ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জ্বেলেছিলেন বহ্নি

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

জ্বেলেছিলেন বহ্নি

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি-শিখা/জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্ত-টিকা’। বাংলার নারীরা আজকের এই দিনে তাদের সমস্ত শক্তি ও সাহস নিয়ে বহ্নিশিখা জ্বালাতে বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে নেমেছিলেন। কেউ কেউ আবার বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে স্বাধিকার আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে ভাষার জন্য সংগ্রাম করেছিল হাজার হাজার বাঙালী। নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে সব এক হয়ে ছিনিয়ে এনেছে এই বাংলাকে। সেই সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বাংলার অনেক নারী ভাষাসৈনিকরা। তাদের মধ্যে কেউ প্রাণ দিয়েছেন রাজপথে কেউ আবার এখনও মাতৃভাষাকে ভালবেসে এখনও বেঁচে আছেন। নারী ভাষাসৈনিকের সঠিক সংখ্যা কত ছিল তা আমাদের এখনও অজানা। তবে যারা বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে অনেকেই আমাদের বর্তমান প্রজন্মকে মাতৃভাষা বাংলা চর্চার আগ্রহ যোগাচ্ছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলোÑ রওশন আরা বাচ্চু, হালিমা খাতুন ও প্রতিভা মুৎসুদ্দি। আজকের এই দিনে তারা মাতৃভাষা বাংলার জন্য লড়েছিলেন রাজপথে। রওশন আরা বাচ্চু ও হালিমা খাতুন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। ভাষাসৈনিক প্রতিভা মুৎসুদ্দি তখন চট্টগ্রামে ছিলেন তিনিও সেখান থেকে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল করেছিলেন এবং ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তিনি স্বাধিকার আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। এই তিন ভাষাসৈনিক জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানিয়েছেন, তাদের ভাষা আন্দোলনের অজানা কিছু অভিজ্ঞতার কথা। তাদের সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই আজকের লেখা হয়েছে ‘তারা মানুষ গড়ার কারিগর, তারা ভাষাসৈনিক’। প্রথমেই যে নামের মানুষটির সঙ্গে কথা হয় তিনি হলেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি একনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংগঠিত করা ছাড়াও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হলের ছাত্রীদের ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সুসংগঠিত করেন। রওশন আরা বাচ্চু জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ২০ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করা হলে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। আমরা সিদ্ধান্ত নেই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করব। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে ২১ ফেব্রুয়ারির দিন আমি ইডেন কলেজ ও বাংলাবাজার বালিকা বিদ্যালয় থেকে ছাত্রীদের সংগঠিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সমাবেশস্থলে নিয়ে আসি। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলটি কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। যেহেতু নারীদের সংখ্যা কম ছিল, তাই প্রতিটি মিছিলের সামনে একজন করে নারীকে রাখা হয়। যার একটিতে ছিলাম আমি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশস্থলটির বাইরে পুলিশ লাঠি দিয়ে ব্যারিকেড দিয়েছিল। অনেকে লাঠির ওপর দিয়ে লাফিয়ে এবং নিচ দিয়ে বের হয়ে গেলেও আমি তা করিনি। আমি কয়েকজন ছাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ব্যারিকেডটি ভেঙ্গে ফেলি। এতে পুলিশ এলোপাতাড়ি লাঠিচার্জ শুরু করে দেয়। লাঠির আঘাতে আহত হই। টিয়ারশেল, পুলিশের মুহুর্মুহু গুলির শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। কোন উপায় না দেখে পাশে স্তূপকৃত ভাঙ্গা রিক্সার নিচে গিয়ে আশ্রয় নেই। এরপর হলের প্রভোস্ট ড. গণির পাশের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেই। ভাষা আন্দোলনে নারীদের প্রতিবন্ধকতার স্মৃতিচারণ করে রওশন আরা বাচ্চু বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হয়ে গেলে আমাদের জাতি হিসেবে অস্তিত্ব থাকবে না ভেবেই আমার ভাষা আন্দোলনে যাওয়া। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। ইতিহাসে নারীর ভূমিকা সেভাবে উঠে আসেনি। অথচ ভাষা সংগ্রামে নারীদেরও অগ্রণী ভূমিকা ছিল। ইতিহাস সংশোধন হওয়া প্রয়োজন।’ জানালেন, তিনি যে সময় ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন, সে সময় মেয়েদের জন্য অনুকূল পরিবেশ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের অনুমতি ছাড়া ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে সে সময় ১০ টাকা জরিমানা করা হতো মেয়েদের। আন্দোলনে গেলে পড়াশুনা বন্ধ করে দেয়ার পারিবারিক হুমকিও ছিল তার। সকল বাধা উপেক্ষা করেই তিনি মাতৃভাষা চেতনায় উজ্জীবিত হন সকল ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে। ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু ১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিলেটের কুলাউড়ার উছলাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা এ এম আরেফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। ১৯৪৭ সালে রওশন আরা বাচ্চু শিলং লেডী কীন স্কুল থেকে মেট্রিক, ১৯৪৯ সালে বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে অনার্স পাস করেন। ১৯৬৫ সালে বিএড এবং ১৯৭৪ সালে ইতিহাসে এমএ পাস করেন। রওশন আরা বাচ্চু ‘গণতান্ত্রিক প্রোগ্রেসিভ ফ্রন্ট’ এ যোগ দিয়ে ছাত্ররাজনীতি শুরু করেন। তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং উইম্যান স্টুডেন্টস রেসিডেন্সের সদস্য নির্বাচিত হন। ৮৫ বছর বয়সী ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু শিক্ষকতা থেকে অবসর নেয়ার পর থেকে লেখালেখির কাজ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। নিজের দেখা ঐতিহাসিক ঘটনাবলি নিয়ে তার লেখা ‘বাংলা ভাষা ও ভূখ-’ নামে বইটি এখন প্রায় শেষের পথে। যাতে ভাষা আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণের বিষয়গুলো উঠে এসেছে বলে জানান রওশন আরা বাচ্চু। নারী ভাষাসৈনিকদের মধ্যে হালিমা খাতুন অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩৩ সালে খুলনা জেলার বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। স্কুলজীবন থেকেই না-কি তার মনে এক ধরনের স্বাধিকার বোধ কাজ করত। জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি হঠাৎ ফিরে গেলেন ১৯৫২ সালের স্মৃতিচারণে, ‘কলেজজীবনেই রাজনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকায় দেশজুড়ে ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতির কথা জানতে পারেন হালিমা। তখনই সিদ্ধান্ত নেন ভাষা আন্দোলনে জীবন উৎসর্গ করবেন। ২১ বছর বয়সে ১৯৫১ সালে হালিমা খাতুন ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন তিনি ইংরেজী বিভাগের ছাত্রী। তখন সব বিভাগ মিলে সর্বমোট ৪০-৫০ জন ছাত্রী ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখনকার ‘উইম্যান স্টুডেন্ট রেসিডেন্টস’টি এখন রোকেয়া হল নামে পরিচিত। এই হলে সর্বমোট ৩০ জন ছাত্রী থাকত, তাদের একজন হালিমা খাতুন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রোকেয়া খাতুন ও সুফিয়া খানের সঙ্গে হালিমা খাতুন ‘হুইসপারিং ক্যাম্পেইন’-এ যোগ দেন। বায়ান্ন’র রক্তাক্ত দিনে সবাই আমতলায় সমবেত হন। এদিন ছাত্রীদের দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন স্কুল ও বাংলাবাজার গার্লস স্কুলের ছাত্রীদের আমতলায় নিয়ে আসার। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে বক্তব্য দেয়ার পর পরই সেøাগানে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’Ñ সেøাগানটির সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে প্রথম বের হয় মেয়েদের দল। তার সদস্য থাকে ৪ জন। জুলেখা, নূবী, মেতারার সঙ্গে হালিমা খাতুনও ছিলেন। একে একে বন্দুকের নলের সামনে দিয়ে মেয়েদের ৩টি দল বেরিয়ে আসে। শুরু হয় লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া। সবাই ছুটছে যে যার মতো। তবে সবার লক্ষ্য জগন্নাথ হলের এ্যাসেম্বলির দিকে। হালিমা খাতুনসহ অনেক ভাষাসৈনিক