ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পোড়ামাটির ঘর-সংসার

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

পোড়ামাটির ঘর-সংসার

গৃহ সজ্জার ইতিহাস মানুষের গৃহে বসবাসের সমান্তরাল। গৃহে বসবাসের শুরু থেকেই মানুষ নিজের ঘরকে সাজাতে চেয়েছে মনের মত করে। আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজানো ঘর যেন নিজেকেই সাজিয়ে তোলা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গৃহ সজ্জার ধারনায় এসেছে পরিবর্তন। আর এখনতো গৃহসজ্জা রীতিমত প্রফেশনালদের ব্যপার। বিস্তর অর্থ খরচ করে মানুষ কিনছে গৃহসজ্জার ধারনা। তাদের পরামর্শ মত সাজাচ্ছে গৃহ। সেখানে কতটুকু প্রাণের ছাপ থাকছে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ, তারপরও মানুষ সাজাচ্ছে তার স্বপ্নের ঘর। লিখেছেন- আকিল জামান ইনু আপনার গৃহসজ্জায় স্বদেশী ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছাপ রাখতে সম্প্রতি জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে ইউনেস্কো রকফান্ড এন্ড ট্রাস্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় কারুশিল্পী পরিষদ আয়োজন করেছিল এক নতুন ধারনায়, পোড়ামাটির টেরাকোটা প্রদর্শনী। এ প্রদর্শনীর মূল বৈশিষ্ট্য ছিল এখানে অংশগ্রহনকারী সবাই বংশানুক্রমিকভাবেই মূলত মাটির হাড়িপাতিল তৈরির সঙ্গে জড়িত। তবে জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ নয় মাসের নির্ধরিত সময়ে প্রশিক্ষন প্রদান করে তাদের সামনে খুলে দিয়েছেন মৃৎ শিল্পের নতুন দুয়ার। অনন্য নান্দনিকতায় তারা ফুটিয়ে তুলেছেন প্রাচীন বাংলার ঐতিহ্য, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহারের কিছু নিদর্শন। সেই সঙ্গে তারা নিজের মত করেই তৈরি করেছেন বিভিন্ন পোড়া মাটির সামগ্রী। যা নিশ্চিতভাবেই আপনার গৃহসজ্জায় দেবে ভিন্ন মাত্রা। আর আপনার সামান্য সহযোগিতা পোড়ামাটিতে ঘর-সংসার চালানো এই প্রান্তিক মৃৎশিল্পীদের জীবনে আনতে পারে কিছুটা সাচ্ছন্দের ছোঁয়া। উল্লেখ্য যে এই মানুষগুলো উঠে এসেছেন ধ্বংসপ্রায় হেরিটেজ সাইট পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার সংলগ্ন দুটি গ্রাম মিঠাপুর ও জামালপুর থেকে। মেলায় এসছেন কার্তিক পাল। বয়স ৪০। কাজ করছেন প্রায় ২৫ বছর। পারিবারিক পেশা মাটির হাড়ি-পাতিল তৈরি। কিন্তু দিন চলছিল না তাতে। জাতীয় কারুশিল্পী পরিষদে প্রশিক্ষণ নিয়ে এই মৃৎ-শিল্পী মেলায় নিয়ে এসেছেন তিন ধাপের ‘ঘাট পুতুল’। যা আপনার গৃহকোন স্থাপিত হয়ে তাতে দেবে ভিন্ন মাত্রা। সঙ্গে আছে ফলক আর টেপা পুতুল। পোড়ামাটির এই শিল্পী বাংলার মাটির মতই সরল। মেলায় সেই সারল্য নিয়ে ক্রেতাকে জানিয়ে দিচ্ছিলেন, ‘ আপা এইটা নিয়েন না, এটাতে সমস্যা আছে’। এসেছেন কোমল চন্দ্র পাল। গ্রাম মিঠাপুর জেলা নওগা। কাজ করছেন ১৮ বছর। আপনার শো’কেজে সহজেই ঠাই পেতে পারে উঠ, ময়ূর, ঠিয়া ও পিঠে তাদের বাচ্চা। শিল্পীর প্রিয় নীল রঙে রাঙানো ঘোড়া। আছে পাখি টব। মূল্য- ৭০০ টাকা। আপনার বারান্দার বাগানে সহজেই ঠাই করে নেবে পাখির আকারে তৈরি করা এই টব। মমতা রানী এসছেন পালপাড়া মিঠাপুর থেকে। আগে তৈরি করতেন মুড়ি ভাজার পাতিল, মাটির কলশ। এবারে মেলায় এনেছেন মনের রঙে রাঙিয়ে ভালবাসার জোড়া পুতুল। আর আছে করলা টব, আনারস টব। মূল্য- ১৫০ টাকা। সুপথ চন্দ্র পাল, এই মৃৎ শিল্পী এখন সংসার চালাতে দই’য়ের হাড়ি বানান। কিন্তু অন্তরে বসতি শিল্পের। জামালপুর পাল পাড়ার এই শিল্পীর মেলাতে মূল আকর্ষন ছিল, মাটির মুক্তি বাহিনী। সঙ্গে মাছ, ঘোড়া, হাতি, পাখি বানিয়েছেন নিজের মনের মত করে। যা সহজেই ঠাই করে নিতে পারে আপনার গৃহসজ্জা সামগ্রীর তালিকায়। পাহাড়পুড়ের ১২‘শ বছরের সেই পুরোনো মাটির প্রদীপ নিয়ে এসেছেন পালপাড়া জামালপুরের অজিত চন্দ্র পাল। সঙ্গে আছে শঙ্খ আর কয়েক ধাপের কলশি। ৫৭ বছর বয়সি সন্ধ্যা রানী পাল। মেলাতে এনেছেন, পোড়া মাটির কোল ব্যাঙ, অসাধারন নকশার মাটির পাতিল। বয়স তাকে কাবু করে নি। দারিদ্রের কাছে নন পরাজিত। এবয়সে এসেও দৃঢ় স্বরে বলেন, ‘জাতি ব্যবসা না করলে ভালোলাগে না’। আপনার গৃহ সজ্জায় পালপাড়া জামালপুরে অসাধারন সব ফুলদানী এমন এক মাত্রা যোগ করতে পারে যা আগে কখনও ছিল না। কবিতা রানী পালের অসাধারন পোড়া মাটির টেবিল ল্যাম্প, বিশ্বনাথ পালের সারা পুতুলের সেট, চাকা লাগানো ঘোড়া আর টেরাকোটার ফলক উঠে আসে মাটির ঘ্রাণ নিয়ে। শ্রীনাল চন্দ্র পালকে উল্লেখ করতেই হয় মাটির পাত্রের মুখে চারপাশে বাহারী পুতুল যোগ কওে উপস্থাপনের জন্য। আমিন চন্দ্র পাল যিনি নিয়ে এসেছেন অসাধারন সব পুতুল, শাখ আর শঙ্খ। মেলায় ছোট্ট মেয়ে আদুরী সুিজয়ে বসেছিল তার পোড়া মাটির শিল্পকর্মের সংসার। তার দিকে বাড়ানো আপনার হাত যেমন আপনার ঘরের কোনকে করে তুলবে সুন্দর তেমনি স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পারে তার পোড়া মাটির ঘর-সংসারে।
×