ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যাকারীদের গণহত্যা অস্বীকারের অপচেষ্টা

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

গণহত্যাকারীদের গণহত্যা অস্বীকারের অপচেষ্টা

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আরেকটি দীর্ঘদিনের দাবি- ‘২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা’ অর্জনের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক কবীর চৌধুরী স্মারক বক্তৃতার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম রূপকার, মুজিববাহিনীর নেতা বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। নির্মূল কমিটির আলোচনা সভার বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশের গণহত্যার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।’ এদিন বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে নির্মূল কমিটির ১৭৫তম প্রকাশনা ‘অন রেকগনিশন অব বাংলাদেশ জেনোসাইড’-এর মোড়কও উন্মোচন করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। প্রকাশনার তারিখটি আগেই নির্ধারিত ছিল। এর আগের দিন কাকতালীয়ভাবে আমাদের হাতে এসেছে পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোডেড।’ বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসরদের সর্বজনবিদিত নৃশংসতম গণহত্যার নির্লজ্জ অস্বীকৃতির এই গ্রন্থের লেখক জুনায়েদ আহমেদ, যিনি গত ৪৫ বছর কখনও এ বিষয়ে কিছু লিখেছেন আমাদের নজরে পড়েনি। তবে একই ধরনের বই পাকিস্তান থেকে আগেও বেরিয়েছে, যার সর্বশেষটি হচ্ছে ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ান : ফ্যাক্টস এ্যান্ড ফিকশন।’ পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে ভারতীয় শর্মিলা বসুও বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও নারী নির্যাতন অস্বীকার করে লিখেছেন ‘ডেড রিকনিং : মেমোরিজ অব দি নাইন্টিন সেভেন্টি-ওয়ান বাংলাদেশ ওয়ার।’ বোধগম্য কারণেই পাকিস্তান ১৯৭১ সাল থেকে এই গণহত্যা অস্বীকার করার জন্য দেশে ও বিদেশে বহু অর্থ ব্যয় করে বহু বয়ান তৈরি করেছে, যা সর্বকালে ঘাতকরা সর্বদা করে থাকে। নির্মূল কমিটির ১৫ ফেব্রুয়ারির আলোচনা সভায় বর্তমান সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেছিলাম, বাংলাদেশের গণহত্যার জন্য পাকিস্তানীদের বিচার না করলে, গণহত্যাকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি না দিলে তাদের ধৃষ্টতাপূর্ণ মিথ্যাচার অব্যাহত থাকবে এবং এমন সময়ও আসতে পারে যখন তাদের মিথ্যা বয়ান নতুন প্রজন্ম সত্য বলে মেনে নেবে। তাকে অনুরোধ করেছিলাম ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার জন্য। সভার অন্যতম আলোচক মুনতাসীর মামুন স্বভাবসুলভ পরিহাসের সঙ্গে বলেছেন, বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক হাত ধোয়া দিবসও পালন করা হয়, অথচ আমাদের এত বলার পরও জাতীয় গণহত্যা দিবস সরকারীভাবে এখনও ঘোষিত হলো না। আলোচনা সভায় পাকিস্তানী জুনায়েদ আহমেদের বই থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে একটি ছবিও দেখিয়েছিলাম। ’৭১-এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার নিদর্শন হিসেবে দেশে ও বিদেশে যে ছবি বহুবার ছাপা হয়েছে- রিক্সার ওপর কয়েকটি লাশের দৃশ্য, জুনায়েদের বইয়ে একই ছবির নিচে ক্যাপশন দেয়া হয়েছে ‘মুক্তিবাহিনীর বর্বরতার নিদর্শন’ হিসেবে। পাকিস্তানী ধৃষ্টতা ও মিথ্যাচারের এই জঘন্য নমুনা সে দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’ ইসলামাবাদে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে পাঠিয়েছে ‘সৌজন্যের নিদর্শন’ হিসেবে। ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্মূল কমিটির আলোচনা সভায় কানাডার বিশিষ্ট মানবাধিকার নেতা এ্যাটর্নি উইলিয়াম স্লোন বলেছেন, সাধারণত অপরাধীরা নিজেদের কৃতকর্ম সম্পর্কে আলোচনা করে না আত্মগ্লানির কারণে। বাংলাদেশের গণহত্যার দায় নিজেরা অস্বীকার করে এর জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করে পাকিস্তান যে অপরাধ করছে তার চেয়ে অনেক বেশি অপরাধ এবং ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছে এই কদর্য মিথ্যাচারের দলিল ‘সৌজন্যের সঙ্গে’ বাংলাদেশের দূতাবাসে পাঠিয়ে। অত্যন্ত পেশাদার আজন্ম অপরাধী ছাড়া এ ধরনের হীনমানসিকতা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। এদিন