ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অমর একুশে

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অমর একুশে

একুশ মানে মাথানত না করা। কথাটির যথার্থতা বার বার প্রমাণিত এই বাংলাদেশে। একুশ শিখিয়েছে অন্যায়-অবিচার ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, প্রতিরোধী হওয়ার। প্রতিরোধের আগুন জ্বলে দ্বিগুণ দারুণ... আনে মুক্তি, আলো আনে শত প্রাণে। বায়ান্নর সেই ঐতিহাসিক একুশে ফেব্রুয়ারি ৬৪ বছর পেরিয়ে ৬৫ বছরে পদার্পণ করেছে। অমর একুশের চেতনা আজও অমলিন তবুও। সেদিন মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলার তরুণরা মাতৃভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে স্বাজাত্যবোধের যেই মশাল প্রজ্বলিত করেছিলেন, সেই আলো দেশের সীমানা অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক পরিম-লেও। এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে। মাতৃভাষার জন্য আত্মদানের এমন নজির বিশ্বে আর নেই। রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে একুশের প্রভাব এতটাই সর্বব্যাপী যে, ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। আত্মপরিচয় বিস্মৃত জাতিকে স্বরূপের সন্ধান দিয়েছে। জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ করেছে যেমন একুশে, তেমনি জুগিয়েছে অপরিমেয় শক্তি ও সাহস। অদম্য আত্মবিশ্বাসে করেছে বলীয়ান। একুশ বাঙালীর আবহমানকালের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন রতœভা-ারের সঙ্গে যুক্ত করেছে। দিয়েছে সঠিক পথের সন্ধান। একুশের পথ ধরে তাই গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী পেয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক এক দেশ। বাঙালী ও বাংলাদেশ যতদিন থাকবে ধরার বুকে, ততদিন থাকবে অমলিন বাংলা ভাষা ও একুশে। কারণ একুশের শিকড় গ্রোথিত বাঙালীর চেতনার গভীরে। একুশ বাঙালীকে অন্যায়-অবিচার ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। তাই এ দেশের মানুষ কখনই সামরিক ও স্বৈরশাসনের কাছে মাথানত করেনি। আপোস করেনি গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে। আর এসব কিছুরই প্রেরণা হয়ে আছে একুশে। বাঙালীর জীবনজুড়ে একুশ ভালবাসার অনন্য প্রতীক হয়ে আছে। সে ভালবাসা শুধু মাতৃভাষা প্রীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং বাঙালীর ঐতিহ্য সংস্কৃতি হতে শুরু করে যা কিছু মহৎ ও মানবিক সর্বত্রই বিস্তৃত তার মমতাময়ী ডানা। উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ আলোকের ঝর্ণাধারা হয়ে ধুইয়ে দেবে সব কালিমা। কিন্তু সেই ভাষাকে ভালবেসে বাংলা ভাষায় পুরোপুরি প্রচলন করা যায়নি। যেহেতু বাংলা ভাষার আর্থিক মূল্য দাঁড়াচ্ছে না, তাই বিশ্বমানবের কাছে অবস্থান পোক্ত হয়ে উঠতে পারছে না। উচ্চ আদালতসহ দাফতরিক কাজে স্বাধীনতার পর বাংলা চালু হলেও পঁচাত্তরÑ পরবর্তী সামরিক জান্তা শাসকের সময়ে বাংলাভাষা সঙ্কুচিত হতে থাকে আর বাড়ে ইংরেজীর প্রাদুর্ভাব। সরকার বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি তুললেও এ খাতে ব্যাপক অর্থ সংস্থানের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। যেমন সম্ভব হয়নি উচ্চশিক্ষার প্রতিটি স্তরে বাংলাভাষাকে অপরিহার্য করে তোলা। তথাপি একুশ আসে বাঙালীর প্রাণের আবাহনে, সাহসের বরাভয়ে। প্রতিবারই একুশ আসে নিত্যনতুন চেতনা নিয়ে, আসে শপথ নিয়ে। সেই শপথ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার আবাহনে এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিপক্ষে দাঁড়ানোর। একুশ শক্তি ও সাহস জোগায় প্রতিবারই বাঙালীর চিত্তজুড়ে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালীকে একাত্তরের মতো প্রতিরোধী সাহসে শত্রুকে প্রতিহত করার প্রেরণাই জোগায়। একুশ মৌলবাদ, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাসবাদ, দুর্নীতি, নাশকতা, নৃশংসতার বিরুদ্ধে আপোসহীনতার লড়াইয়ের প্রেরণা হয়ে এসেছে। বাঙালী এই দিনে আবার জেগে উঠছে বিজয়ের মন্ত্রে।
×