ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ভাষা বিজ্ঞান, গবেষণা ও অনুবাদ সংশ্লিষ্ট পদগুলো পূরণ হয়নি

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ইউনেস্কোর লোগো ব্যবহার করতে পারছে

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট ইউনেস্কোর লোগো ব্যবহার করতে পারছে

আনোয়ার রোজেন ॥ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট গত বছর থেকে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি ইউনেস্কোর লোগো ব্যবহার করতে পারছে। প্রতিষ্ঠার ছয় বছরের মধ্যে জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থার ক্যাটাগরি-২ প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া অন্যতম অর্জন। এদিকে ইনস্টিটিউট পরিচালনার জন্য অনুমোদিত জনবল কাঠামো আছে ৯১ জনের। কিন্তু ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও ভাষা বিজ্ঞান, গবেষণা ও অনুবাদ সংশ্লিষ্ট পদগুলো পূরণ করা যায়নি। তবে অন্যদের সহযোগিতা ও সীমিত লোকবল দিয়েই এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটি থেকে করা হয়েছে বাংলাদেশের নৃ-ভাষার বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা। পাঁচ বছর আগে প্রতিষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে নির্মাণ করা হয় ভাষা জাদুঘর। এরপর থেকে জাদুঘরে সংযোজিত হয়নি নতুন কোন উপকরণ। তাই ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতেও ভাষা জাদুঘর দর্শনার্থী শূন্য! তবে দর্শনার্থীদের আগ্রহ বাড়াতে ভাষাবিষয়ক তথ্য ও নিদর্শনগুলোর ভার্চুয়ালাইজেশনের কাজ প্রায় সম্পন্ন। এমন অর্জন, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়েই এগিয়ে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষার প্রসার, বিলুপ্তপ্রায় ভাষার ইতিহাস সংরক্ষণের মতো গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য সামনে রেখে ২০১০ সালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইনস্টিটিউটের অবকাঠামো আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু এর গবেষণা ও অন্যান্য কার্যক্রম এখনও আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হতে পারেনি। তবে গত ছয় বছরে ইনস্টিটিউটের যা অর্জন সেটিকে ‘সন্তোষজনক’ বলেই মনে করেন এর মহাপরিচালক অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী। রবিবার নিজ কার্যালয়ে জনকণ্ঠের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি বলেন, কেবল ভাষাচর্চার জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইনস্টিটিউটের অগ্রগতি সন্তোষজনক। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এর বড় প্রমাণ। জনবলের অভাব ছিল শুরু থেকেই। বর্তমানে জনবল বাড়ানোর কাজ চলছে। প্রথম দিকে এখানে ভাষা বিষয়ে বিশেষায়িত জনবল কাঠামো ছিল না। এ সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে প্রথম শ্রেণী ও তদুর্ধ্ব কর্মকর্তা নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। শিগগিরই এসব নিয়োগ চূড়ান্ত করা হবে। প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সম্পর্কে ইমতিয়াজ আলী বলেন, প্রায় ৫ বছর ধরে কাজ করে প্রতিষ্ঠানটি থেকে বাংলাদেশের নৃ-ভাষার বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা করা হয়েছে। এটি বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় বই আকারে ২০ খ-ে প্রকাশ করা হবে। এটি জটিল ও সময় সাপেক্ষ কাজ। বর্তমানে এর প্রথম দুই খ- প্রকাশের কাজ চলছে। তিনি আরও জানান, বাংলা উপভাষা সংগ্রহ ও সংরক্ষণের কাজও এগিয়ে চলছে। সব মিলিয়ে নতুন ছয়টি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হচ্ছে। দুটি এরই মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকি চারটিও বাজেট বরাদ্দ সাপেক্ষে ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হবে। ইনস্টিটিউটের ভৌত কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে অধ্যাপক জীনাত জানান, দ্বিতীয় পর্যায়ে ইনস্টিটিউটের ছয়তলার নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। এটিকে ১২ তলায় উন্নীত করা হবে। তৃতীয় পর্যায়ের কাজও শীঘ্রই শুরু হবে। তৈরি করা হচ্ছে ভাষা লাইব্রেরী ও বিশ্বের লিখন বিধির আর্কাইভ। একই সঙ্গে চলছে ডকুমেন্টেশন ও ভাষার প্রমিতকরণের কাজ। ভাষার ইতিহাস সংরক্ষণ ও বিদেশিদের জন্য বাংলাসহ বিশ্বের ১০টি ভাষা শিক্ষার লক্ষ্যে চলছে ‘ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র’ স্থাপনের কাজ। ভাষাচর্চা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এগুলো বই আকারে প্রকাশ করা হবে। উল্লেখ্য, ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়। এরপর বিশ্বের বিপন্ন ও প্রায় বিপন্ন ভাষার বিকাশ এবং এসব ভাষার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০১ সালের ১৫ মার্চ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। সে অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান উপস্থিত ছিলেন। তবে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে ইনস্টিটিউটের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ইনস্টিটিউটের প্রাথমিক নির্মাণকাজ শেষ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১২ তলা ভিত্তির ওপর তিনতলা ভবন উদ্বোধন করেন। এর মধ্যে ২০১১ সালে ইনস্টিটিউটির প্রথম তলার একটি কক্ষে শুরু হয় ভাষা জাদুঘরের কার্যক্রম। বর্তমানে ছয়তলা ভবনটির উর্ধমুখী সম্প্রসারণ কাজ চলছে। ভাষা জাদুঘর ঘুরে দেখা যায়, ডিজিটাল ব্যানারে বিভিন্ন দেশের ভাষা ও ভাষা জনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে ঝুলছে প্রাচীন মিসরীয় ভাষার লিপি, চার হাজার বছর আগের গুহাচিত্রের প্রতিলিপি। তবে সাজানো গোছানো আলোকোজ্জ্বল জাদুঘরটি নির্জন। এসব দেখার জন্য নেই একজন দর্শনার্থীও! এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অধ্যাপক জীনাত বলেন, ভাষা জাদুঘরের ভার্চুয়ালাইজেশন করা হচ্ছে। কক্ষটিতে জায়গার অভাব রয়েছে। তাই নতুন উপকরণ সংযোজন করা যাচ্ছে না। ভাষা জাদুঘরে মোট ৬৬টি দেশের ভাষা ও ভাষা জনগোষ্ঠীর তথ্য রয়েছে। দেশগুলোর নামের বাংলা বর্ণ ক্রমানুসারে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে। ভার্চুয়ালাইজেশনের কাজ শেষ হলে দর্শনার্থীরা ভাষা জাদুঘরের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠবেন বলে তিনি মনে করেন। অধ্যাপক জীনাত জানান, ইউনেস্কোর সহযোগী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর ইনস্টিটিউটের কাজের পরিধি বেড়েছে। ইউনেস্কো পরিচালিত ‘মাতৃভাষা-আশ্রয়ী শিক্ষা’, ‘টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষা’ ইত্যাদি কার্যক্রমে এটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। ইউনেস্কোর সঙ্গে এটি পারস্পরিক জ্ঞান বিনিময় ছাড়াও দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ এবং কৌশলগত কর্মসূচী বাস্তবায়নের সুযোগ পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মহাপরিচালক জীনাত ইমতিয়াজ বলেন, ইনস্টিটিউটের চলমান কাজগুলোতে বর্তমান সরকার যেভাবে সহযোগিতা করছে, সেটা ভবিষ্যতেও বজায় থাকবে বলে আমি আশা করি। কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কাজটি নির্বিঘেœ করা যায়নি, বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। সরকারী কাজ আর জাতীয় কাজের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে সেটা তো বুঝতে হবে।
×