আশ্রয় নেয় মেডিক্যালে। রাস্তায় শহীদের তাজা রক্ত। আহতদের হাসপাতালে নেয়ার জন্য সবাই ছুটছে। রক্তে ভেজা রাস্তায় মানুষের মাথার মগজ ছিটিয়ে পড়া। ছাত্ররা ওই মাথার খুলির ছবি ধারণ করে, পরে সেই ছবিটি রাখা হয় ছেলেদের হলে। হলের রুমের দরজা বন্ধ। সেই বন্ধ রুম থেকে ছবিটি আনার দায়িত্ব পড়ে এই ভাষাসৈনিকের ওপর। অন্ধকার রাতে রাবেয়া ও হালিমা গিয়ে জীবনকে বাজি রেখে পুলিশের সামনে দিয়ে যায়। ছবিটি নিয়ে আসে বুকের ভেতর করে। হালিমা খাতুন জানালেন, ‘সেই দিন পুলিশের হাতে ধরা পড়লেই মৃত্যু অনিবার্য ছিল। কিন্তু মৃত্যুকে ভয় করেনি। দেশের জন্য মাতৃভাষার জন্য তারা জীবন বাজি রেখে ছবিটি এনেছিলাম। পরদিন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সেই মগজ ছিটানো খুলির ছবি ছাপানো হয়।’ আজও আমরা ফেব্রুয়ারি মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় সেই ছবিটি দেখতে পাই। কথাগুলো বলতে বলতে হালিমার কণ্ঠ রোধ হয়নি এতটুকুও। এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন সে দিনের ভয়ার্ত অভিজ্ঞতার কথাগুলো। বর্তমানে কেমন আছেন আমাদের এই নারী ভাষাসৈনিক। জানালেন, বার্ধক্যজনিত রোগে তিনি ভাল নেই। ১৯৯৯ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। অস্ত্রোপচার হলে মোটামুটি সুস্থও হন। অতি সম্প্রতি তিনি আবারও বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। বললেন, ‘শরীর অসুস্থ তবুও ভাল লাগলে লিখতে বসি। সেই আন্দোলনের কথা, জীবনের কথাগুলো লিখে রাখি। লেখালিখি করেই সময় কাটাচ্ছি। সেই সঙ্গে শিশুদের কিছু বই লিখেছি।’ সব মিলিয়ে মোট ৪০টির মতো শিশুতোষ গ্রন্থ লিখেছেন মানুষ গড়ার কারিগর ভাষাসৈনিক হালিমা খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর বিভাগের অধ্যাপনা করতেন তিনি। ১৯৯৭ সালে অবসরে যান হালিমা খাতুন। বর্তমানে লেখালেখি করেই সময় কাটাচ্ছেন তিনি। তিনি ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্দান কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। জাতিসংঘের উপদেষ্টা হিসেবে ২ বছর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার আদর্শ বর্তমান প্রজন্মের চলার পথে সাহস ও শক্তি যোগাবে। তবে বর্তমান প্রন্মের মধ্যে মাতৃভাষা চর্চা কমেছে বলে মন্তব্য করলেন হালিমা খাতুন, ‘বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি দরদ কমেছে। যে ভাষার জন্য এ দেশের শহীদেরা জীবন দিয়েছে, সে ভাষার মর্মত্ব অনুধাবন করে না তারা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কারণে এ প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাচ্ছে না। ইংরেজী ভাষার প্রাধান্যতা বেড়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষা, মায়ের ভাষা, বাংলাদেশের নাগরিক হলে অবশ্যই সবাইকে এ ভাষার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।’ আরও একজন মানুষ গড়ার কারিগর ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষা প্রতিভা মুৎসুদ্দি। ১৯৮৫ সালে শিক্ষক জীবন থেকে অবসর নিলেও ৮১ বছর বয়সে তিনি এখনও শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন। নারী উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। তিনি এখন দানবীর শহীদ রণদা প্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট অব বেঙ্গল (বাংলাদেশ) লিমিটেডের একজন পরিচালক। বর্তমানে এ সংস্থার শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন প্রতিভা মুৎসুদ্দি। সংস্থাটি কুমুদিনী উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ, ভারতেশ্বরী হোমস স্কুল ও কলেজ, কুমুদিনী নার্সিং স্কুল ও কলেজের মতো বিখ্যাত নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনা করছে। অধ্যক্ষা প্রতিভা মুৎসুদ্দি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে ১৯৭২ সাল থেকে কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের মির্জাপুর কুমুদিনী কমপ্লেক্সের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। প্রতিভা মুৎসুদ্দি ১৯৩৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার মহামুনী পাহাড়তলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৃত কিরণ বিকাশ মুৎসুদ্দি ওই সময়ের একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী ছিলেন। মা শৈলবালা মুৎসুদ্দি ছিলেন গৃহিণী। মির্জাপুরে নিজের কোয়ার্টারে বসে রবিবার সন্ধ্যায় ফোনালাপে জনকণ্ঠকে তিনি জানালেন, ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ও তার বিভিন্ন অজানা অধ্যায়ের কথাÑ শৈশবে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের পাঠশালাতে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, ভাষার দাবিতে আন্দোলনের সময়ে বেড়ে উঠেছেন প্রতিভা মুৎসুদ্দি। তার শিক্ষাজীবনের সময়টি ছিল সমাজের অবহেলিত ও নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সোচ্চারের বেগবান সময়। ১৯৫১ সালে তিনি চট্টগ্রামের ডাঃ খাস্তগীর স্কুল থেকে ১ম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৫২ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। এ সময়ে দেশব্যাপী উত্তাল ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন প্রতিভা মুৎসুদ্দি। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রী সংসদের সদস্য হন তিনি। যখন তারা জানতে পারে রাজপথে ভাষাসৈনিকদের রক্তে রাজপথ ভিজেছে। তখন তারা চট্টগ্রাম থেকেই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, মানতে হবে’। আন্দোলনে বেরিয়ে পড়েন ট্রাক মিছিলে। পরে ১৯৫৪ সলে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ১ম বর্ষ সম্পন্ন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন এবং এখান থেকে ১৯৫৬ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী লাভ করেন। রাজনীতিতে কিভাবে হাতেখড়ি হলো তার? এ প্রশ্নের উত্তরে ফোনের ওপার থেকে তিনি জানালেন, ‘রাজনীতিতে আমার হাতেখড়ি গ্রামের স্কুলে। কলেজজীবনে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম বাম রাজনীতিতে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সেবা ও কল্যাণধর্মী কর্মকা-ের সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম তখন। ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বাধিকার আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেই তখনই। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির দিন আমার অনার্স তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা ছিল। সে দিন সকাল থেকে হোস্টেলেই ছিলাম। কিন্তু বেলা ১১টার দিকে খবর আসল, ‘সকাল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে কিছু ছাত্রীদের ধরেছে, মিটফোর্ড থেকে ধরেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন ঘিরে ফেলেছে। এই খবর শুনে আমি, কামরুন্নাহার, ফরিদাসহ বেরিয়ে এলাম রাজপথে। তখন দেখি রাস্তার দুপাশে বন্দুক হাতে মিলিটারিরা দাঁড়িয়ে আছে। তখন ওদের সামনে দিয়ে আমরা কলাভবনের গেট দিয়ে ঢুকে আমতলায় গিয়ে দেখি একটা ছেলে বক্তৃতা দিচ্ছে। এরই মাঝে মিলিটারিরা লাঠিচার্জ শুরু করে দিয়েছে। হঠাৎ আমার পায়ে দুবার সজোরে আঘাত লাগল। আমি মাটিতে পড়ে গেলাম। দুজন ছেলে আমাকে ধরে কলাভবনের বারান্দায় ফেলে রাখল। পাশে লাইব্রেরি। আমি তখন কমনরুমের সেক্রেটারি ছিলাম। ভাবলাম দোতলায় গিয়ে দেখি। আস্তে আস্তে পা ফেলে এগোতেই দেখলাম বন্দুক হাতে কয়েকজন মিলিটারি ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বেরুচ্ছে। কি করব! ভাবতে ভাবতে দেখি কয়েকজন মেয়ে কলাভবনের প্রাচীর টপকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ওপারে পার হচ্ছে। কিন্তু আমার পক্ষে তো আর দেয়াল টপকানো সম্ভব নয়। আমি নিচতলার লাইব্রেরিতে গিয়ে বই নিয়ে মাথা নিচু করে পড়তে শুরু করলাম। আমার সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন এসে বসল পাশে। আসলে কিন্তু আমরা পড়ছি না পড়ার ভান করছি! বেলা বাড়তে শুরু করল। আমরা ভাবলাম বের হব কিন্তু একা বের হওয়া যাবে না। সবাই সিদ্ধান্ত নিলাম একসঙ্গে বের হব। সন্ধ্যার একটু আগে যখন গেটের বাইরে এসেছি দেখলাম, একটি মিলিটারি ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে ভ্যানে উঠতে বলল। আমরা তখন সকণ্ঠে সেøাগান দিতে শুরু করলাম। ‘ভাইবোনেরা সবাই বেরিয়ে এসো, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, আমাদের