ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

একাত্তরের পরাজিত শক্তি পাকিদের ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

একাত্তরের পরাজিত শক্তি পাকিদের ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তি পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্র এখনও শেষ হয়নি। কিছুদিন আগে তারা একটি বই প্রকাশ করে ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা করেছে। আর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে পাকিস্তানীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানী ও শহীদদের অবমাননা করেছেন। বাঙালী জাতির প্রতি চরম অবমাননা করেছেন। পাকিস্তানীদের সুরেই যেন কথা বলার চেষ্টা করছেন। বাঙালী জাতির বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মহান অর্জনগুলোকে ভবিষ্যতে কেউ যেন নস্যাৎ করতে না পারে সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকারও আহ্বান জানান তিনি। সোমবার সকালে চলতি বছরের একুশে পদকপ্রাপ্তদের মাঝে একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালের একুশে পদক বিজয়ী আপন ভুবনে গৌরবদীপ্ত ১৭ কৃতিজনের হাতে একুশে পদক তুলে দেন। ভাষা আন্দোলন, শিল্পকলা (সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, ভাস্কর্য, নাটক ও নৃত্য), সাংবাদিকতা, গবেষণা, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, সমাজসেবা, ভাষা ও সাহিত্যে এ সম্মাননা দেয়া হয়। পুরস্কার হিসেবে একটি সনদপত্র, ১৮ ক্যারেট মানের ৩৫ গ্রাম সেনার একটি পদক এবং দুই লাখ টাকার চেক বিজয়ীদের হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। জাতীয় সঙ্গীত এবং অমর একুশের গানের মাধ্যমে শুরু হওয়া পদক প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব ইব্রাহিম হোসেন খান। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম একুশে পদকপ্রাপ্ত গুণীজনদের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরেন এবং পদক প্রদান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্য, কূটনীতিক এবং বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার গুণীজন, সামরিক ও বেসামরিক উর্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ এবং এর আগে একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃতীজনরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। একুশে পদকপ্রাপ্ত কৃতীজনরা হলেন, সাংবাদিকতায় দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক ও দেশের স্বনামধন্য কলামিস্ট স্বদেশ রায় ও আবুল মোমেন, ভাষা সৈনিক অধ্যাপক ড. শরিফা খাতুন, শিল্পকলায় (সঙ্গীত) শিল্পী সুষমা দাস, শিল্পী জুলহাস উদ্দিন আহমেদ (স্বাধীন বাংলা বেতারের শিল্পী), ওস্তাদ আজিজুল ইসলাম (বংশীবাদক, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত), উদীচীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক রহমতউল্লাহ আল মাহমুদ সেলিম (সেলিম মাহমুদ), শিল্পকলায় (চলচ্চিত্র) তানভীর মোকাম্মেল, শিল্পকলায় (ভাস্কর্য) ‘অপরাজেয় বাংলার ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, শিল্পকলায় (নাটক) নাট্যশিল্পী সারা যাকের, গবেষণায় সৈয়দ আকরম হোসেন, শিক্ষায় ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী, সমাজসেবায় অধ্যাপক ডাঃ মাহমুদ হাসান, ভাষা ও সাহিত্যে কবি ওমর আলী (মরণোত্তর) ও ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া এবং শিল্পকলায় (নৃত্য) শামীম আরা নীপা। বিজয়ী সকলেই প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে পদক গ্রহণ করেন। মরণোত্তর কবি ওমর আলীর পক্ষে তাঁর ছেলে মোঃ রফি মনোয়ার আলী প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদক গ্রহণ করেন। সাম্প্রতিককালে একাত্তরের ২৫ মার্চ গণহত্যা নিয়ে মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করে পাকিস্তানের জনৈক জুনায়েদ আহমেদের বই প্রকাশ এবং সেই বই বাংলাদেশ হাইকমিশনে পাঠানোর ধৃষ্টতার ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কিছুদিন আগে একটি পুস্তক বের করে তাতে ২৫ মার্চ পাকিস্তানী বাহিনী যে গণহত্যা শুরু করেছিল যাতে এদেশীয় আলবদর, আল শামস, রাজাকাররা যোগ দিয়েছিল সে সব গণহত্যার ছবিতে মিথ্যা ক্যাপশন এঁটে দিয়ে রিপোর্ট তৈরি করে এসব হত্যাকা- পাকিস্তানী বাহিনীর নয়, মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠন করেছে বলে তারা তা প্রচারের চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আমরা স্বাধীন দেশ। