ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

বাংলাদেশে মধ্যম সারির ব্যবস্থাপক নেই- পাঠক প্রতিক্রিয়া

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

বাংলাদেশে মধ্যম সারির ব্যবস্থাপক নেই- পাঠক প্রতিক্রিয়া

গত সপ্তাহে ‘আমার দিন’ কলামে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে মধ্যম সারির ব্যবস্থাপক নেই’ লেখাটি নিয়ে অসংখ্য পাঠক তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। অনেকেই এর পক্ষে মত দিয়েছেন এবং অনেকেই বিপক্ষে। অনেকে ব্যক্তিগত আক্রমণও করেছেন। বিষয়টি যেহেতু আমাদের ছেলেমেয়েদের ক্যারিয়ার এবং ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত, তাই এখানে ব্যক্তিগত আবেগের কোন সুযোগ নেই। সেই আক্রমণগুলোর কোন জবাব আমি দিচ্ছি না। বাকি যে কনসার্নগুলো পাঠকের মনে এসেছে সেগুলো নিয়ে অবশ্যই কথা বলাটা প্রয়োজন মনে করি। তাহলে অনেকের চিন্তায় পরিবর্তন আসতে পারে এবং সেটাই মূল বিষয়। সেইসব প্রতিক্রিয়া থেকে বেছে বেছে কিছু পয়েন্টে আমার ভাবনাগুলো বলার চেষ্টা করব। এক. প্রয়োজনীয় বেতন দেয়া হয় না একটা বড় অংশের মানুষ মনে করছেন, বাংলাদেশে ম্যানেজারদের যথেষ্ট পরিমাণে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয় না। যার কারণে তাদের ভেতর ভাল ম্যানেজারিয়াল ক্যাপাসিটি তৈরি হয় না। তাদের সারাক্ষণ দ্বিতীয় কোন উপায়ে অর্থ উপার্জনের জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হয়। যেখানে জীবন পরিচালনার জন্য ন্যূনতম আয়ের সুযোগ নেই, সেখানে ভাল ম্যানেজার তৈরি হয় কিভাবে? এই চিন্তাটার মেরিট আছে। মানুষ তো আর একদিনে ভাল ম্যানেজার হয়ে ওঠে না। দীর্ঘ সময়ে কর্ম অভিজ্ঞতা দিয়ে একেকজন ভাল দক্ষ ম্যানেজারে পরিণত হন। তাদের যুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সকল কর্মীকে এই দুর্মূল্যের বাজারে জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট টাকা দেয় না। এর সঙ্গে আমি আমার কিছু চিন্তা যোগ করতে চাই। এটা হতে পারে বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান তার কর্মীদের সচ্ছলভাবে চলার জন্য যথেষ্ট আর্থিক সুবিধা দেয় না; কিংবা দিতে পারে না। যদি সকল প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিতে পারত, তাহলে তো এই দেশটা অনেক আগেই ধনী দেশে পরিণত হয়ে যেত। সেটা যে আমরা পারছি না, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এর অর্থ যদি করা হয় এমন যে, মালিক বা উদ্যোক্তারা সব টাকা-পয়সা নিয়ে নিচ্ছেন, আর কর্মীরা কিছুই পাচ্ছেন না- তাহলে ভিন্ন কথা। এমনটা হলে সেই প্রতিষ্ঠান ভাল চলার কোন কারণ নেই। প্রতিটি উদ্যোক্তাই চাইবেন তার ঝুঁকিকে কমিয়ে আনতে এবং তার প্রতিষ্ঠানটি সুন্দরভাবে চলুক, এমনটা চাইবেন নাÑ সেটা তো হতে পারে না। আমি সাদামাটাভাবে বলি, বাংলাদেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মীদের যথেষ্ট ভাল সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে না। তার মূল কারণ হলো, প্রতিষ্ঠানটিকে সেই পরিমাণ আয় করতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশের আয় কম, তাই মাথাপিছু আয়ও কম এবং আমাদের কর্মীদের ভাগেও কম পড়ে। কিন্তু এটা তো সত্য যে, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের ভাল বেতন এবং সুবিধা দিয়ে থাকে। কিন্তু তারা কি ভাল ম্যানেজার পাচ্ছে? কিংবা তারা কি ভাল ম্যানেজার তৈরি করতে পারছে? তাদেরও বাইরে থেকে ভাল ম্যানেজার আনতে হচ্ছে। নইলে তার প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এমন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে, যারা আর্থিকভাবে ভাল করছে এবং তাদের কর্মীদের ভাল সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। কিন্তু তারাও ভাল ম্যানেজার পাচ্ছে না। কারণ দেশে ভাল ম্যানেজার তৈরি হচ্ছে না। হলেও তার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। পাশাপাশি দুটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আমাদের পাশের শহর কলকাতা। ওখানে মানুষের আয় আমাদের থেকে কম এবং জীবনযাত্রা ঢাকা শহর থেকে অনেক ক্ষেত্রেই কষ্টের। কিন্তু সেখানে ভাল ম্যানেজার পাওয়া যাচ্ছে অনেক। তাদের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তারা সবাই বলেছেন, কলকাতার মানুষগুলো অনেক বেশি দক্ষ এবং গোছানো। মধ্যম সারির কাউকে কোন কাজ করতে দিলে সে দায়িত্ব নিয়ে সঠিকভাবে কাজটি করে ফেলে। আমাদের কাছের দেশ থাইল্যান্ডেও যত জায়গায় আমি গিয়েছি, সেখানে মানুষগুলো এবং প্রতিষ্ঠানগুলো যথেষ্ট ভালভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলে মনে হয়েছে। একটি ছোট শহরের হাসপাতালে যেতে হয়েছিল একবার, জরুরী বিভাগে। ছুটির দিনেও সেই মানুষগুলো যেভাবে চিকিৎসাসেবা দিয়েছিলেন, সেটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতালেও পাওয়া সম্ভব নয়। এমনকি তার শতভাগের এক ভাগও না। এখানকার হাসপাতালগুলোর সেই মাইন্ডসেটই নেই। আমাদের জীবনে টাকার প্রয়োজন আছে এবং এটা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। কিন্তু তার আগে প্রয়োজন মাইন্ডসেট, এটিচিউট। বেশি টাকা দিলেই বেশি দক্ষ ম্যানেজার পাওয়া যাবে, সেটা সঠিক নয়। এর জন্য আমি একটি উদাহরণ সব সময় ব্যবহার করি। সেটা এখানেও লিখছি। আমার ড্রাইভার ভাল গাড়ি চালাতে পারে। একদিন আমি তাকে অনেক টাকা বেতন দিয়ে বললাম, আমার প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে দাও। তার বেতন যেহেতু বাড়িয়ে দিয়েছি, তাহলে তো তার কাজটি সঠিকভাবে করে ফেলতে পারার কথা। কিন্তু তার কি সেই দক্ষতা তৈরি হয়েছে? যারা মনে করেন টাকা দিলেই মানুষ যোগ্য হয়ে ওঠে, তাদের চিন্তাটা ভুল। আমার সঙ্গে যখন কেউ চাকরি নিয়ে কথা বলতে আসে এবং প্রথমেই বেতন জিজ্ঞেস করে, আমি তাকে কখনই হায়ার করি না। কারণ, সে জানতেই চায়নি তাকে দিয়ে কী কাজটা করানো হবে এবং সে ওই কাজটি কতটা দক্ষতার সঙ্গে করতে পারবে। মধ্যম সারির ব্যবস্থাপকরা একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাণ। তারাই মূলত প্রতিষ্ঠানটিকে পরিচালনা করে থাকেন। এটা এক ধরনের বিশেষ গুণ। আমি