ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সাজ্জাদ কাদির

গণমাধ্যমের ভাষা আর ফেব্রুয়ারি

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

গণমাধ্যমের ভাষা আর ফেব্রুয়ারি

ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমরা আমাদের ভাষার ব্যাপারে সচেতন হয়ে যাই, আদিখ্যেতা দেখাই। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ‘দাম দিয়ে কেনা’ ভাষা, আমাদের মায়ের ভাষা কী কেবলই ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক? সারা বছর যা ইচ্ছে তাই করে যাব, এ রকম একটি ভাব? প্রেস মিডিয়ার কথা যদি বলি, এখন হাজারো পত্রিকা জাতীয় এবং আঞ্চলিকভাবে ছড়িয়ে আছে দেশব্যাপী। জাতীয় পত্রিকা এবং জাতীয় মানের অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো যথেষ্ট সচেতনতার সঙ্গেই ভাষার ব্যবহার করে থাকে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সীমিত কিছু ছাড়া বেশিরভাগ আঞ্চলিক পত্রিকা এবং আঞ্চলিক অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো ভাষার মারাত্মক ত্রুটিযুক্ত প্রকাশ ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে বানানবিষয়ক মারাত্মক জটিলতা রয়েছে তাদের মধ্যে। ভুল বানানে নিউজ করে যাচ্ছে। ভুল বানানের এই নিউজগুলো আমাদের আগামী প্রজন্মের জন্য কী বার্তা দিচ্ছে, সেটি নিঃসন্দেহে ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মারাত্মক পীড়াদায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ভাষা। প্রথমেই যেটি সামনে আসে সেটি হচ্ছে প্রাইভেট স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের কিছু অনুষ্ঠান। আমাদের এই প্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আসলে কারা দেখেন? নিশ্চয়ই আমাদের দেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ? দূরে যাব না; আমাদের নিকটবর্তী পশ্চিমবঙ্গের মানুষও তো আমাদের টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখতে পারেন না। অবশ্য না দেখতে পারলেই ভাল। কারণ আমাদের এই চ্যানেলগুলোতে এমন কিছু উপস্থাপনা দেখা যায়, আসলে দর্শক বুঝতে পারেন না এগুলো কি বাংলা ভাষার উপস্থাপনা, নাকি বিশেষ কোন কিম্ভূত ভাষার উপস্থাপনা! বাংলা-ইংলিশ মিলিয়ে একটি বাংলিশ উপস্থাপনা হয়ে ওঠে এগুলো। এই অনুষ্ঠানগুলোর দর্শকপ্রিয়তা কতটুকু, তা বিচারের দাবি রাখে। যেহেতু বাংলা ভাষাভাষীর জন্য নির্মিত অনুষ্ঠান, সেহেতু আমি যদি শুদ্ধ বাংলা ভাষায় অনুষ্ঠানটি উপস্থাপন করি, সেটির কি মান পড়ে যাবে; স্মার্টনেস কমে যাবে? নিশ্চয়ই নয়। আমার মনে হয় সেটির উচ্চতা আরও অনেক বেড়ে যাবে। যারা এই ধরনের কাজগুলো করেন বা করান, ভেবে দেখবার অনুরোধ জানাচ্ছি। ইদানীং টিভি চ্যানেলগুলোর আরও একটি অত্যাচার লক্ষণীয়। সেটি হচ্ছে বিজ্ঞাপনের ভাষা। শালীন, সুন্দর ভাষার বিজ্ঞাপন নিঃসন্দেহে সবার হৃদয় ছুঁয়ে যেতে পারে। এর উদাহরণও আমাদের বিজ্ঞাপন শিল্পে ভূরি ভূরি আছে। অন্যদিকে একটি অশালীন ভাষার বিজ্ঞাপন আগামী প্রজন্ম, বিশেষ করে শিশুদের জন্য কী বার্তা বহন করে ভুক্তভোগী মাত্রই বুঝতে পারেন। ‘গার্ল ফ্রেন্ড’, ‘দোস্ত’, ‘ভ্যাজাল ব্যাপার’ এগুলো আমাদের কিছু টিভি বিজ্ঞাপনের ভাষা। এই ভাষাগুলো কোথা থেকে এসেছে, সেটিও অনুমান করতে পারি। এই সময়ের একটি প্রজন্ম এই ভাষাগুলোর মধ্যেই বেড়ে উঠছে। এরাই আলোচিত বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট লিখছে এবং সেই সঙ্গে নির্মাণ করছে বিজ্ঞাপনটি। আগে পিছে কিছু না ভেবেই তারা যে ভাষার মধ্যে বসবাস করছে, সেই ভাষাই বিজ্ঞাপনে চালিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই সোসাইটির বাইরে সমগ্র বাংলাদেশ এবং সারা পৃথিবীর বাংলা ভাষাভাষীর কথা মাথায় রেখে গণমাধ্যমের ভাষার প্রয়োগ হওয়া উচিত, সেটি তাদের মাথায় আসছে না। যার কারণে এই ধরনের বিজ্ঞাপন যখন টিভিতে দেখানো হয় তখন আমাকে চ্যানেল পরিবর্তন করে অন্য চ্যানেলে যেতে হয়। আবার অন্য চ্যানেলেও বা যাব কী করে? কারণ সেখানেও তো সেই একই জিনিস। প্রাপ্তবয়স্ক আমিই শুধু নয়; শিশুদের কাছ থেকেও এই বিজ্ঞাপনগুলোর ব্যাপারে মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে। নিজেকে দিয়েই উদাহরণ দেই। যেমন- আমার আট বছরের শিশুসন্তান আমাকে বলে, ‘বাবা মন্ত্রী আঙ্কেলদের বলে এই ‘দোস্ত’ ভাষা টাইপের বিজ্ঞাপনগুলো বন্ধ করা যায় না।’ আমার শিশুসন্তানটিকে আমি কী জবাব দেব খুঁজে পাই না। কারণ আমাদের দেশে টিভি বিজ্ঞাপনে কী যাবে না যাবে সে ব্যাপারে কোন সেন্সরশিপ নেই, এমনকি টিভি নাটকে কী যাবে, সে ব্যাপারেও কোন সেন্সরশিপ নেই। কতটা স্বাধীন এই মাধ্যমগুলো একবার ভাবুন তো? আর এই স্বাধীনতা আমাদের জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। টেলিভিশন মাধ্যমে এক সময়ের আমাদের গর্বের নাটক আমাদের দর্শকরা নাকি এখন আর দেখেন না। এই না দেখার বহু কারণের মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ ভাষার যাচ্ছেতাই ব্যবহার। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখনকার নাটকের ভাষা আর ভাষা নেই। হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষা। আর ‘খাইছি’, ‘করছি’, ‘গেছি’, ‘দোস্ত’ ভাষা তো আছেই। নাটকের ক্ষেত্রেও ঘটছে বিজ্ঞাপনের মতোই ঘটনা। বিজ্ঞাপন নির্মাণের ওই গোষ্ঠীটি যখন নাটক নির্মাণ করছে, তখনই ঘটছে বিপত্তি। ভাষা আর ভাষা থাকছে না। তাদের প্রত্যাহিক জীবনের ভাষা নাটকে অনুপ্রবেশ করছে। প্রাত্যহিক জীবন নিয়েই নাটক। কিন্তু ভাষার ব্যাপারে মনে হয় কোন আপোস চলতে পারে না। এফএম রেডিও এই মুহূর্তে আমাদের বিনোদনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে। এই এফএম রেডিওর ভাষা নিয়েও যথেষ্ট আপত্তি আছে। গণমাধ্যমের ভাষা হবে সবার ভাষা। কিন্তু এফএম রেডিওতে ব্যবহৃত ভাষা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সবার ভাষা হয়ে উঠতে পারছে না। টিভি চ্যানেলে ব্যবহৃত সেই বাংলিশ ভাষা এফএম রেডিওতেও ব্যবহার হচ্ছে হরদম। সামগ্রিক অর্থে গণমাধ্যমের ভাষা আসলে কী হওয়া উচিত? গণমাধ্যমের ভাষা হবে সবার ভাষা, এটিই কাম্য। চট্টগ্রামের মানুষটি, সিলেটের মানুষটি, রংপুরের মানুষটি, পাবনার মানুষটি এমনকি পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষাভাষী মানুষটিও যেন আমাদের গণমাধ্যমের ভাষা শুনে বুঝতে পারে এটি আমার ভাষা। গণমাধ্যমের ভাষাকে কোন অঞ্চলে আটকে দেয়া বড়ই অনুচিত। বাংলা-ইংলিশ মিলিয়ে গণমাধ্যমে যে ভাষা প্রয়োগ হচ্ছে, সেটি বন্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরী। আর প্রত্যাহিক জীবনের কথ্য ভাষা তো অবশ্য পরিত্যাজ্য। আজকে যে শিশুটি সবেমাত্র ভাষা শিখছে, তাকে যদি আমাদের গণমাধ্যমের ভাষা শোনানো হয়, সে এক দারুণ বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে বাধ্য। কারণ শিশুর ভাষা শিক্ষা হয় অনেকটা শুনে শুনে। পরিবার, সমাজ থেকে শোনে প্রচলিত কথ্য ভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা। গণমাধ্যমে বিকৃত ভাষা ব্যবহারের কারণে শুদ্ধ বাংলা ভাষা শোনার জায়গাটি শিশুর জন্য হারিয়ে যেতে বসেছে। অবস্থাদৃষ্টে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, আমাদের শিশুদের জন্য শুদ্ধ বাংলা ভাষা শেখার কোন জায়গা নেই। অন্যদিকে শুধু শিশুরাই কেন, আমরা যারা বড়রা কথা বলি, গণমাধ্যমের এখনকার ভাষা শুনলে তাদের শুদ্ধ ভাষা বলার অভ্যাস মাঠে মারা যেতে বাধ্য। আমাদের ‘দাম দিয়ে কেনা’ মাতৃভাষা নিয়ে আমরা শুধু ফেব্রুয়ারি মাসেই ব্যস্ত হব না; সারা বছরই সর্বস্তরে মাতৃভাষার শুদ্ধ ব্যবহারে সচেষ্ট হব। গণমাধ্যমের ভাষাকে সকল অঞ্চলের, সকল সমাজের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ভাষায় পরিণত করব, আজকে এই ভাষার মাসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার। লেখক : সংস্কৃতি ও গণমাধ্যম কর্মী Email:[email protected]
×