঠে আসে বাংলাদেশের বাম রাজনীতি। দলগুলোর বিভিন্ন সময়ের ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। বলেন, এখন তো কোন বামপন্থী নেই। সুবিধাপন্থী আর অসুবিধা পন্থী আছে। আওয়ামী লীগে রাইটিস্ট মন্ত্রীদের যে আচার-আচরণ তার সঙ্গে বামদের কী কোন তফাৎ আছে? আওয়ামী লীগের সব কাজে বিরোধিতাকারী বামদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, এরা বালবিধবা। বালবিধবারা বেশি বেশি সাদা কাপড় পরে। আতব চাল খায়। এরা এককালে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত ছিল যে, গায়ের ময়লা দূর করার জন্য এখন বেশি বেশি বিরোধিতা করে। কোন দর্শন আছে বলে আমার মনে হয় না। এখন তারা শোষিত মানুষের পলিটিক্স করে না। ড্রইংরুম পলিটিক্স করে। আর কতগুলা তত্ত্ব কপচায়। অস্তিত্ব বলতে খবরের কাগজ। তারা কমিউনিস্ট থেকে কলামিস্ট হয়ে গেছে। আপনার নিজের সম্পর্কে কী বলবেন? সমালোচকরা কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে আওয়ামী লীগের দলীয় লোক বলতে চান। এই সমালোচনার কী জবাব দেবেন? উত্তরে গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, আমি আওয়ামী লীগ সমর্থন করি। কারণ, এর বিকল্প গত ৪০ বছরে দেখিনি। আওয়ামী লীগের যদি সুস্থ গণতান্ত্রিক বিকল্প থাকত, তার নেতা শেখ হাসিনার মতো না হন, তার অর্ধেক ছায়া নিয়েও দাঁড়াতেন, সমর্থন করা যেত। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনার সূত্রপাত করে তিনি বলেন, এক সময় আশা করা হয়েছিল রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে একটা বাম শক্তি দাঁড়াবে। উনি তো পারলেন না। আরেকবার মনে হয়েছিল, ড. কামালের নেতৃত্বে গণফোরাম দাঁড়াবে। পারলেন না। সবশেষে মনে হয়েছিল, গণজাগরণ মঞ্চটা বুঝি দাঁড়াবে। বিশাল একটা জোয়ারের মতো আসছিল। সেটাও মিলিয়ে গেল। এ জন্য আওয়ামী লীগকে বাধ্য হয়ে সমর্থন করতে হয়। আওয়ামী লীগের সমালোচনা করলে বেনিফিটটা পাবে বিএনপি-জামায়াত। আমার তাই অলটারনেটিভ খুব কম থাকে। তিনি প্রশ্ন ছুড়ে দেন, কাকে সমর্থন করব? ড. কামাল হোসেনকে? ডা. বদরুদ্দোজাকে? ড. ইউনূসকে? আ স ম আব্দুর রবকে? এরা কী? এরা তো বানের জল এখন। ফসিল। এদের সমর্থন করা যায়? এদের কী নীতি? এরা একবার এরশাদের মন্ত্রী হয়। একবার হাসিনার মন্ত্রী হয়। এদের কোন নীতিজ্ঞান আছে? একবার বামপন্থার কথা বলে। পরের বার মাথায় টুপি দিয়ে অন্য বেশ ধরে। কাদের সিদ্দিকী, বাঘা সিদ্দীকী মাথার কিস্তি টুপি গলায় গামছা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কাকে সমর্থন করব? কে কাকে সমর্থন করবে? তিনি বলেন, আমাকে জামায়াতের লোক বলা হয় না। সিআইয়ের লোক বলা হয় না। বলে আওয়ামী লীগের লোক। আওয়ামী লীগের তো বটেই। একসময় যারা বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু বলত না, তারা এখন আমার চেয়ে একশবার বঙ্গবন্ধু বলে। কোথায় রাশেদ খান মেনন? কোথায় হাসানুল হক ইনু? এরা তো আমার চাইতেও বড় আওয়ামী লীগার। দে আর মোর ক্যাথলিক দ্যন পোপ। বঙ্গবন্ধুকেই যারা স্বীকার করতেন না তারা এখন কথায় কথায় শেখ হাসিনাকে জননেত্রী বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন। আপনি আওয়ামী লীগ দলটিকে দীর্ঘকাল ধরে দেখছেন। প্রচুর লেখালেখি করেছেন। এই দল এখন সরকারে। তাদের ভূমিকা কেমন বলে মনে করেন? উত্তরে তিনি বলেন, সরকার ঠিক আছে। একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু দলটাকে খুব দুর্বল মনে হয়। উন্নত মানের বুদ্ধিজীবী খুব কম। শিক্ষিত লোকের প্রাধান্য চোখে পড়ে না। আওয়ামী লীগ গণপ্রতিষ্ঠান। শুনেছি, জামাতিরাও দলে ঢুকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দলটিকে নতুন করে গড়া গেলে