ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দেশ ভাগের আগেই বাংলার দাবি তুলেছিলেন ড. শহীদুল্লাহ

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

দেশ ভাগের আগেই বাংলার দাবি তুলেছিলেন ড. শহীদুল্লাহ

আরাফাত মুন্না ॥ বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার প্রশ্নটি উত্থাপিত হয় ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের আগে থেকেই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পাল্টা বাংলা ভাষার প্রস্তাব দেন। তার আগে এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদই কেউ করেননি। তিনিই প্রথম জিয়াউদ্দিন আহমেদের এই সুপারিশের অসারতা সম্পর্কে পাকিস্তানের জনসাধারণ ও শিক্ষিত সমাজকে অভিহিত করতে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। ভাষাসংগ্রামী ও লেখক বদরুদ্দীন ওমর তার ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি (প্রথম খ-)’ বইয়ের প্রথম পরিচ্ছেদে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পর্কে বলতে গিয়ে এসব কথা বলেছেন। বদরুদ্দীন ওমর তার বইতে বলেন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার ওই প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘কংগ্রেসের নির্দিষ্ট হিন্দীর অনুকরণে উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা রূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাদগমনই হইবে না।... ইংরেজী ভাষার বিরুদ্ধে একমাত্র যুক্তি এই যে ইহা পাকিস্তান ডোমিনিয়নের কোন প্রদেশের অধিবাসীরই মাতৃভাষা নয়। উর্দুর বিপক্ষেও একই যুক্তি প্রযোজ্য।’ ওই প্রবন্ধে শহীদুল্লাহ আরও লিখেছেন, ‘যদি বিদেশী ভাষা বলিয়া ইংরেজী ভাষা পরিত্যক্ত হয়, তাহলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ না করার কোন যুক্তি নাই। যদি বাংলা ভাষার অতিরিক্ত কোন দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করতে হয়, তবে উর্দু ভাষার দাবি বিবেচনা করা কর্তব্য।’ বদরুদ্দীন ওমর তার বইতে বলেন, এখানে একটি জিনিস বিশেষভাবে লক্ষণীয়। উর্দুর দাবি বিবেচনার ক্ষেত্রে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ধর্মের প্রসঙ্গ একেবারেই উত্থাপন করেননি। এক শ্রেণীর লোক উর্দুর সপক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন শুধু ধর্মীয় যুক্তিতে। তারা বলেন উর্দুর সঙ্গে ইসলামের যোগাযোগ বাংলা ভাষার থেকে ঘনিষ্ঠ। বদরুদ্দীন ওমর তার বইতে আরও লিখেছেন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে আরবী ভাষাই বিশ্বের মুসলমানদের জাতীয় ভাষা। সেই হিসেবে তিনি মনে করেন যে আরবী ভাষাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে ধর্মীয় ভাষা হিসেবে উর্দুর কোন স্থান নেই। বদরুদ্দীন ওমর তার ওই বইতে আরও বলেন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তার ওই প্রবন্ধের শেষের দিকে লিখেছেন, ‘বাংলা দেশের কোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দী ভাষা গ্রহণ করা হইলে তাহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদরূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবল বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতি বিরোধীই নয়, প্রদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিতও বটে।’ বদরুদ্দীন ওমর তার ওই বইতে আরও উল্লেখ করেন, এরপর থেকে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ আরও বহু প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বাঙালী রাষ্ট্রসত্তার যুক্তিনিষ্ঠ বিকাশের লক্ষ্যে এবং বাঙালীর জাতিসত্তার মূলে যে বাংলা ভাষা তার মযার্দা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে একনিষ্ঠ একজন রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ইতিহাসের কোন কোন পর্যায়ে শাসক শ্রেণী যে বিশেষ আদেশ বলে জনগণের ভাষার বদলে অভিজাত শ্রেণীর ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, সেই চেষ্টা প্রতিহত করার দ্রোহী