ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চাই সমৃদ্ধ দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

চাই সমৃদ্ধ দেশ

মনোয়ার হোসেন ॥ শহরের পথে-প্রান্তে দেখা গেছে বর্ণমালার মিছিল। নারী-শিশু কিংবা পুরুষের হাতে হাতে অহংকার নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে মমতামাখা শোলার তৈরি অক্ষরগুলো। একুশের প্রভাতফেরিতে নিবেদিত ফুলের সঙ্গে ঠাঁই করে নিয়েছিল মাতৃভাষার স্মারকসমূহ। বসন্তের ঝলমলে দিনে এভাবেই প্রকাশিত হয়েছে বাংলা বর্ণমালার গৌরবময়তা। বায়ান্নর ভাষাশহীদদের রক্তঋণের শোকগাথা পরিণত হয়েছে প্রেরণার উৎসে। মনে করিয়ে দিয়েছে কোন রক্তচক্ষুর শাসনে পরাভূত হয় না বাঙালী জাতিসত্তা। কবিতা লাইন ধরে পূর্বপুরুষের ভাষার লড়াইয়ের অতীত গৌরবের কথা স্মরণে উচ্চারিত হয়েছে- মাগো, ওরা বলে/সবার কথা কেড়ে নেবে/তোমার কোলে শুয়ে/গল্প শুনতে দেবে না/বলো, মা, তাই কি হয়? বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা সে কথাকে সত্য হতে দেয়নি। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় নেমেছিল রাজপথে। আত্মপরিচয়ের প্রতিজ্ঞায় অবিচল থেকে রক্ষা করেছিল মায়ের ভাষা ও জাতিসত্তার পরিচয়কে। বুকের রক্ত ঢেলে শামিল হয়েছিল বায়ান্নর ভাষাযুদ্ধে। ছেলেহারা মায়ের অশ্রু গড়িয়ে এসেছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। মঙ্গলবার ছিল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা শহীদদের বুকের রক্তে ভেজা অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। মাথা নত না করার চেতনাস্নাত মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিবসটিতে সকাল থেকে রাত অবধি একুশের মর্মবাণী প্রতিধ্বনিত হয়েছে বাঙালীর হৃদয়ের গহীনে। শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়েছে বর্ণমালার জন্য প্রাণ সঁপে দেয়া সেই ভাষাশহীদদের। ভাষা আন্দোলনের স্মারক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেমে এসেছিল শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে আসা মানুষের স্রোত। রাজধানীর সব পথ এসে মিশে গিয়েছিল এই স্মৃতির মিনারে। শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি চেতনার বিচ্ছুরণে উচ্চারিত হয়েছে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। ব্যক্ত হয়েছে অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে হারিয়ে কল্যাণময় ও মানবহিতৈষী দেশ গড়ার প্রত্যয়। উচ্চারিত হয়েছে উচ্চ আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবি। বলা হয়েছে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইংরেজীর পরিবর্তে বাংলা ব্যবহারের কথা। জানানো হয়েছে সাইনবোর্ড বা লোগো থেকে ইংরেজী হরফের পরিবর্তে বাংলা বর্ণমালা যুক্ত করার দাবি। সেই সঙ্গে একুশের নানা আনুষ্ঠানিকতায় প্রকাশিত হয়েছে অপশক্তিকে রুখে দিয়ে সম্প্রীতির বন্ধনে দারিদ্র্যমুক্ত স্বনির্ভর স্বদেশ নির্মাণের আকাক্সক্ষা। আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার দিনটিতে উচ্চারিত হয়েছে বিশ্ব দরবারে মর্যাদাসম্পন্ন জাতির পরিচয় গড়ে নেয়ার কথা। পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সুসম্পন্নভাবে এগিয়ে যাওয়ায় স্বস্তির সুবাতাসের কথা বলেছেন একুশ উদ্্যাপনে আসা দেশকে ভালবাসা মানুষ। এভাবেই ভাষাশহীদদের প্রতি ভালবাসা ও আগামীর সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভাবনায় সারাদেশে দিবসটি পালিত হয়েছে। এ দিন শহীদদের স্মরণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। সবখানে উড়েছে শোকের কালো পতাকা। একুশকে স্মরণ করা মানুষ ধারণ করেছেন কালো ব্যাজ। দৈনিক পত্রিকাগুলোয় প্রকাতি হয়েছে অমর একুশে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন ও নিবন্ধ। টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর দিনভর প্রচার করেছে একুশের অনুষ্ঠানমালা। সরকারী প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলো পালন করেছে বিশেষ কর্মসূচী। হয়েছে পাড়া-মহল্লায় একুশের অনুষ্ঠান। রাজধানীর অজস্র স্কুলে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ গান-কবিতায় সাজানো অনুষ্ঠান। শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের পাশাপাশি সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের দাবিটিও উচ্চারিত হয়েছে মুখে মুখে। একুশকে কেন্দ্র করে লাখো মানুষ পথে নামলেও ঘটেনি নিরাপত্তাজনিত কোন সমস্যা কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনা। বিঘœ ঘটেনি শোককে ছাপিয়ে সাংস্কৃতিক উদ্যাপনে পরিণত হওয়া উচ্ছ্বাসের আবাহনে। একুশের প্রথম প্রহর থেকেই শহীদ মিনারে শুরু হয় ভাষাশহীদদের নিবেদিত শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্ব। মাতৃভাষার গর্বের অনুভব নিয়ে ভোরবেলার প্রভাতফেরিতে শামিল হয়েছে শেকড়সন্ধানী বাঙালী। প্রভাতফেরি শেষ করে অনেকেই ছুটে গেছেন অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। কেউ বা বাংলা একাডেমির মেলা মঞ্চে বসে উপভোগ করেছেন স্বরচিত কবিতাপাঠের আসর। পোশাকের সঙ্গে মননের চেতনায় ঋদ্ধ হয়ে ফাগুন দিনে রাজধানীর নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে শহরবাসী। বাবা-মার সঙ্গে বেরুনো শিশুদের কোমল গালে জুড়ে বসেছিল শহীদ মিনার কিংবা বর্ণমালা আঁকা আল্পনা। সব কিছুর মাঝেই যেন ছিল ভাষা আন্দোলন থেকে আহরিত বিপ্লবী চেতনার বহ্নিশিখা। শহরময় যেন নাগরিকদের সঙ্গী করে প্রাণের ভাষা যেন হেঁটে বেড়িয়েছে তার বর্ণমালাদের নিয়ে। কবির ভাষায়Ñ ফাগুন এলেই একটি পাখি ডাকে/ থেকে থেকেই ডাকে/তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো/আমি যে তার নাম রেখেছি আশা/নাম দিয়েছি ভাষা ...। মায়ের ভাষার জন্য মৃত্যুকে যাঁরা ভয় না করে বরণ করেছিল সেই সব শহীদরা দিনটিতে পেয়েছেন অমরত্বের মর্যাদায় আপামর মানুষের পরম ভালবাসা। কবির কথায়Ñ অজস্র দিনের মধ্যে জ্বলেছে একুশে ফেব্রুয়ারি/সালাম বরকত শফি রফিক জব্বার/ আত্মায় আহত হয়ে তুলেছে উদ্দীপ্ত তরবারি ...। বিগত বছরের মতো এবারও একুশে ফেব্রুয়ারিতে বিনম্র শ্রদ্ধায় ভাষাশহীদদের স্মরণ করেছে বীর বাঙালী। সারাদেশে নানা আনুষ্ঠানিকতার মাঝে একুশের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিটে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় নেপথ্যে বেজে ওঠে অমর একুশের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। ভাষাযোদ্ধাদের নিবেদিত পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ শেষে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। এরপর একে একে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বী মিয়া, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদসহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্যসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে দলের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এছাড়া শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সাংসদ, তিন বাহিনীর প্রধানেরা, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়র, কূটনীতিক, আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা এবং উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে নেতৃত্বদানকারীদের সংগঠন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামও পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে প্রথম প্রহরে। শহীদদের শ্রদ্ধা জানান হুইলচেয়ারে করে আসা একদল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা। এসময় আরও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সহযোগী সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ছাত্র, যুব, শ্রমিক, কৃষক সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ। ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় শহীদ মিনারের বেদি। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদ মিনার উন্মুক্ত করে দেয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য। রাত দেড়টার দিকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন দলীয় নেতারা ছিলেন। রাত ১টার পর শহীদ মিনার খুলে দেয়া হয় সবার জন্য। ততক্ষণে মিনারের চারপাশে ঢল নামে সাধারণ মানুষের। পোশাকে শোকের কালো ও শহীদের বুকের খুনে রাঙা ফুল হাতে হাতে দাঁড়িয়েছিলেন সুশৃঙ্খল সারি বেঁধে। ১২টা বাজার অনেক আগে থেকেই আসতে শুরু করেছিলেন তাঁরা। সর্বসাধারণের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা পুষ্পস্তবক হাতে সারিবদ্ধভাবে জানিয়েছেন শ্রদ্ধাঞ্জলি। গভীর রাতে নারী-পুরুষ এমনকি বাড়ির শিশুটিও খালি পায়ে শহীদদের প্রতি