ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ব্লগার রাজীব হত্যার ফাঁসির আসামি রানা গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ব্লগার রাজীব হত্যার ফাঁসির আসামি রানা গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দীর্ঘ প্রায় চার বছর পর এক সহযোগীসহ গ্রেফতার হলোÑ গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ব্লগার প্রকৌশলী আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন হত্যা মামলার ফাঁসির দ-প্রাপ্ত আসামি শীর্ষ জঙ্গী নেতা রেজওয়ানুল আজাদ রানা। নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এই শীর্ষ নেতার সার্বিক পরিকল্পনায়ই হত্যা করা হয় রাজীবকে। জঙ্গী সংগঠনটির একটি আত্মঘাতী স্কোয়াড রাজীবকে নিজ বাড়ির সামনেই কুপিয়ে ও গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করে। শুধু রাজীব নয়, তার সার্বিক পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় গত কয়েক বছরে নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বেশ কয়েক জন ব্লগার, লেখক ও প্রকাশককে হত্যা করে। দীর্ঘ চার বছর রানা দেশে ও মালয়েশিয়ায় পলাতক ছিল। আজ রানাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ডের আবেদন করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের পরিবর্তে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে গড়ে ওঠেছিল গণজাগরণ মঞ্চ। এ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক রাজীবকে (৩৭) ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর পলœবী থানাধীন পলাশনগরের ৫৬/৩ নম্বর নিজ বাড়ির সামনেই জবাই করে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের জঙ্গীরা। রাজীব হত্যায় জড়িত বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্র আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। তাতে বেরিয়ে আসে রানার নাম। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাজীব হত্যা মামলায় রানার মৃত্যুদ-ের আদেশ দেন আদালত। সোমবার দুপুর দুইটার দিকে রাজধানীর উত্তরা থেকে আশরাফ নামে এক সহযোগীসহ রানাকে গ্রেফতার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। ডিএমপির মিডিয়া এ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, মঙ্গলবার রানাকে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোর্পদ করে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান জানান, রানা নিষিদ্ধ জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ নেতা এবং দুর্ধর্ষ জঙ্গী। ব্লগার রাজীব ছাড়াও ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন ও মণিপুর স্কুলের এক শিক্ষক হত্যাচেষ্টা মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামি রানা। পলাতক থেকেই রানা সিøপার সেলগুলো পরিচালনা করতো। তার নির্দেশনা ও পরিকল্পনাতেই একের পর ব্লগার-প্রকাশক ও লেখকদের হত্যা করা হয়। সিটিটিসি সূত্র বলছে, ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়, ৩০ মার্চ তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশকিুর রহমান বাবু, ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ, ৭ আগস্ট ঢাকার গোড়ানে ব্লগার নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায় নীলয়, ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যা ও ঢাকার মোহাম্মদপুরের লালমাটিয়ায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনার প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী টুটুল (৫০), লেখক এবং ব্লগার প্রকৌশলী তারেক রহিম (৪২) ও রন দীপম বসুকে (৪০) হত্যাচেষ্টা করে জঙ্গীরা। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তারা প্রাণে বেঁচে যান। সর্বশেষ গত বছরের ২৫ মার্চ কলাবাগানে অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব তনয় হত্যার ঘটনার সঙ্গে গ্রেফতারকৃত রানার কোন না কোনভাবে যোগসূত্র রয়েছে। সূত্র বলছে, রানার বাবার নাম আবুল কালাম আজাদ। মায়ের নাম মমতাজ বেগম। বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়ার উত্তর জয়লস্করপুর গ্রামে। রানা পরিবারের সঙ্গে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার আই-ব্লকের ১৮৭/সি নম্বর বাসায় থাকতো। ১৯৮৮ সালের ২৬ আগস্ট জন্ম নেয়া রানা ঢাকার আইডিয়াল স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে ২০০৫ সালে এসএসসি ও নটরডেম কলেজ থেকে ২০০৭ সালে এইচএসসি পাস করে। এরপর নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়। নর্থ সাউথে পড়ার সময় সে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি মাওলানা জসীমুদ্দিন রাহমানীর ঘনিষ্ঠ সহচর ছিল সে। রানার মাধ্যমে নর্থ সাউথ ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। রানা প্রযুক্তিবিদ্যালয় দক্ষ। বাংলার পাশাপাশি সে ইংরেজী ও আরবী ভাষাতেও দক্ষ। এসব কারণে দ্রুত আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ওঠে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে জঙ্গীদের দিয়ে গঠিত সিøগার সেল পরিচালনায় বিশেষ পারদর্শী ছিল। মালয়েশিয়ায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থাতেই দেশের অভ্যন্তরে থাকা জঙ্গী সংগঠনটির সিøপার সেলগুলো একের পর হত্যাকা- ঘটিয়েছে। প্রসঙ্গত, রাজীব হত্যায় বেসরকারী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দ্বীপ (২২), এহসান রেজা ওরফে রম্মন (২৩), মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক (২৩), নাঈম শিকদার ওরফে ইরাদ (১৯) ও নাফিজ ইমতিয়াজ (২২) আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। পরে এ মামলার আরেক আসামি সাদমান ইয়াছির মাহমুদ (২০) ঢাকার কলাবাগান থানাধীন ভুতের গলি থেকে গ্রেফতার হয়। পলাতক ছিল রানা। ২০১৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাজীব হত্যা মামলায় ঢাকার ৩ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সাঈদ আহম্মেদ ওই মামলার রায়ে গ্রেফতারকৃত রানা ও ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপের ফাঁসির রায় দেন। বাকি আসামিদের মধ্যে একজনের যাবজ্জীবন কারাদ- এবং আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানীসহ পাঁচজনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ দেন বিচারক। নিম্ন আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে সাত আসামির আপিলের রায় যে কোন দিন ঘোষণা করা হবে। পলাতক থাকায় রানা হাইকোর্টে আপিল করার সুযোগ পায়নি।
×