ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

এত বড় সঙ্গীত হবে বুঝিনি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

এত বড় সঙ্গীত হবে বুঝিনি

মোরসালিন মিজান ॥ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি...। একদিকে ভাই হারানোর শোক। অন্যদিকে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার গৌরব। দুটোকেই সযতেœ ধারণ করেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। মাত্র ১৮ বছর বয়সে লেখা তার সরল কবিতাখানি আজ অমর সঙ্গীত। একুশের প্রভাতফেরির গান গাইছেন অন্য ভাষাভাষীরাও। এই গান গেয়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রতিবছরের মতো আজও গানটি গাইতে গাইতে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠবে বাঙালী। আবেগে ভাসবে। কিন্তু আশ্চর্যের ঘটনা যে, গান সৃষ্টির পুরো প্রক্রিয়াটিকে খুব সাধারণ চোখেই দেখেন এর রচয়িতা। বলেন, ছাত্রজীবনে লিখেছি। এত বড় কবিতা হবে, সঙ্গীত হয়ে যাবে, বুঝি নাই। ইটস এন এক্সিডেন্ট যে, এটা এখন এত বড় হয়ে গেছে! গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশে এসেছিলেন লন্ডন প্রবাসী গীতিকার। এক বন্ধুর বাসায় অবস্থানকালে জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। একান্ত সাক্ষাতকারে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের স্মৃতি, সঙ্গীত রচনার ইতিহাস ছাড়াও উঠে আসে সমাজ রাজনীতি মৌলবাদ সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন বিষয়। সাক্ষাতকারের প্রথমপর্বে আলোচনা হয় ভাষা আন্দোলনসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে। যে সঙ্গীত বাঙালীর সামনে বায়ান্নোকে মূর্ত করে, অশ্রুসজল করে রাখে চোখ, যে গান ছাড়া শহীদ দিবস পালন করার কথা কল্পনা করা যায় না, সেই গান নিয়ে খুব সাদামাটা বলেন তিনি। খুব বিনয়ী উচ্চারণ। কখন কীভাবে কোন আবেগ থেকে লেখা হলো গানটি? এমন প্রশ্নে আবদুল গাফফার চৌধুরী বলেন, তখন তো কলেজের ছাত্র ছিলাম। আবেগ ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রতি। শহীদদের লাশ দেখেছি। দেখে কবিতা লিখেছি। আমি তো গান লিখিনি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে লাশটা দেখার পরে হোস্টেলে ফিরে গিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। পরে শেষ করেছি। অনেক লম্বা কবিতা তো। লতিফ সাহেব সুর দিয়েছেন। আলতাফ মাহমুদ সুর দিয়েছেন। জহির রায়হান গানটি তার ছবিতে নিয়েছেন। আর এখন তো আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের গান। এসবে তার নিজের কৃতিত্ব খুব কম মন্তব্য করে তিনি বলেন, আলতাফ মাহমুদের সুর গানটাকে বাঁচিয়েছে। এখানেই শেষ নয়। আরও সরল বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, তখন ১৮ বছর বয়স। ঢাকা কলেজে পড়ি। এত বড় কবিতা হবে, সঙ্গীত হয়ে যাবে, বুঝি নাই। ইটস এন এক্সিডেন্ট যে, এটা এখন এত বড় হয়ে গেছে। আর আন্দোলন? ভাষার লড়াইয়ে কখন কিভাবে যুক্ত হয়েছিলেন? উত্তরে তিনি বলেন, ৪৮ সালে মুভমেন্ট যখন শুরু হয়, তখন থেকেই যুক্ত ছিলাম। দুবার জেলে গিয়েছি। তবে ভাষা আন্দোলনে আমার বিশেষ কোন ভূমিকা ছিল না। হাজার হাজার ছাত্র আন্দোলনে ছিল। তাদের নাম কেউ নেয় না। আমি গানটা লিখেছিলাম। তাই লোকে নামটা মনে রেখেছে। এর বাইরে কোন বৈশিষ্ট্য নেই। তবে দীর্ঘ আন্দোলন আর শহীদের রক্তে পাওয়া রাষ্ট্রভাষা বাংলার বর্তমান অবস্থা তাকে কষ্ট দেয়। সব মিলিয়ে বাংলা ভাষার অবস্থা ভাল নেই বলে মনে করেন তিনি। এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে অনেকটা ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, এটা বললে আমাকে অনেকে গালাগালি করবে। ভাষা আন্দোলনটা তো ভাষাপ্রেমের জন্য হয়নি। ওটা ছিল রাজনৈতিক আন্দোলন, উর্দু ভাষার বদলে আমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা চাই। রাজনীতিবিদদের ভাষাপ্রেম কখনোই ছিল না। সাধারণ মানুষের ভাষাপ্রেম আছে। রাজনীতিকরা ভাষা আন্দোলনটাকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। ফলে বাংলা ভাষার আজ এই অবস্থা। তিনি বলেন, যুদ্ধে আপনি যে তলোয়ার নিয়ে যান, যুদ্ধ শেষ হলে কী সেটিতে আর ধার দেন? না। ওটা পড়ে থাকে। বাংলা ভাষার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। শহীদ মিনারের সম্পূর্ণ নকশা বাস্তবায়ন না করা ও রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতির কঠোর সমালোচনা করেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। তার মতে, এখন যে শহীদ মিনার, সেটি অসম্পূর্ণ। কাজটি করতে গিয়ে প্রকৃত নকশা অনুসরণ করা হয়নি। যা হয়েছে সেটিরও রক্ষণাবেক্ষণ করার কেউ নেই। শহীদ মিনারের অমর্যাদা করা হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। আপত্তিকর নানা দৃশ্য এখানে নিয়মিতই দেখা যায়। গত বিজয় দিবসের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শহীদ মিনারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, বেদিতে ওঠার আগে গাড়িতে কিছুক্ষণ বসে ছিলাম আমি। তখন দেখি উল্টো পাশের দেয়ালে একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের নানা স্লোগান। ছবি। আর তার ঠিক পাশে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পথচারীরা। তিনি প্রশ্ন রাখেন, রাজনৈতিক চেতনা কত নিচে হলে এটা সম্ভব? অভিযোগ করে তিনি বলেন, এতসব হচ্ছে কারণ সরকারের গাফিলতি আছে। জনগণও দেখছে না। একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে হলে এসব জায়গা নিয়ে আরও ভালভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
×