ভাল হয়। অনেকে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আপনার পরামর্শ শোনেন। আসলে কতটা? এমন প্রশ্নে হেসে ফেলেন তিনি। বলেন, শেখ হাসিনা কারও কথা শোনেন না। অনেক ম্যাচিউর। এত সব চাপের পরও নিজের পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কীভাবে? আমি তার বাবার স্নেহভাজন ছিলাম। আমাকে চাচা বলে ডাকেন। শ্রদ্ধা করেন। এসব আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে বরং কিছু কথা শোনাতে পারতাম। শেখ হাসিনা পছন্দ হলে শোনে। না হলে বলে, আচ্ছা, চাচা দেখব। তিনি খুব সরল ভঙ্গিতেই বলেন, আমার তাতে খারাপ লাগে না। হাসিনা আমার লেখায় মাঝে মাঝে বিরক্ত হন। জানতে চান, কেন ওভাবে লিখলাম? আমি বলি, আমার লেখা আমি লিখি। আমি সাংবাদিক। আমাকে তো লিখতেই হবে। তোমার ভাল লাগলে শুনো। তা না হলে তুমি তোমার যেটা ভাল মনে করো, করো। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। আমি বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করতাম। তিনি আমাকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। এরপরও তার কোন কাজ বা সিদ্ধান্ত ভুল মনে হলে, বলতাম। এই যেমন যখন বাকশাল করা হয় আমি বলেছি, ওটা করার সময় হয়নি। ইসলামিক কনফারেন্সে যাচ্ছিলেন, বিরোধিতা করেছি। বলেছি, ওটা যাওয়ার সময় নয়। ভুট্টোকে বাংলাদেশে আনারও বিরোধিতা করেছি। তিনি রাগ করতেন না। হাসিনার বেলায়ও বলি। তিনি হেফাজতের সঙ্গে আপোস করেছেন, আমি মনে করি, এটা কৌশলগত সঠিক হতে পারে। আদর্শগতভাবে বড় ধরনের ভ্রষ্টতা। আলোচনার শেষ অংশে আসে সাংবাদিকতার প্রসঙ্গ। বর্তমান সাংবাদিকতায় একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আদর্শ কতখানি আছে? জানতে চাইলে খ্যাতিমান সাংবাদিক স্মৃতি হাতড়ে বলেন, আমাদের সময় সাংবাদিকতা ছিল আদর্শ ভিত্তিক। আজাদ মুসলিম লীগের। ইত্তেফাক আওয়ামী লীগের। অবজারভার কৃষক শ্রমিক লীগের। নাজাত নেজামী ইসলামের। জাহানে নও কাগজ ছিল জামায়াতে ইসলামীর। এখন সংবাদপত্র বা মিডিয়া আদর্শ ভিত্তিক নয়। সবই বাণিজ্যিক। আগে ছিল ব্যবসা। এখন ইন্ডাস্ট্রি। প্রচুর ইনভেস্টম্যান্ট লাগে। বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার মান খুবই বেড়েছে এমন মন্তব্য করলেও তিনি বলেন, সমস্যা একটাই। বেশি কমার্শিয়াল হয়ে গেছে। যার ফলে আদর্শ পেছনে পরে গেছে। এখন তথাকথিত নিরপেক্ষতার নামে সাংবাদিকতার সত্যিকার নিরপেক্ষ অবস্থান ধ্বংস করা হচ্ছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করাটাকেও কেউ কেউ নিরপেক্ষতার মুখোশ পরিয়ে দিয়েছে। এখানে দেশবিরোধী অপশক্তিকেও প্রশ্রয় দেয়া হয়। বিএনপি-জামায়াতের যে বিধ্বংসী অবস্থান, তার সঙ্গেও নিরপেক্ষতা করাটা নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা নয়। প্রগতিশীল সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে জনকণ্ঠ এখনও অটল আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে এত বেশি টিভি, বিদেশেও হয়েছে। ভাল দিক হলো, মানুষকে তথ্য জানানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু কুফলটাই বেশি দেখছি। নতুন প্রজন্মকে এমন সব খেলায় এডিকটেড করে ফেলছে যে, তাদের দেশপ্রেম ও জ্ঞান আহরণে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। টকশোর নামে যেগুলো হয় সেগুলো কনস্ট্রাকটিভ না। একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবীকে ভাড়া করে যেসব কথা বলানো হয় তাতে দেশের সমস্যা সমাধান করে না। টেলিভিশনগুলোকে সরকার নিয়ন্ত্রণে রাখুক আমি চাই না। টেলিভিশনের লোকেরাই উচিত আত্মসংযম ও আত্ম সংশোধনের মাধ্যমে প্রকৃত টেলি সাংবাদিকতাকে দেশে প্রসারিত করার আহ্বান জানান প্রবীণ সাংবাদিক।
×