ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ক্যাপিটাল ড্রেজিং অভাবে পায়রা বন্দর ঘিরে গড়ে ওঠা স্বপ্নে ধাক্কা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ক্যাপিটাল ড্রেজিং অভাবে পায়রা বন্দর ঘিরে গড়ে ওঠা স্বপ্নে ধাক্কা

রশিদ মামুন ॥ ক্যাপিটাল ড্রেজিং করতে দেরি হওয়ায় পায়রা বন্দরকে ঘিরে গড়ে ওঠা স্বপ্ন ফিকে হয়ে আসছে। পায়রা বন্দরের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে কয়লা এবং এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্রের উদ্যোক্তারা এখন বিপাকে পড়েছেন। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্যাপিটাল ড্রেজিং করে ১৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দরের জেটিতে ভেড়াতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৫ পর্যন্ত। বন্দর চ্যানেলের মুখে মাত্র ২৫ নটিক্যাল মাইল অগভীর সাগর ড্রেজিংয়ের জন্য দীর্ঘ নয় বছর অপেক্ষা করাকে বাড়াবাড়িই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য পায়রা বন্দর নির্মাণের ঘোষণা দিলে উদ্যোক্তারা আশায় বুক বাঁধেন। এ অঞ্চলের অন্য সমুদ্রবন্দর মংলা কোন সময়েই দৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। বিশেষ করে মংলার প্রধান চ্যানেলে পশুরের দু’তীর ঘেঁষে সুন্দরবন থাকার পাশাপাশি ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগে পিছিয়ে পড়ায় মংলা দিনের পর দিন বাণিজ্যের আস্থা হারিয়েছে। তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পায়রাকে ঘিরে সে সম্ভাবনা জেগে উঠেছিল। বিশেষ করে সুন্দরবন এলাকায় বিদ্যুত কেন্দ্র বা অন্য শিল্পকারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়তে হয় পরিবেশ অধিদফতরের। ইতোমধ্যে রামপাল বিদ্যুত প্রকল্প ঘিরে সে সমালোচনা এবং আন্দোলন চলছে। কিন্তু পটুয়াখালীর পায়রাতে সে সঙ্কট নেই। তবে এখানের বড় বাধা হয়ে উঠেছে ২৫ নটিক্যাল মাইলের ক্যাপিটাল ড্রেজিং। জানতে চাইলে পায়রা বন্দরের চেয়ারম্যান মোঃ সাইদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ড্রেজিং হলে কী হবে, না হলে কী হবে বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। আমরা আশা করছি পুরো ড্রেজিং শেষ করতে ২০২৩ পর্যন্ত সময় লাগবে। এতে প্রতি বছর এক মিটার করে ড্রাফট বৃদ্ধি করা হবে। মাত্র ২৫ নটিক্যাল মাইল ড্রেজিংয়ের জন্য এত বছর সময় লাগাটা যৌক্তিক কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, টাকা থাকলে মাত্র দুই বছরেই এ কাজ করা যায়। পায়রা বন্দরের মূল চ্যানেলে রক্ষণাবেক্ষণ ডেজিং করতে বেলজিয়ামের কোম্পানি জান ডি নুলের সঙ্গে গত বছরের ২৫ মে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে। কিন্তু এখনও গত আট মাসে চুক্তিই শেষ করতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। জানতে চাইলে বন্দরের চেয়ারম্যান বলেন, এমওইউ’র পর ওরা আমাদের আর্থিক এবং কারিগরি প্রস্তাব দিয়েছে, এসব মূল্যায়ন চলছে। তবে কবে নাগাদ মূল চুক্তি হবে তা তিনি জানাননি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পায়রায় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লাচালিত বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে। বিদ্যুত কেন্দ্রটি ২০১৯ সালে উৎপাদন শুরু করবে। এর বাইরেও এখানে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পৃথকভাবে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে কোম্পানিগুলোর জমি অধিগ্রহণ ছাড়াও যৌথ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করার চেষ্টা চলছে। বন্দরকে ঘিরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এবং বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশন পেট্রোবাংলা এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। এছাড়াও কয়েকটি বিদেশী কোম্পানি পায়রা বন্দরের সম্ভবনাকে কাজে লাগিয়ে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করার জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে। কিন্তু সব থেকে বড় বাধাই হচ্ছে পায়রা বন্দরের ক্যাপিটাল ড্রেজিং না হওয়া। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, আমরা বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ড্রেজিং শেষ করার নিশ্চয়তা চেয়েছি। কিন্তু বন্দর কর্তৃপক্ষ তা দিতে পারছে না। বিনিয়োগকারীরা বলছেন, তাদের ড্রেজিং করার আশায় আমরা প্রকল্প তৈরি করলাম কিন্তু ড্রেজিং শেষ হলো না। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ পড়ে থাকবে। এজন্য নির্ধারিত সময়ে ড্রেজিং শেষ না হলে জরিমানা জরিমানা প্রদান করবেন- এমন শর্তেও আগ্রহ দেখাচ্ছে না পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দরের ড্রেজিং না হলে বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোকে কয়লা আনতে হবে লাইটার জাহাজে করে। এতে কয়লা পরিবহনে বাড়তি খরচের জন্য বিদ্যুতের দাম বেশি পড়বে। আবার এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের জন্যও অন্তত ১৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ বন্দরে ভিড়তে হবে। কয়লার ক্ষেত্রে লাইটার করা গেলেও এলএনজির ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সরাসরি টার্মিনালেই জাহাজ আনতে হয়। বিকল্প হচ্ছে সাগরের মধ্যে দিয়ে পাইপলাইন নির্মাণ করা। কিন্তু অত্যধিক ব্যায়ের কারণে সাগরের মধ্য দিয়ে পাইপলাইন নির্মাণ করতে গেলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারাচ্ছে। এক্ষেত্রে সাগরের মধ্যে দিয়ে পাইপলাইন নির্মাণ করতে অন্তত ১০০ মিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত খরচ হবে। আবার নয় বছর পর ড্রেজিং শেষ হলে এ পাইপলাইন পড়ে থাকবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম। কোন কোন ক্ষেত্রে কয়লার চেয়েও কম দামে এলএনজি পাওয়া যেতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দশ বছর অন্তত এলএনজির একই দর বজায় থাকবে। এলএনজি সুবিধাজনক এবং পরিবেশবান্ধব হওয়ায় অনেক দেশই গ্যাসের স্বল্পতায় এলএনজি ব্যবহার করছে। কিন্তু পায়রায় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের বড় বাধা হয়ে উঠেছে ক্যাপিটাল ড্রেজিং। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে উত্তরাঞ্চল পর্যন্ত এলাকায় একমাত্র ভোলা ছাড়া আর কোন গ্যাসক্ষেত্র নাই। ভোলাও ছোট আকারের গ্যাসক্ষেত্র বিধায় এখান থেকে ব্যাপকভাবে গ্যাস উত্তোলন সম্ভব নয়। এ অঞ্চলের শিল্প এবং বিদ্যুত উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এলএনজি। সরকার চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় গ্যাসের স্বল্পচাপ দূর করতে মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের চেষ্টা করছে। কিন্তু সেভাবে পায়রা বন্দরকে গুরুত্ব না দেয়ায় বিস্তীর্ণ এ এলাকার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পায়রা ছাড়া দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মংলায় এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করা যেতে পারে। কিন্তু সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পশুর চ্যানেলের শেষ প্রান্ত মানকি পয়েন্টে ২০ মিটার ড্রাফট রয়েছে। মংলা বন্দর থেকে ৫২ নটিক্যাল মাইল দূরে মানকি পয়েন্ট থেকে বন্দরের দুই পাশেই সুন্দরবন। স্থলভাগে বনের মধ্য দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন করতে গেলেও পরিবেশবাদীরা বাধার প্রাচীর তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বন্দরে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এইচআর ওয়েলিং ফোর্ড বহিঃনোঙ্গর থেকে রাবনাবাদ চ্যানেল পর্যন্ত ৩৫ নটিক্যাল মাইল দীর্ঘ চ্যানেলের ড্রেজিং প্ল্যান প্রণয়ন করেছে। সে অনুযায়ী ১৬ মিটার ড্রাফটের মাদার ভ্যাসেলে চলাচল উপযোগী চ্যানেলে সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল ও সংরক্ষণ ড্রেজিং করা প্রয়োজন বলে মনে করছে তারা। কিন্তু এ ৩৫ নটিক্যাল মাইলের সবখানেই পানির গভীরতা কম নয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, এখানে সর্বোচ্চ ২৫ নটিক্যাল মাইল খনন করতে হবে।
×