বুদ্ধিদীপ্ত প্রত্যয়ে যারা এগিয়ে আসেন ড. শহীদুল্লাহ্ তাঁদের মধ্যে একজন। বলতে গেলে অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে ভাষা আন্দোলনে দ্রোহী বুদ্ধিজীবীর ভূমিকাই পালন করেছেন তিনি। ভাষা আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক পর্বে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা ও লেখনির শক্তির বিরাট প্রভাব ছিল। বিশেষ করে তাঁর লেখায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার দাবির পক্ষে জ্ঞানগর্ভ যুক্তিসমূহ ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্ব থেকে সমাপ্তির পরও ভাষা আন্দোলনের চেতনা বাস্তবায়নে যারা কাজ করেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তাদের অন্যতম। পাকিস্তান সৃষ্টির পর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলা উর্দুর দ্বন্দ্ব নিয়ে যখন তুমুল ঝড় উঠে তখন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে জাতীয়তাবাদ বা বাঙালী জাতিসত্তায় বিশ্বাসী হতে কোন মানসিক সংকটে ভুগতে দেখা যায়নি। পূর্ব বাংলায় বাঙালী মুসলমান বুদ্ধিজীবীর এই দ্রোহী পটভূমিকার কথা বিস্মৃত হলে চিরায়ত বাঙালীর লড়াকু ইতিহাস উপলব্ধি করা অসম্ভব হবে। ভাষা আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়ে তিনি অনেকটা কলম সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ‘দ্য উইকলি’, ‘কমরেড’, ‘দৈনিক আজাদ’ প্রভৃতি পত্রিকায় লেখালেখির মাধ্যমে যুক্তিনিষ্ঠ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। প্রাদেশিক রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি প্রথম উচ্চারণ করেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরের পূর্বে লেখনি ও মৌখিক বিতর্ক ছাড়া বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়ে সাংগঠনিক কোন উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। বাংলা হরফকে আরবী বা উর্দুর ন্যায় রোমান হরফে লেখার ষড়যন্ত্রও সুদীর্ঘকালের। ড. শহীদুল্লাহ্ অত্যন্ত সচেতনভাবে এ উদ্যোগ প্রতিহত করেন। এ উদ্যোগকে তিনি একটি সর্বনাশা উদ্যোগ উল্লেখ করে বলেন, ‘এতে পূর্ব পাকিস্তানের জ্ঞান অর্জনের পথ রূদ্ধ করে দেবে এবং হয়ত এতে পাকিস্তানের ভিত্তিমূল ধ্বংস হয়ে পড়বে।’ গণতন্ত্রের শর্ত মোতাবেক তার মতে বাংলাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবি রাখে। তার কাছে ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা ছুৎমার্গের কোন স্থান ছিল না। যারা জবরদস্তি করে পাকিস্তানের ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দিতে চাইলেন তাদের তিনি পাকিস্তানের দুশমন বলেই ক্ষ্যান্ত হননি, ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছেন। বাংলা ভাষাকে বহুগুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তি বিভিন্নভাবে সেবা করেছেন। কোনরূপ রাজনৈতিক অভিলাষ পোষণ না করে এবং রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হয়েও জাতির সেবায় এমন নেতৃত্বের দৃষ্টান্তেও তিনি অদ্বিতীয়। সে কারণেই হয়ত তাকে ভাষার জন্য মিছিলের অগ্রভাগে থেকে তরুণ নেতৃত্বের বোঝা কাঁধে নিতে কুণ্ঠিত হতে দেখা যায়নি। একটি আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের উপযুক্ত বিকাশের জন্যই তিনি বাংলা ভাষার এমন সেবক হিসেবে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। মাতৃভাষার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধকে তার বিরোধী পক্ষরা হিন্দুঘেঁষা মনোভাব বলে কটূক্তি করেছেন। তার সত্য কথনের সাহস ও তীক্ষ¥ অন্তর্দৃষ্টি পাকি শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুকে রক্ত পিপাসু করেছে। চঁহফরঃ ুড়ঁ ধৎব ধ ঃৎধরঃড়ৎ বলেও এই অশীতিপর বৃদ্ধ সংগ্রামীকে থামানো সম্ভব হয়নি। তিনি পাহাড়ের মতো মাথা উঁচু করে বুদ্ধিজীবী-কবি-সাহিত্যিকদের ও সংগ্রামী ভাষাসৈনিক-যোদ্ধাদের পথিকৃৎ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের তাঁর অবদানের ঋণ অপরিশোধ্য।
×