আলোচকদের ভেতর আরও ছিলেন ব্রিটিশ সমাজকর্মী বাংলাদেশের গণহত্যার একজন প্রত্যক্ষদর্শী জুলিয়ান ফ্রান্সিস, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতার কন্যা ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা ও কবীর চৌধুরী স্মারক বক্তৃতা প্রদানকারী গণহত্যা গবেষক মফিদুল হক। সভার সঞ্চালক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বরেণ্য লেখক সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের কন্যা অভিনয়শিল্পী শমী কায়সার, সভাপতি ছিলেন সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের প্রাক্তন বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী। বক্তারা সবাই অত্যন্ত কঠোর ভাষায় পাকিস্তানের এই ঔদ্ধত্যের নিন্দা করেছেন এবং অবিলম্বে পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি ‘২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। সভার প্রধান অতিথি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জানিয়েছেন, তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন। সেদিন সভা শেষ করে উইলিয়াম স্লোনকে নিয়ে বাংলা একাডেমির বইমেলায় গিয়েছিলাম। এক ঘণ্টা পর একজন সাংবাদিক টেলিফোন করে জানালেন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে তোফায়েল ভাই অত্যন্ত জোরালো ভাষায় ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণার দাবি জানানোর পাশাপাশি পাকিস্তানের ধৃষ্টতার নিন্দা করেছেন। নির্মূল কমিটির সভা থেকে সংসদে যাওয়ার সময় তোফায়েল ভাই পাকিস্তানী জুনায়েদ আহমেদের বইটি আমার কাছ থেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। সংসদে গিয়েই তিনি বইটি প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতি পাকিস্তানের এই চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী পরিমাণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন তার প্রতিফলন ঘটেছে জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের পর তার বক্তব্যে। ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা করা হবেÑ এটিও প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেছেন। ব্রিটিশ সমাজকর্মী জুলিয়ান ফ্রান্সিসের সঙ্গে পরদিন দেখা হয়েছিল। তিনি বললেন, আপনাদের আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে আমি বাড়ি ফিরে টেলিভিশনে দেখি তোফায়েল আহমেদ পাকিস্তানী অপপ্রচারের বিষয়ে বলছেন। তারপর প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও ঘোষণাও শুনেছি। আমাদের দাবি কত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী ছিল এটা তারই প্রমাণ। ’৭১-এর গণহত্যা নিয়ে জুলিয়ান ফ্রান্সিস অনেক লিখেছেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত আমাদের গণহত্যা সংক্রান্ত গ্রন্থে জুলিয়ান ফ্রান্সিস, উইলিয়াম স্লোন ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রাক্তন সদস্য পাওলো কাসাকা’র লেখা গ্রন্থিত হয়েছে। ১৬ তারিখে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এবং টেলিভিশনের আলোচনায়ও বলেছি নির্মূল কমিটির ‘অন রেকগনিশন অব বাংলাদেশ জেনোসাইড’ নিঃসন্দেহে পাকিস্তানী মিথ্যাচারের দাঁতভাঙ্গা জবাব। পাকিস্তান সরকার যতই অস্বীকার করুক, সে দেশের বহু সচেতন নাগরিকও ১৯৭১ সালে এবং তারপর এই গণহত্যার নিন্দা করেছেন এবং এর জন্য পাকিস্তান সরকারকে ক্ষমা চাইতে বলেছেন। আমাদের গ্রন্থে পাকিস্তানের কবি ও সাংবাদিক আহমদ সেলিমেরও একটি লেখা আছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদ করে লাহোরের সেলিম ’৭১ সালে কারা নির্যাতন ভোগ করেছেন। ২০০৮ ও ২০১৬ সালে নির্মিত আমার প্রামাণ্যচিত্র ‘ওয়ার ক্রাইমস সেভেন্টি ওয়ান’ ও ‘জার্নি টু জাস্টিস’-এ পাকিস্তানের বেশ কয়েক লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী ’৭১-এর গণহত্যার জন্য নিজেরা ক্ষমা চেয়েছেন, তাদের সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে বলেছেন এবং বাংলাদেশে গণহত্যাকারীদের চলমান বিচার সমর্থন করেছেন। গণহত্যা অস্বীকার করে জুনায়েদ আহমেদ ৫০০ পৃষ্ঠার বই লিখেছেন। এই গণহত্যার ভয়াবহতা, ব্যাপকতা এবং এর সঙ্গে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ সম্পর্কে পাকিস্তানের সচেতন নাগরিকরা যা লিখেছেন সেগুলো একত্র করলে জুনায়েদ আহমেদের বইয়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মত্যাগের