ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ত্যাগ খাটো করে দেখার সুযোগ নেই

নার্গিস শিরিনকে কেউ মনে রাখেনি

প্রকাশিত: ০৪:৫৮, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

নার্গিস শিরিনকে কেউ মনে রাখেনি

শ.আ.ম হায়দার, পার্বতীপুর থেকে ॥ মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতের পতিরাম ক্যাম্পের নিবেদিত স্বাস্থ্য সেবিকা নার্গিস শিরিন ভানী বয়সের ভারে এখন নিস্তেজ। ৬৪ বছর বয়সে তার শরীরে নানাবিধ রোগ-ব্যাধি বাসা বেঁধে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছে। ভুগছেন ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও কোমরের হাড় ক্ষয় রোগে। এ যাবত তার তিনটি অপারেশন হয়েছে। চলৎ শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। দুঃখজনক স্বাধীনতার পর তাঁর খবর কেউ রাখেনি। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজন বোধ করেনি। তাঁকে অবহেলা করা হলেও দেশের জন্য তাঁর ত্যাগ, অবদান খাটো করে দেখার অবকাশ নেই। এখন তিনি নতুন বাজারে নিজ বাড়িতে রয়েছেন অসুস্থ অবস্থায়। দিন চলে অতি কষ্টে। জীবন সায়াহ্নে তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চান। তা হলে মরে শান্তি পাবেন বলে জানিয়েছেন। সেই ঊনসত্তর ও সত্তরের কথা। অসহযোগ ও স্বাধীকার আন্দোলনে দেশ উত্তাল। তখন রাজশাহীতে পরিবার পরিকল্পনা প্রশিক্ষণ ও গবেষণালয়ে ট্রেনিং চলছে। পার্বতীপুর হেলথ কমপ্লেক্স হাসপাতাল থেকে এ প্রশিক্ষণে যোগ দেন হেলথ ভিজিটর নার্গিস শিরিন। তবে আন্দোলনের কারণে এ ট্রেনিং স্থগিত হয়ে যায়। অংশগ্রহণকারীরা নিজ নিজ বাড়ি চলে যায়। নার্গিস পার্বতীপুরে বাড়িতে এসে এক মুহূর্তও টিকতে পারেননি। প্রত্যক্ষ করেন অবাঙ্গালীরা বাঙ্গালীদের ঘরবাড়ি জ¦ালাও পোড়াও শুরু করেছে। তাদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে লোকজন নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাচ্ছে। অনেকেই সীমান্ত অতিক্রম করছেন। তিনিও বাবা মা ভাই বোন সবাইকে নিয়ে দেশ ত্যাগ করে ভারতে যান। এখানে এসে নার্গিস বসে থাকেননি। ট্রেনিং কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য সেবিকা হিসেবে যোগ দেন ভারতের দক্ষিণ দিনাজপুরের তৎকালীন পতিরাম মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। নার্গিস তার বাসায় একান্তে সেই সব দিনের স্মৃতিচারণ করেন আত্রাই নদীর পূর্ব তীরে পতিরাম ক্যাম্পটি ছিল মনোরম পরিবেশে। তবে অত্যাধিক লোকজনের চাপে পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মিঃ তামান নামে ভারতীয় মেজর। পরিচালক ছিলেন পার্বতীপুরের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা মুহীউদ্দিন আহমেদ (প্রয়াত)। তখন বয়স কম। জয় বাংলার অগ্নিমন্ত্রে দিক্ষিত আমরা এক ঝাঁক স্বাস্থকর্মী দেশের কাজে নিয়োজিত হয়েছি। কষ্ট হলেও তা মনে হয়নি। যে রেশন দেয়া হতো তা দিয়েই চলে যেত। সে সময় আমাদের অনেক কাজ করতে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক চিকিৎসা, ওষুধ পথ্য বিতরণ, রণাঙ্গনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করানো। এছাড়া শরণার্থী শিবিরগুলোতে গিয়ে শিশু ও প্রসূতিদের স্বাস্থ্যসেবা দিতে হতো। এ সময় ভারতীয় ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিম আন্তরিকভাবে কাজ করেছে। চোখের সামনে দেখেছি কত মুক্তিযোদ্ধার লাশ। ভারতের মাটিতেই তাদের দাফন হয়েছে। অনেকের লাশই পাওয়া যায়নি। অবসরে শুনতাম এক ব্যান্ডের রেডিওতে কলকাতার আকাশ বাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত দেশাত্মবোধক ও আগুন ঝরা গানে মুক্তিযোদ্ধারা উজ্জীবিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি ভারতেই কাটান। দেশ শক্রমুক্ত হলে ফিরে এসে দেখেন ঘরবাড়ি সবকিছু মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এ ক্ষতি এখনও পূরণ হয়নি। তিনি দুঃখ করে বলেন, তার স্বামী মারা যাওয়ার পর অতিকষ্টে ২ ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করেছেন। তবে তদবির অভাবে তাদের সরকারী চাকরি হয়নি। এখন নকলের ভিড়ে আসল হারিয়ে গেছে। ভুয়ায় ভরা মুক্তিযোদ্ধার তালিকা। আমার মতো নার্গিস শিরিনরা হারিয়ে গেছে।
×