দাবি মানতে হবে’। এরপর আমাদের কয়েকজন মেয়েকে নিয়ে গেল লালবাগ থানায়। আমাদের সবার নামে ওয়ারেন্ট বানাল। এরপর রাত নয়টায় একটি হলরুমে নিয়ে আটকে রাখল। কয়েকটি কম্বল দিল, খাবারের কথা মনেও নেই। আমরা ভাবলাম সকালে বোধ হয় ছেড়ে দেবে। কিন্তু না! কেটে গেলে দু’সপ্তাহ। আমরা প্রতিদিন সকাল হলেই নিজ কণ্ঠে গেয়ে উঠতাম ‘ভুলব না ভুলব না, ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’, ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’। এরই মধ্যে আমাদের উইমেন্স হোস্টেলের কিছু মেয়েরা বইপত্র, খাবারসহ অন্যান্য সামগ্রী পাঠাতেন। এ হোস্টেলের চেয়ারম্যান ছিলেন তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ডাব্লিউ এ জেনকিন্স। এরই মাঝে তিনি বললেন, যাদের ধরেছে মিলিটারি তাদের কোন সাহায্য করা যাবে না। এরপর পরীক্ষার কয়েক দিন আগে আমাদের ছেড়ে দিল।’ বামপন্থী এই নেত্রী ১৯৫৫-৫৬ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদের (ডাকসু) মহিলা মিলনায়তন সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৬-১৯৫৭ সালে রোকেয়া হলের (তৎকালীন উইমেন্স হল) প্রথম নির্বাচিত সহ-সভানেত্রীও ছিলেন। রাজনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যেও ১৯৫৬ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান), ১৯৫৯ সালে একই বিষয়ে এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। এছাড়া ১৯৬০ সালে ময়মনসিংহ মহিলা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর রাজনীতি ছেড়ে তিনি শিক্ষকতা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিভা মুৎসুদ্দি জানালেন, ‘সে সময় নারীদের এক ধরনের দাসত্বের শিকলে বন্দী রাখা হতো। অজ্ঞানতা, কুসংস্কার ও শিক্ষাহীনতার কারণে পরনির্ভরশীল নারীরা সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত হতো। আমি সমাজের এ বৈষম্যকে দূর করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছি। একসময় রাজনীতিকে বিদায় জানিয়ে নারী শিক্ষায় স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে নারী শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করি। রাজনীতির উর্ধে কেবলই শিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি। এরপর থেকেই আমার অধ্যক্ষ জীবন শুরু হয়।’ বর্তমানে প্রতিভা মুৎসুদ্দি শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও নিজ গ্রাম মির্জাপুরে তার শিক্ষকতা চালিয়ে যাচ্ছেন। ৮১ বছর বয়সেও প্রতিভা মুৎসুদ্দি বর্তমান প্রজন্মের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে মোটেও সন্তুষ্ট নন এই ভাষাসৈনিক। জানালেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে আন্দোলন করেছিলেন। তার সুযোগ্য কন্যা এখনও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এখনও উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার পরিবর্তে ইংরেজী শেখানো হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতেও তাদের নিজেদের ইতিহাস মাতৃভাষায় শেখানো হয়, পড়ানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশের ইতিহাসও ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ অর্থাৎ ইংরেজীতে পড়ছে। বর্তমান প্রজন্মকে এখন ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে। এতে করে তারা মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস সম্পর্কে খুব ভাল করে জানতে পারছে না। এটি দেশের মানুষের ব্যর্থতা। আমার আশা, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম অবশ্যই বাংলা ভাষার ইতিহাস হারিয়ে যেতে দেবে না। তারাই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা করবে।’ সম্প্রতি তার চোখে একটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। শিগগিরই তার সুস্থতা কামনা করি। আজকের এই দিনে আমাদের সকল ভাষাসৈনিকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই, যারা রাজপথে নিজের জীবন ত্যাগ করেছেন। সেই সঙ্গে যারা আজও আমাদের সঠিক ইতিহাস জানাতে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন তাদের দীর্ঘায়ু কামনা করি জনকণ্ঠ পরিবারের পক্ষ থেকে।
×