মনে করি, এর জন্য প্রয়োজন যথার্থ মাইন্ডসেট। প্রথমেই প্রয়োজন তার মেন্টাল গ্রোথ। কেউ যোগ্য হয়ে উঠলে তার বেতনের কমতি হয়েছে, এমনটা আমি কোথাও দেখিনি। বরং প্রতিষ্ঠানগুলো বাড়তি টাকা খরচের জন্য প্রস্তুত হয়েই থাকে। তারা হন্যে হয়ে ম্যানেজার খুঁজতে থাকে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা তাদের ক্যারিয়ারে খুব দ্রুত ওপরে উঠে যেতে চায় কিংবা সহসাই ধনী হয়ে যেতে চায়। কিন্তু ক্যারিয়ারে কোন শর্টকাট নেই। সম্পর্ক এবং ক্যারিয়ার এই দুটি জিনিস তৈরিতে সময় দিতে হয়। এই কঠিন সত্যিটা বুঝতে হবে, শিখতে হবে। দুই. বিদেশীদের চাকরি দেয়ার পাঁয়তারা দেশে অনেকেই বিশ্বাস করেন, এই ধরনের মুক্ত আলোচনা কিংবা ‘থট প্রসেস’ মূলত বিদেশীদের দেশে কাজ করতে দেয়ার এক ধরনের পাঁয়তারা। তারা মনে করেন, আমাদের দেশে যে বিদেশী কর্মীরা কাজ করেন এগুলো নিয়ে লিখে তাদের সমর্থন দেয়া হয় এবং এর মাধ্যমে আরও বেশি বেশি লোক বাংলাদেশে আমদানি করার সুযোগ তৈরি হয়। এর সঙ্গে মিলিয়ে অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের একটি কালচার হলো নিজের দেশের মানুষ বাদ দিয়ে বেশি টাকা খরচ করে বিদেশী কর্মী আনার প্রবণতা রয়েছে। তারা মনে করেন, এটা আমাদের এক ধরনের রোগ। আমি এখানে একটি ম্যাসেজ সরাসরি তুলে দিচ্ছি। ‘মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপক নিয়ে আপনার লেখাটা পড়লাম; কিন্তু সহমত হতে পারলাম না। আমাদের দেশে বিশেষ করে এনজিও সেক্টরে যথেষ্ট দক্ষ লোক আছে; কিন্তু যোগ্যতা অনুসারে কাজের সুযোগ অনেক কম। আমার মতো অনেকেই বিদেশের বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে দেশে কাজ করতে চাইলেও সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। আর সবচেয়ে মজার কথা হলো, একই পদে দেশী কেউ যোগ্য মনে হলেও বেতনের বেলায় বিদেশীদের চেয়ে অনেক কম দিতে চায়। এটা এক ধরনের মানসিক দীনতা বৈ কিছু নয়। আমি দেশে একটা ভাল প্রতিষ্ঠান খুঁজছি, যেখানে দায়িত্বশীল পদে থেকে দেশের জন্য আরও বড় কোন কাজ করার সুযোগ পাব, দুর্ভাগ্য তা মিলছে না। তাই শঙ্কা হচ্ছে, বাধ্য হয়ে না আবার আফ্রিকায় যাওয়া লাগে।’ অনেকেই এভাবে ভাবছেন। এখানে একটু শুধু যুক্ত করি। আমি কিন্তু বলিনি যে, আমাদের কোন দক্ষ লোকই নেই। আমি বলেছি, আমাদের মিড লেভেল ম্যানেজারের খুব সঙ্কট। তাই আমি সেই বিষয়টিতেই থাকতে চাই। এই বিষয়টির দুটি ভিন্ন দিক আছে। আমি সেই দুটি দিক আলোচনা করার চেষ্টা করছি। প্রথমটি হলোÑ বেশি টাকা দিয়ে বিদেশী কর্মী আনা। একটি কাজে একই পরিমাণ পারদর্শী যদি একজন বাংলাদেশী পাওয়া যায়, তাহলে কেন একটি প্রতিষ্ঠান বেশি টাকা দিয়ে বিদেশ থেকে ম্যানেজার আনবে, তা আমার মাথায় ঢুকছে না। বছরের পর বছর যে বেশি পরিমাণ অর্থ তার চলে যাবে, সেটা কেন একটি প্রতিষ্ঠান করতে চাইবে? সেটা কি শুধু লোক দেখানোর জন্য যে, আমি বিদেশী মানুষকে চাকরি দিতে পারি? নাকি সত্যিকার অর্থেই ব্যবসায়িক কোন লাভ আছে? যদি প্রতিষ্ঠানের কোন লাভ থাকে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান সেটা করবেই। কিন্তু লাভটা কী, সেটা আমি জানি না। আমার কাছে তো মনে হচ্ছে, বছরের পর বছর অনেক টাকা নষ্ট। আর যদি সত্যি সেই বিদেশী মানুষটির আলাদা কোন গুণ থাকে, তাহলে তো সেটার জন্য তাকে রাখতেই হবে। যেমন কৃষি এবং খাদ্য সেক্টরে আমি জানি অনেক বিদেশী পরামর্শক কাজ করেন এবং তারা সেই সব বিষয়ে সত্যিকার অর্থেই বিশেষজ্ঞ। আর দ্বিতীয়টি হলো দার্শনিক। আমাদের ছেলেমেয়েরা যখন বিদেশে যায়, সেখানে কাজ করে ভাল, আমরা সবাই গর্ববোধ করি। পত্রিকায় বিশাল শিরোনাম করি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘প্রাউড অব ইউ’ বলে নিজেকে ধন্যবোধ করি। তাহলে বিদেশী একজন এসে বাংলাদেশে কাজ করতে পারবে না কেন? নাকি আমাদের সবকিছুই ওয়ানওয়ে। আমি এই বিশ্বের সুবিধা নিতে পারব, অন্যরা পারবে নাÑ বাংলাদেশের মানুষ এমন অসংখ্য দ্বৈত নীতিতে বসবাস করে। তারা যেই সূত্র নিজের জন্য প্রয়োগ করে, সেটা অন্যের বেলায় প্রয়োগ করে না। এই বিশ্বায়নের যুগে আমাদের ছেলেমেয়েরা যদি বিদেশে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পায়, তাহলে সেই গ্রহের বাসিন্দা হিসেবে অন্যদেরও আমাদের দেশে কাজ করতে দিতে হবে। আমাদের দেশে যে পরিমাণে বিদেশী কাজ করেন, আমি মোটামুটি নিশ্চিত, আমাদের সেই পরিমাণ দক্ষ জনবল নেই। আমাদের অর্থনীতি গত ১০ বছরে অনেক বেড়ে গিয়েছে, গতিশীল হয়েছে। আমাদের নিজেদের অনেক ব্র্যান্ড শক্তিশালী হয়েছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে আমাদের চেন স্টোরগুলো শোভা পাচ্ছে, যা আগে ছিল না। আমাদের অর্থনীতি আর আগের মতো দরিদ্র নেই। তাই চিন্তাভাবনাগুলো দরিদ্র হলে তো আর এগোনো যাবে না। আমরা যদি যথেষ্ট দক্ষ ম্যানেজার পেয়ে যাই, তাহলে আর বিদেশ থেকে কাউকে আনতে হবে বলে আমার মনে হয় না। তিন. ম্যানেজার কেন তৈরি হয় না? বাংলাদেশ কেন মিড লেভেল ভাল ম্যানেজার তৈরি করতে পারে না, তা নিয়ে একজন পাঠক খুব সুন্দর মতামত দিয়েছেন। ইম্পেল সার্ভিস এ্যান্ড সলিউশনের নির্বাহী পরিচালক তৌহিদুর রহমান খুব গুছিয়ে একসঙ্গে অনেক কথা লিখেছেন। আমি তার কথাগুলো এখানে কোট করছি। তিনি লিখেছেনÑ যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণী জন্মায় না, জন্মাতে পারে না, জন্মালেও তাকে বাঁচতে দেয়া হয় না। আমি আমার সফটওয়্যার খাতে দেখেছিÑ এখানে যারা বিনিয়োগকারী আছেন বেশিরভাগই এসেছেন গার্মেন্টস, রিয়েল এস্টেট সেক্টর থেকে; সেইসঙ্গে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজন। তাতে দোষের কিছু নেই, বরং এটা শুভ লক্ষণ। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? মূল সমস্যা হলো এরা এই ব্যবসা না বুঝেই নেমে পড়েছেন শর্টকাট টাকা এবং খ্যাতি কামানোর জন্য। এদের একেকজনের সরকারের বিভিন্ন মহলে শক্ত যোগাযোগ আছে, যাতে করে বড় আইসিটি প্রকল্পের টাকা লুটপাট করা যায়। কেউ কেউ আবার কালো টাকা সাদা করার জন্য একটা সফটওয়্যার ‘উইং’ খুলে বসেছেন। আসল কথা হলো এদের কারও না আছে কাজ করার অভিজ্ঞতা, না আছে এই কাজের প্রতি ভালবাসা। সবাইকেই মনে করে গার্মেন্টস কর্মীদের মতো (যাদের