বিরুদ্ধে, গণহত্যার ভুক্তভোগীদের উপহাস করে পাকিস্তানের আইএসআই যে জঘন্য বই ছেপেছে এবং সরকারীভাবে দেশে দেশে বিলি করছে সকল মহল থেকে এর তীব্র নিন্দা করা প্রয়োজন। ১৫ এপ্রিলের আলোচনা সভায় আমি বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার পাকিপ্রেমের কথাও বলেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে তার পাকিস্তানপ্রেম গোপন কোন বিষয় নয়। ১৯৭১ সালে রণাঙ্গনে যারা যুদ্ধ করেছেনÑ সব সেক্টর কমান্ডার তাদের স্ত্রী ও পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন। একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছেন বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া। তার স্বামী জেনারেল জিয়াউর রহমান বাধ্য হয়ে কিংবা অন্য যে কোন কারণে হোক যুদ্ধে যে অংশ নিয়েছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি একাধিকবার তার সহধর্মিণীকে নেয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠিয়েছিলেন, বেগম জিয়া যাননি। তিনি পাকিস্তানী সামরিক ছাউনিতে পাকিস্তানী জেনারেলদের আতিথ্যে আরামে দিন কাটিয়েছেন। তার সেই পাকিস্তানপ্রেমের অভিব্যক্তি দেখেছি ১৯৯১ সালে যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন। পাকিস্তানী জেনারেল জানজুয়ার মৃত্যুর পর যাবতীয় কূটনৈতিক, রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার ও রীতিনীতি লঙ্ঘনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এবং মর্যাদা জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন। তখন পাকিস্তানে আমাদের পরিচিত মহল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার এহেন পাকিস্তানপ্রেমে বিস্মিত হয়েছিলেন। জানজুয়া ’৭১-এর পরাজিত পাকিস্তানী জেনারেল। কোন সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান পরাজিত জেনারেলের মৃত্যুতে শোকবার্তা পাঠায় না। বেগম জিয়ার শোকবার্তা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। খালেদা জিয়ার মান রাখার জন্য নওয়াজ শরীফকে বাধ্য হয়ে প্রয়াত পরাজিত জেনারেল জানজুয়ার জন্য শোক জ্ঞাপন করতে হয়েছিল। জুনায়েদের বই নিয়ে পাকিস্তানে অনেক আলোচনা ও লেখালেখি হচ্ছে। জুনায়েদ বলেছেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভারতীয় ও বাংলাদেশী বয়ান খ-ন করার জন্য এ বই লিখেছেন। এ বই নিয়ে করাচীর আলোচনা সভায় এবং সেখানকার গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিদ্বেষী প্রচারণা নবজীবন লাভ করেছে। এক আলোচক এমনও লিখেছেন, জুনায়েদের বই পড়ে মনে হয়েছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে পাকিস্তান ভুল করেছে। ভুট্টো স্বীকৃতি না দিলে বাংলাদেশের অবস্থান তাইওয়ানের মতো হতো। বিএনপির পাকিস্তানপ্রেম সম্পর্কেও জুনায়েদ আহমেদ এবং তার বন্ধুরা লিখেছেন। তারা দাবি করেছেন, শেখ মুজিবের পররাষ্ট্রনীতি ছিল ভারতঘেঁষা, পক্ষান্তরে জেনারেল জিয়ার নীতি ছিল পাকিস্তানঘেঁষা। পাকিস্তানের আইএসআই যে বিএনপিকে নিজেদের দল মনে করে এ নিয়ে বছর পাঁচেক আগে সেখানকার কিছু কলাম লেখকও পরিহাস করেছেন। পাকিস্তানের একনিষ্ঠ পূজারী, ’৭১-এর গণহত্যাকারী জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার অনেক আগে থেকেই বিএনপির পাকিস্তানপ্রেম কখনও গোপন থাকেনি। বেগম জিয়ার পাকিস্তানপ্রেমের চরম বহির্প্রকাশ ঘটেছে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে, যখন তিনি সরকারীভাবে ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে জানিয়ে দিয়েছেনÑএ ক্ষেত্রে জুনায়েদ আহমেদ ও আইএসআইর অবস্থানের সঙ্গে তার অবস্থানের কোন পার্থক্য নেই। বেগম জিয়ার দলের নেতারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের দেশপ্রেম সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেছেন, বিদ্রƒপ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃত ইতিহাস অস্বীকার করার প্রবণতা ও উদ্যোগ নিরুৎসাহিত করার জন্য আমরা দাবি জানিয়েছিলাম, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রচলিত হলোকস্ট ডিনায়াল এ্যাক্টের মতো আমাদের দেশে ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার অপরাধ আইন’ প্রণয়নের জন্য। এ বিষয়ে আইন কমিশন ও আইনমন্ত্রীকে স্মারকপত্রও দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবার জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি দিবস ঘোষণা যেমন জরুরী, একইভাবে শহীদদের সংখ্যা বা আত্মদান নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন বা তামাশা করা স্বাধীন বাংলাদেশে গুরুতর অপরাধ গণ্য করে শাস্তির ব্যবস্থা না করলে গণহত্যাকারী এবং তাদের সহযোগীরা উৎসাহিত হবেÑ হোক তারা এ দেশের কিংবা পাকিস্তানের। ২৫ মার্চ কেন আমরা জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা করতে বলেছি এ নিয়ে গত ২৪ বছরে অনেক লিখেছি। ’৭১-এর বিদেশী পত্রিকার সংবাদ উদ্ধৃত করে বলেছি ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানীরা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর নামে শুধু রাজধানী ঢাকায় দশ হাজার থেকে এক লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালীকে হত্যা করেছিল। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর যেসব কর্মকর্তা তখন ঢাকায় ছিলেন তাদের অনেকের আত্মজীবনীতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর সাফল্যের কথা বলতে গিয়ে গণহত্যার ব্যাপকতার কথা উল্লেখ করেছেন। আমরা ২০০৫ সাল থেকে ‘২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার জন্য আন্তর্জাতিক জনমত সংগঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। এ বিষয়ে আমরা জাতিসংঘে চিঠিও দিয়েছিলাম। আমাদের মতো আরও কিছু দেশÑ যারা গণহত্যার ভিকটিম, তারাও তাদের গণহত্যা দিবসকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ সবার আবেদন বিবেচনা করে মূল উদ্দেশ্যের বিষয়ে একমত হয়ে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ‘গণহত্যা কনভেনশন’ (কনভেনশন অন দি প্রিভেনশন এ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দি ক্রাইম অব জেনোসাইড) ঘোষণা করেছিল। আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের ঘোষণায় জাতিসংঘ বলেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণহত্যায় নিহতদের স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানাবার পাশাপাশি গণহত্যার বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য একটি দিবস পালন প্রয়োজন। জাতিসংঘের এই ঘোষণার পর ২৫ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হওয়ার কোন সুযোগ না থাকায় আমরা এ দাবি থেকে সরে এসেছি। জাতিসংঘের ঘোষণা সম্পর্কে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না দেখে আমরা ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেছিলামÑ ‘২০১৫ সাল থেকে জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভিন্ন দেশ সরকারীভাবে ৯ ডিসেম্বর ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ পালন করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে বিশ্বের গণহত্যার ইতিহাসে নৃশংসতম গণহত্যা বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ পালন দূরে থাকুক নিজ দেশে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানকে স্মরণ করার জন্য একটি দিবস আজও ধার্য করা হয়নি। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গত ২৪ বছর ধরে ২৫ মার্চ গণহত্যার কালরাতে পালন করছে এবং সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছে বাংলাদেশে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জন্য। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনা হত্যাকারী জামায়াত-বিএনপি সরকার এটা করেনি বোধগম্য কারণে। বর্তমান মহাজোট সরকারের মন্ত্রীরা প্রতি বছর ২৫ মার্চ রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমাদের অনুষ্ঠানে এসে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যান, শীঘ্রই তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন; কিন্তু আজ পর্যন্ত তা করা হয়নি। ’৭১-এ গণহত্যাকারীদের বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার স্বদেশে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অত্যন্ত প্রশংসিত হয়েছে। গত শতাব্দীতে যেসব দেশ ও জাতি গণহত্যার শিকার হয়েছে অথচ গণহত্যাকারীদের বিচার করতে পারেনি তারা এখন তাকিয়ে আছে বাংলাদেশে গণহত্যাকারীদের বিচারের সাফল্যজনক পরিসমাপ্তির দিকে। ‘আমরা আশা করব বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলমান গণহত্যার নিন্দা এবং গণহত্যার ভিকটিমদের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা প্রকাশ এবং গণহত্যাকারীদের বিচারের যৌক্তিকতা তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ সরকারীভাবে ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস এবং বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন করবে।’ গত ১৯-২১ জানুয়ারি (২০১৭) নির্মূল কমিটির ৭ম জাতীয় সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে আমরা আবারও ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস এবং ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস পালনের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম। যার ধারাবাহিকতা ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারির আলোচনা সভা ও গণহত্যা বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ, যা বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনে সহায়ক হবে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য আমাদের বিভিন্ন দেশের পার্লামেন্টে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব পাশের ব্যাপারে তদ্বির করতে হবে। ১৫ তারিখে জাতীয় সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর ইতিবাচক বক্তব্যের পর ‘সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম’ এবং আরও কিছু সংগঠন ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবসের পাশাপাশি ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনেরও দাবি জানিয়েছে। ‘সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম’-এর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘যেহেতু ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালরাতের ভয়াবহ ঘটনাবলীসহ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের নির্বিচারে গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের ইতিহাস বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে সংরক্ষিত ও স্বীকৃত সেহেতু দিনটিকে (২৫ মার্চ) আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আন্তর্জাতিক মহলের কাছে জোর দাবি উত্থাপন করা উচিত।’ (সংবাদ, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯১৭) এ দাবি তিন বছর আগে করলেও সমীচীন হতো, এখন এর কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই। কারণ গত দুই বছর ধরে ৯ ডিসেম্বর সারা বিশ্বে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। ’৭১-এর গণহত্যার দায় অস্বীকার এবং এর জন্য বাংলাদেশকে দায়ী করে পাকিস্তান যে জঘন্য তৎপরতা চালাচ্ছে তার প্রধান কারণ যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার প্রশ্নবিদ্ধ করা, যা বাংলাদেশে তাদের বিশ্বস্ত এজেন্ট জামায়াত-বিএনপি জোট গত সাত বছর ধরে করছে। পাকিস্তান জানে যে, কোন সময়ে ঢাকার ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে’ তাদের পরীক্ষিত সৈনিক জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধীদেরও বিচার আরম্ভ হবে। এই বিচার সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াবার জন্য তারা যাবতীয় কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যে কদর্য অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে তার বিরুদ্ধে সরকারের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও কঠোর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ প্রয়োজন। এ বিষয়ে পাকিস্তানের সচেতন জনগণকেও অবহিত করতে হবে। বার বার সতর্ক করার পরও বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশসমূহে পাকিস্তান সন্ত্রাস রফতানি অব্যাহত রেখেছে। পাকিস্তান যদি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এ ধরনের ঘৃণ্য তৎপরতা বন্ধ না করে তাহলে তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হবে। এর পাশাপাশি পাকিস্তানের সন্ত্রাস রফতানিসহ যাবতীয় দুর্বৃত্তপনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে তুলে ধরার জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। ’৭১-এ পাকিস্তানের নৃশংসতম সামরিক বাহিনীকে আমরা বাংলাদেশের মাটিতে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেছিলাম। আজ পাকিস্তান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে। পাকিস্তান যদি ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে এ দেশটিকে ইতিহাস নির্ধারিত ধ্বংস থেকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭
×