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নের রোল মডেল। সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশ একটি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এখন যে অপপ্রচার তারা (পাকিস্তানী গোষ্ঠী) করে যাচ্ছে তা কারও কাছে গ্রহণযোগ্য না। কাজেই ২৫ মার্চকে আমাদের গণহত্যা দিবস হিসেবে গ্রহণ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিকভাবেও এর স্বীকৃতির জন্য আমাদের প্রচার চালাতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। একাত্তরের গণহত্যার কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময় যে জঘন্য ঘটনা তারা ঘটিয়েছে তা মানব ইতিহাসে নজীরবিহীন। দিনের পর দিন এ দেশের মানুষকে তারা হত্যা করেছে। আমাদের ৩০ লাখ শহীদ জীবন দিয়েছেন, ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম দিয়েছেন। এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য। তিনি বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের দেশের কোন কোন রাজনৈতিক দলের নেতা, আমি নাম ধরেই বলতে চাই- বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া কিছুদিন আগে বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক শহীদ হয় নাই। এর থেকে লজ্জার আর কী হতে পারে? এর থেকে জঘন্য কথা বোধহয় আর কিছু হতে পারে না। তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার এ ধরনের বক্তব্যের সঙ্গে পাকিস্তানের এ ধরনের অপপ্রচারের কোন যোগসূত্র আছে কি না আমি জানি না। কিন্তু মনে হচ্ছে ওই একই সুরে যেন তিনি কথা বলার চেষ্টা করছেন এবং এটা শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানী করা ও অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয়। গণহত্যায় মানুষের মৃত্যুর চিহ্ন সারা বাংলাদেশে এবং প্রতিটি পরিবারেরই রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা নিয়ে প্রশ্ন করা বাঙালী জাতির প্রতি চরম অবমাননা। উভয়ে একই সূরে কথা বলেছেন। এ যেন শহীদদের রক্তের সঙ্গে বেইমানী এবং শহীদদের অবমাননা করা ছাড়া আর কিছুই না। যে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি তাদের প্রতি চরম অবমাননা ছাড়া কিছুই না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালী জাতির যখন যা কিছু অর্জন তা অনেক ত্যাগের মধ্যদিয়ে, সংগ্রামের মধ্যদিয়েই আমাদের অর্জন করতে হয়েছে। কাজেই সেই অর্জনকে আমাদের ধরে রাখতে হবে। কোনমতেই কেউ যেন এই অর্জনগুলো নস্যাত করতে না পারে সে বিষয়ে সকলকে সচেতন থাকতে হবে। স্বাধীনতা ও ভাষার সংগ্রামের চেতনা যেন কেউ নস্যাত হয়ে না যায় সে বিষয়েও সবাইকে সচেতন থাকার আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী একুশে পদক বিজয়ীদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, কথায় আছে, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সেদেশে গুণীর জন্ম হয় না। আমাদের সরকার গুণীজনদের তাদের প্রাপ্য সম্মান প্রদানের বিষয়ে আন্তরিক। তিনি বলেন, আমরা সাহিত্য-শিক্ষা-কৃষি-ক্রীড়া-প্রযুক্তিসহ উদ্ভাবনাময় সকল ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অর্জনের অধিকারী ব্যক্তিত্বদের পুরস্কৃত ও সম্মানিত করে আসছি। এরই অংশ হিসেবে আজকের এই একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠান। রাষ্ট্রীয় এ পদকের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অমর একুশের নাম উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে মহান ভাষা শহীদগণ নিজেদের জীবনের বিনিময়ে একুশের সংগ্রামী ইতিহাস রচনা করেছেন, তাঁদের ত্যাগের দিকে লক্ষ্য রেখে আপনাদের মেধাকে দেশের উন্নয়ন, সমৃদ্ধ ও সার্বিক বিকাশের কাজে লাগানোর বিনীত আহ্বান জানাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর দেশের পুনর্গঠনে দেশের বুদ্ধিজীবী ও মেধাবীদের দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁর পরিকল্পনা কমিশনে দেশসেরা অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন-গবেষক, সমাজ-বিশ্লেষকদের সমাবেশ ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধু যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন, দেশের মেধাবী নাগরিকগণই তাঁদের দায়বদ্ধ ভাবনার মাধ্যমে নতুন রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়তে পারেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একুশ মানে মাথা নত না করা, মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা। একুশ মানে বাংলা, বাঙালী এবং বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও নিরন্তর ভালবাসা। বিজয়ী জাতি হিসেবে কারও কাছে মাথানত করে চলব না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামী ইতিহাসে অমর একুশে এক উজ্জ্বল এবং মহান সংযোজন। একুশের পথ বেয়েই আমরা পৌঁছেছি একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মোহনায়। নতুন প্রজন্মকেও জানাতে হবে, আমরা বিজয়ী বীরের জাতি। আমরা কারো কাছে মাথানত করে চলবো না। যেটুকু সম্পদ রয়েছে তার সঠিক ব্যবহার করেই বিশ্বের সামনে আমরা উন্নত জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে চলব। নতুন প্রজন্মকেও সেভাবেই গড়ে উঠতে হবে। মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৮ সালে ৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় সকল গণআন্দোলনের পতাকাবাহী সংগঠন ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে ছাত্রলীগ, তমুদ্দুন মজলিশ এবং আরও কয়েকটি ছাত্র সংগঠন মিলে সর্বদলীয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে ‘বাংলা ভাষা দাবি দিবস’ ঘোষণা করে ধর্মঘট ডাকা হয় এবং সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ জনগণকে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য সমগ্র দেশব্যাপী প্রচারাভিযান শুরু করে। তিনি বলেন, ধর্মঘট চলাকালে বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। সাধারণ ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে মুসলিম লীগ সরকার ১৫ মার্চ বন্দীদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তিনি বলেন, ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ভাষার দাবিতে একটি ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। পরে মিছিল নিয়ে নেতৃবৃন্দ খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে দাবিনামা পেশ করেন। কিন্তু ঐদিনই পুলিশ একদল ছাত্রের ওপর লাঠিচার্জ এবং টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। প্রতিবাদে ছাত্ররা পরেরদিন সারাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন করেন। ১৯৪৯ সালের ১৯ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু আবারও গ্রেফতার হন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জুলাই মাসের শেষে তিনি মুক্তি পান। ১৪ অক্টোবর আওয়ামী লীগ ঢাকায় ভুখা মিছিল বের করে। মিছিল থেকে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুসহ অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বলেন, ১৯৫২ সালের ২৫ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েই আবারও ঘোষণা দিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। এ সময় বঙ্গবন্ধু বন্দী অবস্থায় চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, হাসপাতালের কেবিনে প্রায়শই তিনি ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নঈমুদ্দিন এবং সাধারণ সম্পাদক খালেক নেওয়াজসহ ছাত্রনেতাদের সঙ্গে গোপনে বৈঠক করে আন্দালনের দিকনির্দেশনা দিতেন। এসব বৈঠক হত মধ্যরাতের পর। এরকম এক বৈঠকেই ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। প্রধানমন্ত্রী এ সময় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১৯৭ পৃষ্ঠা থেকে উদ্বৃত করে বলেন, বঙ্গবন্ধু লিখেছেন ‘...পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারির সেই বিয়োগান্তক ঘটনা রাতারাতি আমাদের মনন, চিন্তা-চেতনায় একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেয়। আমরা যারা পাকিস্তানী শাসনের মধ্যে বেড়ে উঠেছি, আমাদের কাছে একুশে ছিল এক অন্যরকম শক্তি, প্রেরণা, উদ্দীপনার উৎস।’ যুক্তফ্রন্টের সরকার, অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবসের স্বীকৃতি প্রদান, ঐতিহাসিক ৬ দফা, ১১ দফাসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং ’৬৯-এর ঐতিহাসিক গণঅভুত্থ্যানের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভ, একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণাসহ ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবগাঁথা তুলে ধরেন প্র্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা জাতির পিতার নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু জাতির পিতাকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট হত্যার পর দেশ উল্টোদিকে হেঁটেছে। একুশের ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মহৎ অর্জনগুলোকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ২১ বছর পর পুনরায় আওয়ামী লীগের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায় বাংলার মাটি ও মানুষের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রধানমন্ত্রী এ সময় ’৯৬ সালে সরকার গঠনের পর কানাডা প্রবাসী বাংলাদেশী প্রয়াত রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালামের সহযোগিতায় তাঁর সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ‘অমর ২১ ফেব্রুয়ারিকে’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি প্রদানের বৃত্তান্তও তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাঙালির একুশ এভাবে পরিণত হয় সারা পৃথিবী মানুষের মাতৃভাষা দিবসে। দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার সুরক্ষা বিধানে ভূমিকা রাখার দায়িত্বও এখন আমাদের ওপর অর্পিত। সেদিকে লক্ষ্য রেখে আমরা পৃথিবীর সকল ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে গবেষণা এবং সংরক্ষণ ও চর্চার জন্য আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, তৎকালীন জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানকে নিয়ে এই ইনস্টিটিউট নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও ২০০১ সাল পরবর্তী বিএনপি-জামায়াত সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যান্য উন্নয়ন কর্মসূচীর মতো এরও নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছিল। বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা ঘোষণার জন্য তাঁর সরকারের জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার তথ্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা জানেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদান করে বিশ্বের দরবারে এ ভাষার গৌরব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সরকার প্রধানের দায়িত্ব লাভ করে আমি নিজেও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নিয়মিত বাংলায় ভাষণ দিয়ে আসছি।’ সৎ ও সাহসী সাংবাদিক স্বদেশ রায় ॥ সাংবাদিকতায় গৌরবজনক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবার একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায়। কৃতী এই সাংবাদিকের জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম বলেন, স্বদেশ রায় দেশের একজন সৎ ও সাহসী সাংবাদিক। তাঁর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষণমূলক লেখা দেশে ও বিদেশে প্রশংসিত। তাঁর লেখা কলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো অনুসন্ধানী তথ্যের সমাহার। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আরও জানান, বাংলা ভাষায় প্রথম ওয়েব জার্নালিজম চালু হয় ১৯৯৮ সালে বাংলা লাইভ ডটকমের মাধ্যমে। স্বদেশ রায় এর অন্যতম পরামর্শক। দেশের বাইরে ভারতের সাউথ এশিয়া মনিটর, টাইম অব আসাম, সেভেন সিস্টার পোস্ট, সেন্টিনেল, শ্রীলঙ্কার শতবর্ষী দৈনিক ডেইলি নিউজ, শ্রীলঙ্কা গার্ডিয়ান, আইল্যান্ড, স্টেটসম্যান, ভুটান অবজারভার, মালদ্বীপের তিনটি দৈনিক, হংকংয়ের এশিয়া টাইমস এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি বাংলা দৈনিকে তিনি নিয়মিত লেখেন। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে তিনি ‘সাউথ এশিয়া এনালিসিস’ এরও একজন লেখক। শুধু সাংবাদিকতাই নয়, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ ও রাজনৈতিক বিষয়ে ২২টিরও বেশি তাঁর লেখা বই বর্তমানে বাজারে রয়েছে। বিশেষ করে স্বৈরাচারবিরোধী তীব্র আন্দোলনের সময় স্বদেশ রায়ের লেখা বই ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ সারাদেশেই তোলপাড়ের সৃষ্টি করেছিল এবং বেস্ট সেলার বই হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। এছাড়া সামরিক শাসনের সময় ৮৬ সালের দিকে তাঁর লেখা ‘একাত্তরে বিশ্বে বঙ্গবন্ধু’ বইটি মাত্র তিন মাসেই প্রথম সংস্করণের ২৫ হাজার বই বিক্রি হয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ স্বীকৃতি পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় স্বদেশ রায় জনকণ্ঠকে বলেন, আমি শুরু থেকেই দায়িত্ব ও ঝুঁকি নিয়েই সাংবাদিকতা করে যাচ্ছি। যেটা একজন প্রকৃত সাংবাদিকের প্রধান কর্তব্য। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ স্বীকৃতি পাওয়ার পরে আমি যেন সেই নীতি ও আদর্শ থেকে কখনই বিচ্যুত না হই। আগামীতে আরও ভাল ও সচেতনভাবে সাহসের সঙ্গে ঝুঁকি নিয়েই সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে পারি সেজন্য দেশবাসীর কাছে আমি আশীর্বাদ কামনা করি।
×