ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অনেক স্কুলের শিক্ষক নিজের কাজে লাগাচ্ছেন ল্যাপটপ

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অনেক স্কুলের শিক্ষক নিজের কাজে লাগাচ্ছেন ল্যাপটপ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম থাকলেও হচ্ছে না তার যথাযথ ব্যবহার। অনেক স্কুলের শিক্ষকরা ল্যাপটপগুলো বাড়িতে বা স্কুলে রেখে ব্যক্তিগতভাবে ব্যবহার করছেন। অনেকেই আবার প্যাকেটে করে আলমারিতে ভরে রেখেছেন। স্কুলে কেউ পরিদর্শনে আসলেই শুধু বের করেন। প্রজেক্টরসহ অন্য সরঞ্জাম অফিসে রাখা হচ্ছে প্যাকেটজাত করে। অল্পসংখ্যক স্কুলই প্রতিদিন মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহার করছেন। চার মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদফতরের মনিটরিং এ্যান্ড ইভালুয়েশন উইং ৯ জেলার ১২ উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে যে রিপোর্ট দিয়েছে তাতেই বেরিয়ে এসেছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের এই দুরবস্থার চিত্র। আইসিটি ফর এডুকেশন ইন সেকেন্ডারি এ্যান্ড হায়ার সেকেন্ডারি লেভেল প্রজেক্টের আওতায় দেশের ২৩ হাজার ৩৩১টি স্কুল, কলেজিয়েট স্কুল ও মাদ্রাসায় একটি করে ডিজিটাল শ্রেণীকক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি করে ল্যাপটপ, স্পিকার, ইন্টারনেট মডেম, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্ক্রিন সরবরাহ করা হয়েছে। একজন করে শিক্ষককে ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। আর এই প্রকল্প সম্পন্ন করতে ব্যয় হয়েছে ৩০৫ কোটি ৬৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ প্রতিটি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনে সরকারের ব্যয় হয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা। ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপনের কাজ শেষ হয়। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসে প্রতিদিন ছয়টি করে ‘পিরিয়ড’ নেয়া হয়। সেই হিসেবে প্রতিটি ক্লাসেরই প্রতিদিন একটি করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে ক্লাস হওয়ার কথা এবং তা ড্যাশবোর্ডে (মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম সংক্রান্ত ওয়েবাইট) উঠানোর কথা। কিন্তু এখন পর্যন্ত চারটি জেলায় মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের সন্তোষজনক ব্যবহার হয়েছে। বাকিদের ব্যবহারের হার খুবই কম। আবার অনেক স্কুলই নিয়মিত মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমে ক্লাস করানোর কথা ড্যাশবোর্ডে তুললেও বাস্তবে ক্লাস নিচ্ছেন না। জানা গেছে, মাউশি অধিদফতরের মনিটরিং এ্যান্ড ইভালুয়েশন উইংয়ের পাঁচজন কর্মকর্তা চট্টগ্রামের আনোয়ারা, যশোরের সদর উপজেলা, নীলফামারির সৈয়দপুর উপজেলা, দিনাজপুরের সদর ও খানসামা উপজেলা, নড়াইলের সদর উপজেলা, সিলেটের সদর ও দক্ষিণ সুরমা উপজেলা, বরিশালের বাকেরগঞ্জ ও গৌরনদী উপজেলা, ভোলার তজুমুদ্দিন উপজেলা এবং বগুড়ার শেরপুর উপজেলায় পরিদর্শনে যান। সেখানে তারা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহারের করুন অবস্থা দেখতে পান। মনিটরিং এ্যান্ড ইভালুয়েশন উইংয়ের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোঃ সেলিম মিয়া পরিদর্শন করেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার কৈনপুরা উচ্চ বিদ্যালয়। সেখানে তিনি দেখতে পান দীর্ঘদিন ধরে ল্যাপটপটি অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। শিক্ষকদের আইসিটি সম্বন্ধে ধারণাও কম। যশোর সদর উপজেলার নূতন খয়েরতলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনে দেখতে পান তারা ঠিকমতো মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ব্যবহার করেন না। অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মাহবুবা ইসলাম নীলফামারির লায়ন্স হাই স্কুল, হাজারীহাট স্কুল এ্যান্ড কলেজ, সোনাখুলি মুন্সিপাড়া কামিল মাদ্রাসায় দেখতে পান শিক্ষকদের আইসিটি সম্বন্ধে ধারণাই খুব কম। ফলে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহার হচ্ছে না। দিনাজপুরের অপর চারটি বিদ্যালয় পরিদর্শন করেও তিনি একই অবস্থা দেখতে পান। সহকারী পরিচালক মোঃ শামীম আহসান খান নড়াইল ও দিনাজপুরের ছয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন শেষে দেখতে পান মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ব্যবহার হচ্ছে না এবং তা ব্যবহার করার জন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের তৎপরতাও নেই। এমনকি জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তারাও এ বিষয় খুব একটা মনিটরিং করেন না। সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আশিকুল ইসলাম সিলেট সদর উপজেলায় সাউথ সুরমা উচ্চ বিদ্যালয় এবং দক্ষিণ সুরমা নছিরা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের খুব একটা ব্যবহার করেন না। প্রতিষ্ঠানগুলোর ডকুমেন্টেশন ব্যবস্থা সম্বন্ধেও খুব একটা ধারনা নেই। বরিশালের তিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ভোলার তজুমুদ্দিন উপজেলার তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সিলেটের তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন, তারা তেমনভাবে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহার করছেন না। প্রোগ্রামার প্রণব বিষ্ণু মজুমদার বরিশালে চার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন, টরকী বন্দর ভিক্টোরী মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও গাউছিয়া আবেদীয়া আলিম মাদ্রাসার ল্যাপটপগুলো অকেজো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বগুড়ার মেরপুর ডি. জে. মডেল হাই স্কুল, শেরপুর শহীদিয়া কামিল মাদ্রাসা, সামিট স্কুল এ্যান্ড করেজ এবং পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ল্যাবরেটরি স্কুল এ্যান্ড কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন, কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের রুটিন নির্দিষ্ট করা নাই। ফলে শিক্ষকদের ইচ্ছে হলে মাঝেমধ্যে এই ক্লাসরুম ব্যবহার ব্যবহার করেন। মনিটরিং এ্যান্ড ইভালুয়েশন উইংয়ের কর্মকর্তারা তাদের সুপারিশে বলেছেন, সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাস ব্যবহারের পাশাপাশি ড্যাশবোর্ডে এন্ট্রি দেয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করা যেতে পারে। যাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাউশি অধিদফতর, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এটুআই প্রকল্প ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম মনিটরিং করতে পারে। মাল্টিমিডিয়া ক্লাসের ব্যবহার ও ড্যাশবোর্ড এন্ট্রির জন্য উপজেলা পর্যায়ে ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। জেলা ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহারে তদারকি আরও বাড়াতে হবে। প্রতি বছর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়া জেলা প্রশাসক সম্মেলনেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের ব্যবহার নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানানো হয়। তবে এর আগে জেলা প্রশাসকরা একাধিক বিদ্যালয়ে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে একাধিকবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন। সেখানেও দেখা যায়, বেশিরভাগ শিক্ষকরাই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও ডিজিটাল কন্টেন্টের ব্যবহারের সঙ্গেই পরিচিত নয়। ল্যাপটপটির ব্যক্তিগত ব্যবহার হলেও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ও স্ক্রিন র‌্যাপিংকৃত অবস্থায়ই রয়েছে। এমনকি অনেক শিক্ষার্থীই মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কী তা জানেন না। জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারাও পরিদর্শন করে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের বিষয়ে পরামর্শ দেন না। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের এক প্রতিবেদনেও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের অনিয়মিত ব্যবহারের কথা বলেছে। মন্ত্রণালয় ও মাউশির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২৩ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করেই আইসিটি প্রকল্প শেষ হয়েছে। কিন্তু মনিটরিং বা পরিদর্শনের জন্য আলাদা কোন প্রকল্প রাখা হয়নি। একটি স্কুল থেকে একজন শিক্ষককে মাত্র ১২ দিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকরা মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ঠিকমতো চালাতে পারছেন না। মাউশি অধিদফতরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক মোঃ এলিয়াছ হোসেন বলেন, এখন ওয়েবসাইটে লাখো কন্টেন্ট রয়েছে। সেখান থেকে কন্টেন্ট নিয়ে ইচ্ছে করলেই শিক্ষকরা পড়াতে পারছেন। চারটি জেলায় প্রায় শতভাগ মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ব্যবহার হচ্ছে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও বাড়ছে, দিন দিন ব্যবহার বাড়ছে। তবে পাঁচ লাখ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া খুব সহজ নয়। শিক্ষকদের নিজ উদ্যোগেও শিখতে হবে। নতুন যেসব শিক্ষক যোগদান করছেন তারা যথাযথ ব্যবহার করছেন। তবে এই ক্লাসরুমের পুরোপুরি ব্যবহার নিশ্চিত করতে আরও সময়ের প্রয়োজন।
×