ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

২৫ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার প্রতীক ছবিকে তারা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হিসেবে দেখাচ্ছে;###;১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার পাকিস্তানী আত্মসমর্পণ করলেও এখন তারা বলছে ৩৪ হাজার

ছবির আতঙ্কে পাকিরা

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ছবির আতঙ্কে পাকিরা

তৌহিদুর রহমান ॥ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকে উপড়ে ফেলতে চায় পাকিস্তান। বাংলাদেশের মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অহঙ্কার ও গৌরবের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে দেশটি। মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে না পেরে এ ধরনের অপকর্মের পথ বেছে নিয়েছে তারা। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের লেখক জুনাইদ আহমদ ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লোডেড’ (বাংলাদেশ সৃষ্টি : কল্পিত বিস্ফোরণ) নামে একটি বই লিখেছেন। বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসকে উপড়ে ফেলার পাঁয়তারা করছে দেশটি। করাচি ও ইসলামাবাদের বিভিন্ন বিদেশের মিশনে বইটি সরবরাহ করেছে পাকিস্তান। তবে এ বিষয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। ‘বাংলাদেশ সৃষ্টি : কারকথার স্বরূপ বইয়ের ভূমিকায় জুনাইদ আহমদ লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের ৭০ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের জন্ম দেশটির জন্য একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। একটি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে ৩৪ হাজার পাকিস্তানী সেনার আত্মসমর্পণের মধ্যে দিয়ে অবিভক্ত পাকিস্তানের জন্য একটি দুর্ভাগ্যজনক দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এটা শুধু পাকিস্তানের জন্য সামরিক ব্যর্থতা ছিল না, সকল পর্যায়ে ব্যর্থতা ছিল’। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে বইয়ের শুরুতেই জুনাইদ আহমদ নিজেই কাল্পনিক ইতিহাসের অবতারণা করেছেন। কেননা সে সময় রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সেনা আত্মসমর্পণ করেন। বইটির আটটি বিভাগের প্রথম বিভাগের শিরোনাম হলো, ‘বাংলাদেশ সৃষ্টি মধ্যে কল্পনা ও গল্প’। এখানে জুনাইদ আহমদ বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে অনেক কল্পনা ও গল্প বলা হয়। তবে প্রকৃত ঘটনা অনেকেই পাশ কাটিয়ে গেছেন। এসব বিষয়ের মধ্যে রয়েছেÑ ভারতের অভ্যন্তরের নিরাপত্তা সঙ্কট, আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক কর্মসূচী, মুুক্তি বাহিনী নামে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, ভারতীয় গণমাধ্যমের মিথ্যা প্রোপাগান্ডা, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক বোঝাপড়া ইত্যাদি। বাংলাদেশ সৃষ্টির পক্ষে যারা বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরেন, তার অধিকাংশই কল্পনা ও মিথ্যা বলে দাবি করেছেন জুনাইদ আহমদ। তিনি বইয়ের দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় এই ধরনের ১৪টি বিষয় তুলে ধরেছেন। এসব অসত্য ও কাল্পনিক বিষয় বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছেÑ ‘পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা সোনার বাংলা শোষিত হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে কোন উন্নয়নই হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানীরা বাঙালীর ওপর তাদের সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা তৈরি একটি জালিয়াতিমূলক মামলা। পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা তৈরি অপারেশন সার্চ লাইট ছিল পূর্ব পাকিস্তানের নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাদেশের নিরীহ ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিশেষ টার্গেট ছিল নিরীহ হিন্দু গোষ্ঠীকে হত্যা। সে সময় পাকিস্তানে সকল সহিংস ঘটনার পেছনে ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছিল মানবতার হস্তক্ষেপ ও রাজনৈতিক সমাধান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও সেটা পরিকল্পিত ছিল না। পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সেনা আত্মসমর্পণ করে ও যুদ্ধবন্দী হয়। বাঙালী নারীরা পাকিস্তানী সেনার দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ১৯৭১ সালের ৩০ জানুয়ারি কাশ্মিরের মুজাহিদদের ভারতীয় বিমান ছিনতাইয়ে পাকিস্তানের হাত ছিল’। এসব বিষয় পয়েন্ট আকারে তুলে ধরে লেখক জুনাইদ আহমদ একে মিথ্যা ও কাল্পনিক ইতিহাস বলে উল্লেখ করেছেন। আবার এসব পয়েন্ট নিয়ে প্রতিটি পয়েন্টের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। জুনাইদ আহমদ লিখেছেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরুতেই যে মিথ্যাচার করা হয়, সেটা হলো ৩০ লাখ বাঙালী হত্যা ও দুই লাখ নারীকে ধর্ষণের শিকার। ৩০ লাখ বাঙালীকে হত্যার বিষয়টি অতিরঞ্জিত। এ বিষয়ে যথাযথ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন তার বইয়ে। বাংলাদেশ ও ভারতের এটি একটি মিথ্যা প্রচারণা বলেও লিখেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৩ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাভদা পত্রিকায় যখন প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন। তখন সেটা সব জায়গায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আর ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের কাছে ইন্টারভিউতে শেখ মুজিব ওই ৩০ লাখ নিহতের সংখ্যা উল্লেখ করেন। ৩০ লাখ নিহতের ঘটনা আওয়ামী লীগ সরকার কখনই প্রমাণ করতে পারেনি। আর বাংলাদেশ এটাকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেও জুনাইদ দাবি করেছেন। বিশ্ব গণমাধ্যম নিহতের এই সংখ্যাকে গ্রহণ করেনি। এছাড়া বাঙালী বুদ্ধিজীবী শর্মিলা বোস, চৌধুরী আবদুল মুমিনসহ অনেকেই এই তথ্য অস্বীকার করেছেন বলে লিখেছেন জুনাইদ। জুনাইদ আহমদ এখানেও ইতিহাসকে বিকৃতি করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, প্রাভদা পত্রিকার প্রতিবেদনে তথ্য ছিল, ৩০ লাখ নিহত হয়েছেন। আবার তিনিই লিখেছেন, বিশ্ব গণমাধ্যম এ তথ্যকে গ্রহণ করেনি। তবে এখনও কোন বিশ্ব গণমাধ্যম মুক্তিযুদ্ধে নিহত ৩০ লাখ নিহতের সংখ্যাকে চ্যালেঞ্জ করেননি। বইয়ের ২২২ ও ২২৩ পৃষ্ঠার মাঝখানে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি ছবি দেয়া হয়েছে। এসব ছবিতে পাকিস্তানি নৃশংসতাকে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যার প্রতি ভারতের মুক্তিবাহিনীর নৃশংসতা বলে তুলে ধরার অপচেষ্টা করেছেন জুনাইদ আহমদ। তারই অংশ হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানী বাহিনীর গণহত্যায় নিহত বহুল প্রচারিত একটি ছবি ব্যবহার করেছেন তিনি। বিদেশী সাংবাদিকের ক্যামেরায় তোলা রিক্সার ওপর পড়ে থাকা নিহত রিক্সাওয়ালার ছবিটি দিয়ে ক্যাপশনে বলা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর হাতে সাধারণ মানুষকে হত্যাকা-’। পাকিস্তানের করাচি থেকে বইটি গত বছর আগস্ট মাসে প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের উৎসর্গপত্রে পবিত্র কোরআনের সুরা আল ইমরানের একটি আয়াতকে উদ্ধৃতি করা হয়েছে। ধর্মের নামে মিথ্যাচার পাকিস্তানের অনেক পুরনো ইতিহাস। এই বইটির দেয়া মিথ্যা তথ্যকে সত্য বলে বিশ্বাস করানোর জন্য ধর্মের ব্যবহার করা হয়েছে। সূত্র জানায়, পাকিস্তান সরকারের ইন্ধনে এ বইটি প্রকাশ করা হয়েছে। পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত এ বইটি ইসলামাবাদ ও করাচির বিভিন্ন বিদেশী মিশনে সরবরাহ করেছে পাকিস্তান। তারা মিথ্যা ও বিকৃতি ইতিহাসকে ছড়িয়ে দিতে চায়। তবে এ বইটির বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার থেকে কূটনৈতিক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সে বিষয়ে বাংলাদেশ প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের যখন ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তখনই তারা এ ধরনের একটি বই লিখেছে। তবে প্রতিষ্ঠিত সত্যকে কখনই পরিবর্তন করা যাবে না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস, সেই ইতিহাসকে পাকিস্তান কখনই বিকৃত করতে পারবে না। তবে বইটি প্রকাশ করে পাকিস্তান বড় স্পর্ধা দেখিয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বইটির বিষয়ে জাতীয় সংসদে উত্থাপন করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়াই চূড়ান্ত। তবে লেখক জুনাইদ আহমদ মুক্তিযুদ্ধের প্রতিষ্ঠিত তথ্য বিকৃতি করলেও, অনেক পাকিস্তানীই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস স্বীকার করেছেন। অনেক পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তারাও গণহত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। শাহরিয়ার আলম জানান, ২৫ মার্চ যে গণহত্যা হয়েছিল, সেটা বিশ্ববাসী জানেন। এ বিষয়ে বিতর্কের কোন সুযোগও নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার থেকে কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা নেব। এর আগে গত বুধবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনের শুরুতেই পয়েন্ট অব অর্ডারে বইটির মিথ্যাচারের বিষয়টি তুলে ধরেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর মদদে পাকিস্তানের জুনায়েদ আহমদের লেখা ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ : মিথস এক্সপ্লেডেড’ বই লিখে তাতে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক এ দেশের গণহত্যাকে মুক্তিবাহিনীর হত্যাকা- হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেছে। বইটি সংসদে দেখিয়ে তিনি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে এর প্রতিবাদ জানান। তোফায়েল আহমেদের দাবির প্রতি একমত পোষণ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে বলেন, দীর্ঘ ২৪ বছরের লড়াই-সংগ্রাম ও লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কারোর হুইসেলে আমাদের স্বাধীনতা আসেনি। একাত্তরে জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে, তা সবারই জানা। বাংলাদেশজুড়ে হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা শুধু দেশেই নয়, পাকিস্তানসহ আন্তর্জাতিক বহু দেশেই তথ্য রয়েছে। এখন পাকিস্তান তাদের যে এই কৃতকর্ম, যে গণহত্যা চালিয়েছিল তা উল্টো মুক্তিবাহিনীর ওপর দোষ দিয়ে নিজেদের দোষ ঢাকার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানের জন্য এটি লজ্জার বিষয়। এমন বই লেখার এবং তা বাংলাদেশে পাঠানোর সাহস তারা (পাকিস্তান) কোথা থেকে পেল!
×