ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই দর্শক আসে বরকত জাদুঘরে

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই দর্শক আসে বরকত জাদুঘরে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ অন্যান্য মাসে ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘরে দর্শনার্থীর দেখা না মিললেও ফেব্রুয়ারি মাসে দর্শনার্থীর সমাগম বাড়ে এই জাদুঘরে। ভাষার মাস উপলক্ষেই দর্শনার্থীর এ সমাগম। রবিবার দুপুর ১২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলসংলগ্ন পলাশী চৌরাস্তার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আবুল বরকতের স্মৃতিগুলো দেখছিলেন বেশ কয়েকজন দর্শনার্থী। তাদের মধ্য থেকে প্রবাসী নারী জানালেন, সম্প্রতি তিনি লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছেন। পুরান ঢাকার ঢাকেশ্বরী রোডে তার বাসা। দেশে এলেই তিনি তার সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে ঢাকা শহর ঘুরে দেখেন। বললেন, ‘পলাশীর এ রাস্তায় যাওয়ার সময় অনেকবার এই জাদুঘরটি চোখে পড়লেও আসা হয়নি। আজ সময় করে এলাম আমার সন্তানদের নিয়ে। আমরা যারা প্রবাসী তাদের মন দেশের জন্য, মানুষের জন্য, বাংলাভাষার জন্য কাঁদে। যে ভাষার জন্য রফিক, সালাম ও বরকত প্রাণ দিল তাদের কথা আরও বেশি মনে পড়ে। এবার ভাষার মাসে যেহেতু দেশে এসেছি তাই ভাষাশহীদদের স্মৃতিটুকু অন্তত দর্শন করে যেতে না পারলে আফসোস নিয়ে ফিরতে হতো। শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘরে তখন মাত্র চারজন দর্শনার্থী। বাইরে ভিজিটর খাতা নিয়ে বসে আছেন একজন নিরাপত্তারক্ষী। তিনি জানালেন, বছরের অন্যান্য সময় দর্শনার্থীর সংখ্যা কম থাকে। তবে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলে দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ে। এখানে আসা বেশিরভাগ দর্শনার্থীই স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। জানা গেল, চলতি বছরের শুরু থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়ে পাঁচজনের কম দর্শনার্থী জাদুঘর ও সংগ্রহশালাতে এসেছে। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যাঁরা বাংলাভাষা রক্ষার দাবিতে রাস্তায় নেমে আসেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম আবুল বরকত। যাঁরা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও অন্যতম তিনি। যার জন্য তিনি সবার কাছে পরিচিত শহীদ আবুল বরকত নামে। তাঁর এ আত্মত্যাগের স্মরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পলাশীতে নির্মিত হয়েছে শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালার নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর। ২০০৯ সালের ১৬ জুন এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। বাংলা একাডেমির দ্বিতীয়তলায় ২০১০ সালে ‘বাংলা একাডেমি ভাষা আন্দোলন জাদুঘর’ গড়ে তোলা হয়। জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাদুঘরের মোট চারটি কক্ষের পুরোটাই ভাষাআন্দোলনের নানা স্মৃতি এবং সামগ্রী সাজিয়ে রাখা আছে। এ জাদুঘরের চারটি কক্ষে ভাষাশহীদ রফিকের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার সার্টিফিকেট, ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের ব্যবহৃত কোট, বাংলাভাষায় মুদ্রিত প্রথম গ্রন্থের পৃষ্ঠা, কায়েদ আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর কাছে রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের স্মারকলিপি ও ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের প্রিয় চটের ব্যাগটিও এখানে সংরক্ষিত আছে। এছাড়াও আমাদের ভাষাআন্দোলনের ইতিহাস প্রেক্ষাপট, ঘটনাবলি সম্পর্কিত বিভিন্ন লেখকের বইয়ের প্রচ্ছদ, সে সময়ে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সংখ্যা ও বিভিন্ন আলোকচিত্র সংরক্ষিত আছে এখানে। শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও জাদুঘরের প্রদর্শক মোঃ গোলাম মোস্তফা জনকণ্ঠকে জানান, ‘শহীদ বরকতের ব্যবহৃত কাচ-পিরিচ, ব্যবহৃত ঘড়ি, হাতে লেখা চিঠি, ভাষাআন্দোলনের ওপর ডকুমেন্টারি, একুশে পদক (মরণোত্তর) ও তার ছবি রয়েছে এখানে।’ এছাড়া, ভবনের নিচতলায় তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও ছবি রাখা হয়েছে। ওপর তলায় একটি পাঠাগার করা হয়েছে। পাঠাগারে ভাষাআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ওপর পাঁচ শতাধিক বই রাখা হয়েছে। আরও বই সংগ্রহের কাজ চলছে বলে জানালেন জাদুঘরের পরিদর্শক। আবুল বরকত ১৯২৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাক নাম আবাই। তিনি ১৯৪৫ সালে তালিবপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৪৭ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। দেশ ভাগের পর ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ১৯৫১ সালে একই বিভাগ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক সম্মান ডিগ্রী লাভ করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে বিক্ষোভরত ছাত্রজনতার ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। এতে আবুল, বরকত গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়। মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মত্যাগ করার স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ২০০০ সালে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন ভাষাশহীদ আবুল বরকত।
×