যেভাবে ইচ্ছা চালানো যায়)। আরেক শ্রেণী আছেন যারা এর থেকেও ভয়ঙ্কর। এরা আইটি সেক্টরে লেখাপড়া করা এবং শুধু লেখাপড়া করা নয়, উচ্চ ডিগ্রীধারী। এদের কাজ হলো খুব গোছানো পদ্ধতিতে একটা প্রজেক্টের টাকা লুটপাট করে নামেমাত্র একটা সফটওয়্যার সাইট দিয়ে বুঝ দেয়া। তো এই যদি হয় বেশিরভাগ বিনিয়োগকারীর অবস্থা, সেখানে আপনি কি আশা করতে পারেন দক্ষ মাঝারি ব্যবস্থাপক? এখানে শেষ হলেও কথা ছিল। এবার একটু ভেতরে নজর দেই। ক. কয়টা কোম্পানি আছে যার মালিক পক্ষ-বিনিয়োগকর্তাদের ব্যবস্থাপনা-লিডারশিপের ওপর ট্রেনিং আছে? ট্রেনিং তো পরের ব্যাপার, কিভাবে মাঝারি ব্যবস্থাপক চালাতে হয়, এর মোটামুটি সদিচ্ছা এবং জ্ঞান আছে? বেশিরভাগই গালাগালি- বাজে কথা বলে চালানোকে একমাত্র পন্থা হিসেবে বিবেচনা করেন। খ. কয়টা কোম্পানি আছে যেখানে উঠতি ব্যবস্থাপকদের ন্যূনতম ভরসা দিচ্ছে তাদের ভবিষ্যত নিয়ে? দিচ্ছে না। বেতন একটু বেশি মনে হলেই বাদ দিয়ে নতুন কাউকে কম টাকায় নিয়ে আসার চিন্তা। তাহলে আপনার দক্ষতা আপনি কিভাবে ঢেলে সাজাবেন? সারাদিন তো একটাই চিন্তা, আগামী মাসে চাকরিটা থাকবে তো! গ. যদি কেউ দায়িত্ব নিয়ে নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে চায়, তখন আবার আরেক সমস্যাÑ উপরের শ্রেণীর, কর্তাব্যক্তিগণ ধরেই নেন এখানে কোন একটা সিন্ডিকেট হচ্ছে। দলের ছেলেপেলেরা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। তখন চলে দল ভাঙ্গার খেলা, বিভিন্নভাবে হয়রানি। মুখে বলবেন ‘থিঙ্ক আউট অব দ্য বক্স’ আর বাস্তবে ‘আউট অব দা বক্স চিন্তা করছেন তো মরছেন।’ এর পরও আশা করবেন ভাল মাঝারি ব্যবস্থাপক তৈরি হবে? হাস্যকর! ঘ. দলনেতাকে দায়িত্ব দেয়া হবে ৮ ঘণ্টার টাকা দিয়ে ১২ ঘণ্টা কাজ করানোর। আবার সেই দলনেতা যখন তার দলের সদস্যের জন্য ছুটির আবেদন করবে, বেতন বাড়ানোর অনুরোধ করবে, ছোটখাটো উদযাপন করতে চাইবে, তখন নেমে আসবে খড়গ। ন্যাড়া বেলতলায় কয়বার যাবে বলতে পারেন? ট্রেনিং যদি দিতে হয় আগে দিতে হবে বিনিয়োগকারীদের, উর্ধতন কর্মকর্তাদের। তাদের শেখাতে হবেÑ -কিভাবে লোভ সংবরণ করতে হয় -কিভাবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করতে হয় -কিভাবে ‘ওয়ার্কফোর্সের’ ওপর বিশ্বাস রাখতে হয় -ভাল কাজের প্রশংসা কিভাবে করতে হয় -কিভাবে গুণের কদর করতে হয় -‘হিউমেন রিসোর্স’ আর ‘এডমিনিস্ট্রেশন’-এর পার্থক্য কি আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের মধ্যে কাজের স্পৃহার ঘাটতি নেই, নেই মেধার ঘাটতি, সর্বোপরি তাদের মধ্যে সততারও অভাব নেই। তারা একটু সম্মান চায়, বেঁচে থাকার জন্য চায় সময়মতো সম্মানী। আমরা ওপরের স্তরের ব্যবস্থাপকরা, বিনিয়োগকারীরা যেদিন নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে পারব, সেদিন সেই মুহূর্ত থেকে এই দেশে মাঝারি ব্যবস্থাপক তৈরি শুরু হবে। চার. সমাধান কি? বাংলাদেশে যে মিড লেভেল ম্যানেজারের তীব্র সঙ্কট আছে, এটা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। যারা এটাকে মানেন না, কিংবা অন্য যুক্তিতর্ক জুড়ে