ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী

ইংরেজী উচ্চারণে বাংলা বলার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ইংরেজী উচ্চারণে বাংলা বলার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার ও উচ্চারণে দেশের নতুন প্রজন্মকে আরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, জ্ঞানার্জন ও প্রযুক্তি শিক্ষার জন্য অন্য ভাষাও শিখতে হবে, তবে তা কোনভাবেই মাতৃভাষাকে ভুলে নয়। মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেয়া বা জীবন উৎসর্গ করার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কম দেশই দিতে পেরেছে। তাই মাতৃভাষার মর্যাদা আমাদের রক্ষা করতে হবে। আর নিজের মাতৃভাষায় কথা ও শিক্ষা গ্রহণ হৃদয়ে সবচেয়ে বেশি প্রথিত হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইংরেজী এ্যাকসেন্টে (উচ্চারণ) বাংলা শব্দ বলার বিচিত্র প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। ইদানীং বাংলা বলতে গিয়ে ইংরেজীর এ্যাকসেন্টে বাংলা বলার শব্দ বলার একটা বিচিত্র প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জানি না কেন এটা অনেক ছেলে-মেয়ের মাঝে একটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে গেছে। এভাবে কথা না বললে যেন তাদের মর্যাদাই থাকে না, এমন একেকটা ভাব। ভাষার প্রচলিত ধারা পরিবর্তন করে ‘বাংলিশ’ ভাষায় কথা বলা ঠিক নয়। এই জায়গা থেকে আমাদের ছেলে-মেয়েদের সরিয়ে আনতে হবে। যখন যেটা বলব সঠিকভাবেই উচ্চারণ করেই বলতে হবে। মঙ্গলবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইংরেজী বাংলা মেশানো ভাষা যেন কেউ না শিখে সেজন্য অভিভাবকসহ সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘ইদানীং ইংরেজী উচ্চারণে বাংলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে। এ অবস্থা থেকে ছেলে-মেয়েদের বের করে আনতে হবে। নিজস্ব কথিত ভাষাও ভাল। তবে প্রচলিত ধারার পরিবর্তন করে ‘বাংলিশ’ ভাষায় কথা বলা ঠিক না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইউনেস্কোর ভাষা বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এ্যানভিটা এ্যাবি। বক্তব্য রাখেন ঢাকায় ইউনেস্কোর আবাসিক প্রধান বিট্রেস কালডুন ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব সোহরাব হাসান। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক জিনাত ইমতিয়াজ আলী। অনুষ্ঠানের শুরুতেই ভাষা শহীদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালী জাতির যা কিছু অর্জন তার সবাই অনেক লড়াই-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে। বারবার আঘাত এসেছে, কিন্তু বাঙালী জাতি কারও কাছে মাথানত করেনি। আর মাতৃভাষার জন্য রক্ত দেয়া বা জীবন উৎসর্গ করার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কম দেশই দিতে পেরেছে। তাই মাতৃভাষার মর্যাদা আমাদের রক্ষা করতে হবে। জ্ঞানার্জন ও প্রযুক্তি শিক্ষায় অন্য ভাষাও শেখার প্রয়োজন রয়েছে, তবে কোনভাবেই মাতৃভাষাকে ভুলে গিয়ে নয়। প্রধানমন্ত্রী সারাবিশ্বের ভাষাপ্রেমীদের শুছেচ্ছা জানিয়ে বলেন, বাঙালী জাতির যখন যা কিছু অর্জন তা অনেক ত্যাগের মধ্যদিয়ে, সংগ্রামের মধ্যদিয়েই আমাদের অর্জন করতে হয়েছে। কাজেই সেই অর্জনকে আমাদের ধরে রাখতে হবে। বাঙালীর একুশ পরিণত হয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষের মাতৃভাষা দিবসে। আর বাংলাদেশই একটিমাত্র দেশ, যাদের মাতৃভাষার জন্য অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। মাতৃভাষাকে অর্জন করতে হয়েছে অনেক জীবনের বিনিময়ে। ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬ দফা, গণঅভ্যুত্থান এবং সবশেষে মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। শেখ হাসিনা বলেন, এদেশের মাটির সন্তান হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শুধু দেশকে স্বাধীনই করেননি, স্বাধীন দেশের সরকারের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এভাবে আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এভাবে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নেননি। আশেপাশের দেশে জন্ম হয়েছে। এ কারণে তাদের আমাদের মাতৃভাষার প্রতি কোন টান ছিল না। একমাত্র মাটির সন্তান হিসেবে আমরাই এদেশের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় সকল গণআন্দোলনের পতাকাবাহী সংগঠন ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ, তমুদ্দীন মজলিস এবং আরও কয়েকটি ছাত্র সংগঠন মিলে সর্বদলীয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলাভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করে ধর্মঘট ডাকা হয় এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ জনগণকে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য সমগ্র দেশব্যাপী প্রচারাভিযান শুরু করে। ধর্মঘট চলাকালে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। সাধারণ ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চ বন্দীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পাকিস্তানের যে শাসনতন্ত্র রচিত হয় সেখানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি এবং ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তিনি বলেন, ৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের সবকিছু ওলট-পালট করে দেয়া হয়। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল ঠিক তার উল্টো পথে দেশকে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায় আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী এ সময় ’৯৬ সালে সরকার গঠনের পর কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী প্রয়াত রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালামের সহযোগিতায় তার সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ‘অমর ২১শে ফেব্রুয়ারিকে’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি প্রদানের বৃত্তান্তও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এখন বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের ১৯০টি দেশ এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের সর্বস্তরে বাংলাভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার সুরক্ষা বিধানে ভূমিকা রাখার দায়িত্বও এখন আমাদের ওপর অর্পিত। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা পৃথিবীর সকল ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে গবেষণা এবং সংরক্ষণ ও চর্চার জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি। তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানকে নিয়ে এই ইনস্টিটিউট নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও ২০০১ সাল পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচীর মতো এরও নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছিল। তাদের কাছে মাতৃভাষার কোন গুরুত্ব ছিল না। তিনি বলেন, পৃথিবীর অনেক ভাষা ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার এখন সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব আমাদের। পৃথিবীর যত মাতৃভাষা আছে তা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও গবেষণা করা হচ্ছে এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষাও সংগ্রহ করা হচ্ছে। অনেক নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা থাকলেও লেখনি ছিল না। আমরা এবার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা সংবলিত ২৪ হাজার বই বিনামূল্যে বিতরণ করেছি। তারা নিজেদের ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতে সক্ষম হচ্ছে। যারা ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন, তারা এই ইনস্টিটিউট থেকে অনেক সহযোগিতা নিতে পারবেন। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে ক্যাটাগরি দুইতে উন্নীত করায় ইউনেস্কোকে ধন্যবাদ জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা মাতৃভাষায় শিক্ষা নেব। কিন্তু অন্য ভাষা শিখব না তা নয়। জ্ঞানার্জন ও উন্নত শিক্ষার জন্য অন্য ভাষাও শিখতে হবে। মাতৃভাষার শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি জ্ঞান অর্জন করা যায়। আমরা অন্য ভাষার বিরোধী নই, অন্য ভাষাও শিখতে হবে তবে মাতৃভাষাকে ভুললে চলবে না। আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় এক অন্যরকম মাধুর্য ও সৌন্দর্য রয়েছে। আর মাতৃভাষার মর্যাদা আমাদের রক্ষা করতে হবে। বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা ঘোষণার জন্য তার সরকারের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার তথ্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা জানেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদান করে বিশ্বের দরবারে এ ভাষার গৌরব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সরকার প্রধানের দায়িত্ব লাভ করে আমি নিজেও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিয়মিত বাংলায় ভাষণ দিয়ে আসছি। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মধ্যে বাংলা ভাষাভাষির স্থান হচ্ছে ৬ষ্ঠ। সেজন্য জাতিসংঘ যাতে বাংলাকে দাফতরিক ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে তারজন্য জোর প্রচেষ্টা আমাদের অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও সংগ্রামের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস সারাবিশ্বের সামনে তুলে ধরতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন ও সংগ্রামের ইতিহাস সারাবিশ্বের মানুষের সামনে তুলে ধরা দরকার। মায়ের ভাষায় কথা বলতে এবং ভাষার অধিকার আদায়ে এতো মানুষ শহীদ হয়েছেন, জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। সেই ইতিহাসও সারাবিশ্বে ব্যাপকভাবে প্রচার করা দরকার।
×