ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরের যুদ্ধশিশু ১০

মার্টিন রিবেইরো জেনে যেতে পারেননি তার জন্ম ইতিহাস

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মার্টিন রিবেইরো জেনে যেতে পারেননি তার জন্ম ইতিহাস

রাজন ভট্টাচার্য ॥ যুদ্ধশিশুদের মধ্যে যাদের কানাডায় দত্তক নেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে একজনই নিজের জন্মের ইতিহাস সম্পর্কে জানতেন না। স্কুল জীবন থেকেই তিনি মূলত মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীর মতো অবস্থা ছিল তার। মূলত এসব কারণেই বিয়োগান্তক জন্মের ইতিহাস জানাতে রাজি ছিলেন না দত্তক বাবা-মা। মানসিক চাপ থেকে দূরে রাখতেই মূলত পরিবারের পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। অর্থাত পালক বাবা-মায়েই ছিল তার আসল পরিচয়। জন্মের ঠিকানা। সবকিছুর পর যখন ছেলেটি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করেছিলেন তখন অনেকটাই আশাবাদী হলেন পরিবারের সবাই। কর্মজীবনও ভালই যাচ্ছিল তার। সবকিছু জয় করতে পারলেও মৃত্যুকে জয় করতে পারেননি সমর। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। যে বাবা-মা তাকে জীবনের সবটুকু ভালবাসা উজাড় করে দিয়ে আগলে রেখেছিলেন। মানুষ করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে খুঁজে বেড়িয়েছেন ভাল চিকিৎসকের ঘর। বিয়ে করিয়েছেন! এতসব কিছুর পরও সব মায়া মমতাকে ছিন্ন করে চলে যান তিনি। কোন বন্ধন তাকে আগলে রাখতে পারেনি। সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ২০১৩ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে চলে যান সমর। এর মধ্য দিয়েই শেষ হয় যুদ্ধশিশু সমরের বেঁচে থাকার গল্প। সমর থেকে মার্টিন ॥ কানাডায় আসার পর সমরের নামে কিছুটা পরিবর্তন আসে। পালক বাবা-মা তার নাম দেন মার্টিন রিবেইরো। নতুন নামকরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে রাখা নামটি একেবারেই মুছে যায়। বেশির ভাগ যুদ্ধশিশুর মতো মার্টিন অপরিণত বয়সেই জন্ম নেন। ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল জন্ম নেয়া সমরের ওজন হয়েছিল মাত্র এক কেজি। যখন তাকে কানাডায় নেয়া তখন তার বয়স তিন মাসের কিছু বেশি। তখন দত্তক বাবা-মায়ের কাছে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জ ছিল শিশুটিকে বাঁচানো। এই ভাবনা থেকেই তারা শিশুটিকে পুষ্টিকর খাবার দেয়া শুরু করেন। সমর ধীরে ধীরে সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। স্কুল যাত্রা ॥ অপুষ্টির ধকল কেটেছে। এবার শিক্ষা জীবন শুরুর পর্ব। তাই কিউবেকের হাল শহরের স্থানীয় এলিমেন্টারি স্কুলে ভর্তি করা হয় তাকে। শুরু হলো স্কুল জীবনের আনুষ্ঠানিকতা। সে সময় তার বাবা-মা সমরের মধ্যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করেন। এতে তারা বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন। এটা ছিল পরিবারের জন্য লাল পতাকা অর্থাত বিপদ সংকেতের শামিল। তারা তখন বুঝতে পারেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে মার্টিন পড়াশোনার বিষয়ে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন। দিন দিন সমরের স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ পতন ঘটেছিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছেলেকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যান বাবা-মা। দফায় দফায় ডাক্তার দেখানো হয়। ছেলেকে সুস্থ করে তুলতে প্রাণান্ত চেষ্টা চালানো হয়েছে পরিবারের পক্ষ থেকে। খোঁজ করা হয়েছে ভাল ভাল ডাক্তারদের ঠিকানা। সব মিলিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মার্টিনের অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। এতে আশায় বুক বাঁধতে শুরু করেন তারা দত্তক বাবা-মা। ‘৭১-এর যুদ্ধশিশু অবিদিত ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক মুস্তফা চৌধুরীকে মার্টিনের বাবা রোবের্তো বলেন, সমর তার শিক্ষণের অসুবিধায় ভোগার কারণে তার জন্মদেশ সম্পর্কে নিরুৎসাহিত। অর্থাত তিনি কখনও এ বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখাননি। তিনি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন, যে দেশে তার জীবনের প্রথম ৯০ দিন অতিবাহিত হয়েছে কিন্তু অবাক হলেও সত্য যে মার্টিনের সে বিষয়ে কোন জিজ্ঞাসা নেই। তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে কখনও কিছু জানতে চাননি। সবকিছুই অজানা তার ॥ মার্টিনের বাবা জানান, তিন মাস বয়সে দত্তক হিসেবে গৃহীত এবং ককেশীয় বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদের সঙ্গে মেলামেশার ফলে উপমহাদেশীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয়দের সঙ্গে মেলামেশার কোন সুযোগই পাননি। স্বভাবতই মার্টিনকে কখনও ভিন্ন একটি পরিচিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। যেমনটি কানাডার অন্যান্য জাতিগতভাবে পৃথক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বেলায় হয়ে থাকে। মার্টিনের বাবা-মায়ের মতে, সমরের আগ্রহের অভাব তার জীবনের প্রথম দিকে শিক্ষায় যে প্রতিবন্ধকতা ছিল, সে কারণের জন্যই। সে আলোকে দেখে এবং তার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে তার বাবা-মা কখনই বেশি চাপের মুখে তাকে ঠেলে দিতে চাননি। কারণ, তাতে সমরের দুঃখ কষ্ট বাড়বে ছাড়া কমবে না। মার্টিনের শারীরিক অবস্থা যখন খারাপের দিকে যাচ্ছিল তখন তার ওপর নতুন করে বোঝা চাপাতে চাননি বাবা-মা। তারা মনে করতেন, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী, তার জন্ম ঘিরে বিয়োগান্তক যে কাহিনী, ত্যাগ ও কানাডাতে দত্তক আনায় বিষয়গুলো কখনই ছেলের সামনে আনা যাবে না। মার্টিন পরিষ্কারভাবে জানেন না, তিনি কোথা থেকে কিভাবে এসেছেন। এ নিয়ে তাকে কেউ বললে, তিনি বিব্রতবোধ করেন। বিষয়টি নানা কায়দায় এড়িয়ে যান। তিন মাস বয়স থেকে কিউবেকে বসবাস করায় মার্টিনের কাছে বাংলাদেশ বহু দেশের এক দেশ। স্বভাবতই বাংলাদেশ বা বাংলাদেশীদের বিষয়ে কখনও কোন রকম আবেগীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এ জায়গায় এসে মার্টিন তার সঙ্গে যেসব যুদ্ধশিশু কানাডায় এসেছিল তাদের থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়ান। অন্যরা যেখানে তাদের জন্মদেশ হিসেবে বাংলাদেশের ওপর নানা বই পড়েছেন। অনেক কিছু জানতে চেয়েছেন। আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন জন্মভূমিকে। মার্টিন কখনও একটা পুস্তিকা বা ইতিহাসের বই যা স্কুল কলেজের পাঠও পড়েননি। স্বভাবতই তিনি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কখনও কোন কাল্পনিক যোগাযোগও স্থাপন করেননি। কানাডাকে তিনি ‘হোম’ বলেন। অর্থাত তার শেকড়। তবে সব রকমের শারীরিক বাধা সত্ত্বেও মার্টিন স্বাবলম্বীর পথে অনেকদূর যেতে পেরেছিলেন। বড় বড় সফলতা এসেছে তার জীবনে। হাইস্কুলের গ-ি পেরোতে না পারলেও তিনি একটি সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। সেই আয় দিয়েই মার্টিন স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন চালাতেন। রোবের্তো বলেন, কয়েক বছর আগে মার্টিন বিয়ে করেন। তিনি নিজস্ব পরিবার গড়ে তোলেনি। নিজেকে নিয়ে বেশ আনন্দেই দিন কাটাচ্ছিল। মার্টিন সর্বদাই তার অর্জন নিয়ে গর্বিত ছিলেন। দুর্ভাগ্যের কথা ॥ ভালই চলছিল মার্টিনের জীবন। মানুষের জীবনে সব সকাল এক রকম আসে না। এটা সত্য হয়েছে তার ক্ষেত্রেও। ২০১৩ সালের জুলাই মাসে মার্টিন হঠাত করেই হৃদরোগে আক্রান্ত হন। কোন পিছুটান তাকে ফেরাতে পারেনি। কোন ভালবাসা তাকে জয় করতে পারেনি। শত চেষ্টাকে তিনি দূরে ঠেলে দিয়েছেন। সব আশাকে পরিণত করেছিলেন নিরাশায়। অবশেষে সবাইকে কাঁদিয়ে তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। এর মধ্য দিয়েই মার্টিনের জীবন ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে। তার জন্মের ইতিহাস যেমন নির্মম মৃত্যুর ঘটনা ঠিক তেমনিই। তার জীবনের আরও কিছু ঘটনা ও মার্টিনকে বাংলাদেশ থেকে নেয়াসহ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চেয়ে লেখক মুস্তফা চৌধুরী দত্তক পরিবারের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেছিলেন। তার বাবা-মায়ের স্পষ্ট বক্তব্য, ছেলেকে দত্তক নেয়ার বিষয়টি একেবারেই ব্যক্তিগত। তাদের মতে, এটা সম্পর্কে প্রকাশ্যে আলোচনা করা ঠিক নয়। যদিও লেখক ও মার্টিন একই এলাকায় বসবাস করতেন। অনেক আগে থেকেই তাকে চিনতেন। সময় অসময়ে দেখা হতো তার সঙ্গে। কিন্তু পরিবারের নিষেধের কারণে লেখক কখনই মার্টিনের মুখোমুখি হতে চাননি। যুদ্ধশিশুদের নিয়ে বিব্রত ছিল সরকার ॥ দক্ষিণ আমেরিকার কলম্বিয়া থেকে আগত রোবের্তো এবং তার স্ত্রী মার্গো ফরাসী ও কানাডীয়। দুজনেই কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিতে (সিআইডিএ) ১৯৬০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। এই দম্পতি জাতিগতভাবে বিভিন্ন অনাথদের দত্তক নিতে গভীরভাবে আগ্রহী ছিলেন। তারা স্বাভাবিকভাবে জন্ম নেয়া শিশুদের সমাহারে পরিবার তৈরিতে বিশ্বাসী। তারা দত্তক নেয়ার মাধ্যমেই সন্তান নিতে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। সেটাকে তারা মনে করতেন পরিবার গঠনের আরেক উপায়। তাদের প্রথম সন্তান ম্যারি হেলেনের জন্মের পর রিবেইরোরা সিদ্ধান্ত নিল তারা আরেকটি সন্তান নেবে। ১৯৭১ সালের শেষদিকে তারা পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতা সম্পর্কে জানত। একই সময়ে তারা ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেনের (এফএফসি) সঙ্গে স্বেচ্ছাশ্রমের কাজে যুক্ত হন। রোবের্তো সংস্থার বিভিন্ন কল্যাণকর কাজের খবর রাখার সঙ্গে বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের রক্ষা করার যে প্রস্তাবিত প্রকল্প তারও খবর রেখেছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে রোবের্তো তখন সিআইডিএ’র এনজিও ডিভিশনের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে একদল জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার কাজে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। যারা ওই সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের চলমান বিভিন্ন ঘটনার ওপর নজর রাখছিলেন। ১৯৭২ সালের প্রথমদিকে সিআইডিএ যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পুনর্গঠনের কাজে নিয়োজিত ছিল। ব্যক্তিগতভাবে রোবের্তো ও মার্গারেট দু’জনেই জানতেন, বাংলাদেশ সরকার তখন যুদ্ধশিশুদের জন্ম, পরিত্যক্ত হওয়া এবং মৃত্যু নিয়ে বিব্রত ছিল। এনজিও ডিভিশনের প্রধান হিসেবে রোবের্তো এ ব্যাপারে একটা কিছু করতে চেয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় এফএফসি’র মাধ্যমে একটি যুদ্ধশিশুকে দত্তক নেয়ার জন্য আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পাঠান তারা। শেষ পর্যন্ত সমরকে দত্তক পান। রিবেইরো পরিবারে ছিল পাঁচ সন্তান। তাদের মধ্যে একজন তাদের ঔরসজাত। বাকি চারজনকে আনা হয়, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম হাইতি ও কলম্বিয়া থেকে। মার্টিনের পারিবারিক সূত্রগুলো বলছে, সে যখন বড় হচ্ছিল ঠিক তখনই মানসিক সমস্যার শুরু। তার মা-বাবা এমনকি অনেক বিষয়ে তিনি চিন্তা করতেন যেসব ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের কোন হাত ছিল না। যেমন মায়ের নিম্নমানের খাবার, গর্ভাবস্থায় পুষ্টির অভাব, অবহেলা এবং প্রাক প্রসব যতেœর অভাবে ক্ষতি হওয়া ইত্যাদি। যদিও মার্টিনের এসব চিন্তা করার বিষয়টি ধারণা থেকে বলা হয়। বস্তুত এর সঠিক কোন ভিত্তি পাওয়া যায়নি।
×