মমত্ব নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে বেদির সম্মুখে। এ সময় মাইকে ভেসেছে শহীদের রক্ত ঋণে লেখা শোকসঙ্গীতÑ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি/আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি ...। এই সুরের সঙ্গে সারারাত ধরে চলে শ্রদ্ধা নিবেদনের আনুষ্ঠানিকতা। ভোর পেরিয়ে দুপুর ১টা পর্যন্ত চলেছে সেই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন পর্ব। সূর্যোদয়ের আলোয় উদ্ভাসিত শহীন মিনার প্রাঙ্গণ যেন নতুন চেহারা পায়। দৃশ্যমান হয় প্রভাতফেরিতে অংশ নেয়া নানা পেশা, শ্রেণী ও বয়সী মানুষের স্রোত। বেলা যত বেড়েছে ফুল দিতে আসা মানুষের সারি তত দীর্ঘ হয়েছে। শাহবাগ, জগন্নাথ হল, পলাশী মোড়, নীলক্ষেত ও ইডেন কলেজের দিক থেকে বানের স্রোতের মতো এসেছে একুশের চেতনাস্নাত জনতা। দুপুর একটা পর্যন্ত লাখো মানুষের দেয়া রাশি রাশি ফুলে ভরে ওঠে শহীদ মিনার। এক সময় শহীদদের নিবেদিত ফুলগুলো দিয়ে বেদিমূলে নান্দনিক আল্পনা সৃজন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডেট সদস্যরা। বিকেল বেলায়ও সাংস্কৃতিক আয়োজনের টানে ও শহীদদের বিলম্বিত শ্রদ্ধা নিবেদনে আকাক্সক্ষায় শহীদ মিনারে জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ। সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি সেই স্রোতধারা অব্যাহত চলমান থাকে। অনেকের মতোই এদিন সকালে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক রাজেন্দ্র লাল তালুকদার। ভাষাশহীদদের ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়ে বইমেলার থেকে ফেরার পথে দোয়েল চত্বরে তাঁর সঙ্গে কথা জনকণ্ঠের এই প্রতিনিধির। তিনি বলেন, আমি প্রত্যক্ষ করেছি মুক্তিযুদ্ধ। আর একুশে ফেব্রুয়ারি হচ্ছে বাঙালী স্বাধীনতার আঁতুর ঘর। বায়ান্নতে যে রক্তধারার ক্ষরণ শুরু হয়েছিল তারই পরিপূর্ণতা ঘটে একাত্তরে। ভাষাযুদ্ধেরই ফসল লাল-সবুজের পতাকায় আঁকা বাংলাদেশ। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আমার কাছে প্রেরণার উৎস। সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার পথরেখা। একজন আদিবাসী হয়েও জন্মগতভাবে মিশে গেছি বাংলা বর্ণমালার সঙ্গে। এ ভাষার জন্য গৌরব ও অহংকার বোধ করি। দশ বছরের মেয়ে ঋতুকে নিয়ে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে এসেছিলেন সূত্রাপুরের বাসিন্দা কাজী আফতাব। তাঁর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিনিধির। বলেন, ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালীর জাতিসত্তার উন্মেষ ঘটেছিল। বাংলা বর্ণমালার জন্য আমাদেরই ভাইয়েরা তাঁদের প্রাণটি বিসর্জন দিয়েছিলেন। আজ এই দিনটি বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। বাঙালিত্বের এই গৌরবগাথা ও চেতনার পবিত্রতা ছড়িয়ে দিতে চাই আমার মেয়ের মাঝে। সে কারণেই ওকে নিয়ে এসেছি ভাষার জন্য আমাদের অবিস্মরণীয় ইতিহাস ও বোধের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতে। এদেশের মানুষের পাশাপাশি ভাষাকে ভালবাসা ভিনদেশী নাগরিকরাও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্্যাপনের আনন্দে শামিল হয়েছিলেন রাজধানীতে। দোয়েল চত্বরের সামনে কথা হয় মাতৃভাষা দিবসের আয়োজন দেখতে আসা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সনৎ কুমার সাহার সঙ্গে। বলেন, ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার মতো দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। এই বিরল ঘটনাটিই ঘটিয়েছেন এদেশের ভাষার যোদ্ধারা। তাঁদের কল্যাণেই আজ সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঠাঁই করে আজ বাংলা ভাষা। পৃথিবীজুড়ে এখন বাংলা ভাষা অহংকার করা হয়। সেই ভাষা দিবসের উদ্্যাপনটি কেমন হয় তা দেখার জন্য আমরা বন্ধুরা মিলে এখানে এসেছি। শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়ে ও অমর একুশে গ্রন্থমেলা ঘুরে শোক থেকে উদ্্যাপনে পরিণত হওয়া সেই অভূতপূর্ব অনুভবটুকু গ্রহণ করলাম সবাই মিলে। এবারও শহীদ মিনারের জনস্রোত ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা শহরে। শাহবাগ, টিএসসি, পলাশী, দোয়েল চত্বর এলাকা ছিল লোকে লোকারণ্য। ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের পোশাকে ছিল শোকের কালো রং। সাদা-কালো শাড়ি পরে বের হয়েছিলেন নারীরা। পুরুষের পাঞ্জাবিতেও ছিল সাদা কালো রঙের বিস্তার। জাতীয় পতাকার লাল সবুজটি জুড়ে গিয়েছিল কারো কারো পোশাকে। শহীদ মিনার থেকে অনেকেই সরাসরি চলে যান অমর একুশের গ্রন্থমেলায়। এ দিন সকাল ৮টায় খুলে দেয়া হয় মেলার প্রবেশদ্বার। দেখতে দেখতে ভরে ওঠে বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। বিপণি বিতানগুলো ঘুরে একুশ উদ্্যাপনকারী বই দেখেছেন ও কিনেছেন। বাইরে ফুটপাথে বসেছিল হাজারো পণ্যের পসরা। সেখানে জমেছিল জনতার ভিড়। সব মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটি যেন মাতৃভাষার গৌরবে নতুন করে জেগে উঠেছিল। রাত পর্যন্ত চলেছে অভিন্ন উদ্্যাপন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে ছিল নানা আনুষ্ঠানিকতা। বসন্ত দিনের সকালে বাংলা একাডেমির মেলা মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর। নবীন-প্রবীণ ও খ্যাতিমান কবিরা পড়েছেন কবিতা। এতে সভাপতিত্ব করবেন কবি মোহাম্মদ সাদিক। বিকেলে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দেশী-বিদেশী শিল্পীদের নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। দেশের শিল্পীদের সঙ্গে ভিন্ন ভাষার গান পরিবেশন করেন বিদেশী শিল্পীরা। অমর একুশের গান দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। ভিন্ন ভাষার গান শোনায় ইতালি, ভুটান, সুইডেন, ভিয়েতনাম, চীন, ইরান, ফ্রান্স, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, রাশিয়া ও কোরিয়ার শিল্পীরা। বসন্ত বিকেলে ধানম-ির রবীন্দ্র সরোবরে অনুষ্ঠিত হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একুশের অনুষ্ঠানমালা। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ সেøাগানে দুই সপ্তাহব্যাপী এ আয়োজনের শেষ দিন ছিল মঙ্গলবার। এদিনের পরিবেশনায় ছিল গান, কবিতা ও পথনাটকের উপস্থাপনা। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার দাবি নিয়ে অমর একুশের ভাষাশহীদদের স্মরণে রাজধানীতে তিন দিনের কর্মসূচী পালন করল বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। কর্মসূচীর শেষ দিন মঙ্গলবার হাতিরঝিলের মেরুল-বাড্ডা প্রান্তে ঝিলপাড়ে অনুষ্ঠিত হয় শহীদ স্মরণ। অনুষ্ঠানের শুরুতে দলীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচী বাড্ডা শাখার শিল্পী-কর্মীরা। এরপর শুরু হয় আলোচনা সভা। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে আলোচনাসভায় বক্তারা বলেন, সংবিধান এবং আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও এখনও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়নি। বিভিন্ন দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য স্থানের নামফলকে এখনও নির্বিচারে ব্যবহৃত হচ্ছে ইংরেজী ভাষা, যা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। এছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমেও বাংলা ভাষাকে বিকৃতভাবে উচ্চারণ করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এসব বিষয় বন্ধ করে অবিলম্বে সমাজের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার দাবি জানান বক্তারা। আলোচনা সভার পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা পর্ব। একুশের প্রথম প্রহরে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার। সকালে উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রভাতফেরির মিছিলে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে শুরু হয়ে তাদের মৌন মিছিল আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে শ্রদ্ধা জানিয়ে শহীদ মিনারের মূল বেদিতে এসে শেষ হয় এসময় অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক একুশের চেতনাকে মনেপ্রাণে ধারণ করতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ দেশবাসীকে আহ্বান করেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরাও আলাদাভাবে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানান। এভাবেই বহুমাত্রিক আনুষ্ঠানিকতায় হৃদয়ের অকৃত্রিম ভালবাসায় প্রতি ফাল্গুনের মতোই যেন ৬৫ বছর পর আবার দিনটিতে সেই সব শহীদরা জেগে উঠেছিল ও জাগিয়ে গেল জাতিকে। অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের কবিতার সূত্র ধরে বলে যায়, প্রতি ফাল্গুনে তারা আসে। তারা জাগে, তারা জাগায়/ তারা ভাষা দেয়, তারা ভাষা চায়।
×