ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণের উৎসব বইমেলা

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

প্রাণের উৎসব বইমেলা

দাদার হাতে হাত রেখে নতুন পাঠক নাতি। বিকেল পরতেই অমর একুশের গ্রন্থমেলায়। ভাঁজ করা বইয়ে ছোট্ট ফর্দ ভেনিটিব্যাগে ভরে প্রেমিকের হাত ধরে বঙ্গ ললনা। সমস্তপাড়া মাথায় করে হাসি ঠাট্টার উল্লাসে দলে দলে ডুকছে, নবীন বইপ্রেমীদের দল। ঘুরচ্ছে, স্টলে স্টলে নতুন বই দেখচ্ছে। জনাকীর্ণ মেলার কোনায় দাঁড়িয়ে হাস্যরসের আড্ডা দিচ্ছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে এখন স্বামী সংসারে ব্যস্ত রমনী। এখন বইপড়ার অভ্যাস ভুলে গেলেও ভাষার মাস তাকে মনে করিয়ে দেয়, ভুলে যাওয়া প্রিয় অভ্যাসের কথা। বইপড়া হোক বা না হোক স্বামী সন্তান নিয়ে মেলায় আসতে, বই কিনতে ভুল করছেন না। বাড়ির ছোট্ট শিশু থেকে প্রবীণ সকলেই আসছে প্রাণের উৎসব অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। বাঙালীর আর পাঁচটা সার্বজনীন উৎসবের মতোই বর্ণিল হয়ে উঠেছে এই উৎসব। গ্রন্থ পাঠে সারা বছর মনোযোগ না থাকলেও ফেব্রুয়ারি মাসে বইয়ের সঙ্গে আমাদের বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। যদিও অনেক কারণে সারা বছর এই সখ্য থাকে না। তবুও ভেতরের তাগিদে অল্প সময়ের জন্য হলেও আমরা বইপাগল হয়ে যাই, এই মেলার সুবাদে। বই অন্তর-আত্মার ক্ষুধা নিবারণ করে। মনের স্বাস্থ্য ভাল রাখে। আমাদের জীবসত্তাকে পরিণত করে মানব সত্তায়। যখন থেকে মানুষের ভেতর সভ্য হওয়ার চেতনা জাগ্রত হয়েছে, তখন থেকে মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজেছে সভ্য হওয়ার বাহ্যিক চেতনাকে। কালের পথে বই-ই মানুষের এই চেতনাকে বাস্তব কাঠামোতে রূপ দিয়েছে। মানুষ এখন আলোকিত প্রাণী তাদের জ্ঞান চক্ষুর কারণে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের কারণেই সম্ভব হয়েছে। এসবের সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। বই সভ্যতার সব রূপকে বদলে দিয়েছে। বিশেষ করে ছাপার যন্ত্র আবিষ্কারের পর। ভাষা হিসেবে বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধ। মায়ের কাছ থেকে পাওয়া এই মিষ্টি-মধুর ভাষা আমাদের অনেক দাম দিয়ে আপন করতে হয়েছে। দিতে হয়েছে অমূল্যপ্রাণ। এমনি ফাগুন দিনে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে, আমরা লিখেছিলাম ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা। মাতৃভাষার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানাতে প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা একাডেমিতে আয়োজিত হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা। অজস্র পায়ের ধূলিতে, প্রাণের টানে মুখরিত করছি আমাদের এই মেল। আমাদের বইমেলা এখন আগের তুলনায় বড় পরিসরে আয়োজিত হচ্ছে। এটা অবশ্য আমাদেরই কারণে। স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরা ছাত্রছাত্রী থেকে বইপাগল সবাই আসছেন মেলায়, কিনছেন পছন্দের সব বই। প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ, উষ্ণ সান্নিধ্য। সবই মিলছে জ্ঞানপিপাসুদের। লাভ-ক্ষতির হিসাব বাদ দিয়ে বাহারি স্টলের পসরা সাজিয়ে রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে মেলার মাধুর্য বাড়াচ্ছেন বই প্রকাশকরা। সারা বছর মস্তিষ্কের শক্তি ক্ষয় করে কলমের কালি দিয়ে ভেতরের কথাগুলো বাইরে বের করেন মননশিল্পী। তাদেরও এখন সুসময়। এখন মেলার বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে নতুন বইয়ের গন্ধ। দু’দিন বাদেই একুশে ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যাবে বইমেলা। দর্শনার্থীদের ভিড়ে মেলা এখন পুরোপুরি জমে উঠেছে। বইয়ের বিক্রিও বেশ ভাল। কয়েকজন প্রকাশকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়। দেশের সার্বিক অবস্থা ভাল থাকায় এবারের মেলা বেশ ভাল যাচ্ছে। বইয়ের বিক্রিও অন্যবারের তুলনায় ভাল। লাইনে দাঁড়িয়ে সুশৃঙ্খল সারিবদ্ধ হয়ে মেলায় প্রবেশ করছে বইপ্রেমীদের দল। উপহার দিচ্ছে প্রিয় মানুষকে পছন্দের বই। অশুভ শক্তির কালো ছায়া থেকে নিজেকে এবং সমাজকে দূরে রাখতে মনের ভেতর শুদ্ধতা থাকা দরকার। বই মানুষের আত্মাকে শুদ্ধ করে। সময়ের স্রোতে অনেক কিছু ভেসে গেলেও জ্ঞানচর্চা কখনও ভেসে যাবার নয়, তাহলে সভ্যতাই পড়বে নতুন সঙ্কটে। অনেক কিছুর বদলের সঙ্গে আমাদের অভ্যাসের কিঞ্চিত বদল ঘটেছে। এই যেমন আগে আমরা বই মানে সুন্দর প্রচ্ছদ ভাল ছাপা মোটা বা পাতলা বইয়ের বদলে ই-বুকে পাঠের চেষ্টা করছি। কিন্তু সৃজনশীল মননের জন্য পুস্তকের বিকল্প নেই। বই আছে, থাকবে সঙ্গে বাড়বে আরও অনেক বইমেলার সংখ্যা এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের।
×