দেন, তারা বিষয়টি বোঝেন কি না আমার সন্দেহ আছে। তাদের চিন্তাকে মাঠ থেকে বাদ দিলে যা দাঁড়ায় তা হলো, এটার মুখোমুখি আমাদের হতে হবে। যদি এই দেশকে আমরা একটি সুসংগঠিত এবং সুপরিচালিত সিস্টেমে দেখতে চাই, তাহলে এর বিকল্প নেই। কিন্তু কিভাবে তৈরি হতে পারে দক্ষ মিড লেভেল ম্যানেজার? মিডলেভেল ম্যানেজার আমাদের সর্বস্তরে প্রয়োজন। একটি দোকান থেকে শুরু করে, একটি বুটিক হাউস, কফি শপ, জুতার দোকান, চেন স্টোর, কর্পোরেশন, ব্যাংক, সরকারী অফিস থেকে শুরু করে এমন কোন প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না, যেখানে ভাল মিড লেভেল ম্যানেজারের প্রয়োজন নেই। বরং ম্যানেজার পেলে সেই প্রতিষ্ঠানটি ভাল করতে পারে এবং মানুষ ভাল সেবাও পেতে পারে। সেই মানুষগুলোকে তৈরির জন্য আমার মনে হয় তিনটি বিষয় কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রথমত, ট্রেনিং। আমাদের যেহেতু এই ট্রেনিংটা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও হয় না, তাই চাকরি ক্ষেত্রে এটা হতে পারে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি এই বিষয়ে সচেতন করা যায়, তাহলে তারা সবাই কিছু বাজেট রাখতে পারে ম্যানেজার তৈরিতে। পাশাপাশি ব্র্যাকের মতো সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসতে পারে সুন্দর কিছু ইনস্টিটিউট তৈরির কাজে, যেখানে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের পাঠাতে পারবে। দ্বিতীয়ত, পরিবার থেকে। আমাদের বেশিরভাগ পরিবার ছেলেমেয়েদের ভুল মাইন্ডসেট দিয়ে বড় করে। যেমন, কিছু পরিবার আছে যারা তাদের সন্তানদের সারাক্ষণই প্রশংসা করতে থাকে। এটা মূলত করা হয় তাদের উৎসাহ দেয়ার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা এমন নয়। এখানে কিন্তু সমালোচনাও শুনতে হয়। ফলে সেই ছেলেমেয়েগুলো আর সমালোচনা নিতে পারে না। আগেই বলেছি, আবারও বলছিÑ ক্যারিয়ার এবং সম্পর্কÑ এই দুটি জিনিস তাড়াহুড়ো করে হয় না। এটা পরিবারগুলোকে বুঝতে হবে এবং তাদের সন্তানদের ভেতর ঢুকিয়ে দিতে হবে। বর্তমান সময়ের ফেসবুক জেনারেশন যেন বুঝতে পারে এই জগতের সবকিছু ভার্চুয়াল নয়। বাস্তব জীবন অনেক ভিন্ন। সেখানে একটি ছবি পোস্ট করার পর সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে লাইক আসে না। এই জীবনে লাইক আসতে অনেক সময় লাগে এবং পরিবারগুলোর উচিত তাদের সন্তানদের শুধু বই নয়, আরও বেশি বাস্তব জীবনের পাশাপাশি রাখা। তাহলে বাস্তবের অনেক কিছু তারা শিখবে। তৃতীয়ত, নিজের মনটাকে মুক্ত রাখা। পরিবার আমাদের ট্রেনিং দিক, আর প্রতিষ্ঠান ট্রেনিং দিকÑ সেটা নিতেও পারতে হবে। যারা এটাকে নেবেন, তারা যদি সেই চেষ্টাটুকু না করেন, তাহলে নিত্যদিন অন্য মানুষের ওপর দোষ চাপিয়ে জীবন পার করতে হবে। আমাদের ভেতর একটি প্রচলিত প্রবণতা হলো আশপাশের দেশগুলোকে গালি দেয়া এবং তাদের যোগ্যতাকে খাটো করা। আমাদের যেমন অনেক যোগ্যতা রয়েছে, তাদেরও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে ভাল যোগ্যতা রয়েছে। সেটাকে মেনে নিয়ে যদি নিজেকে তৈরি করা যায়, তাহলেই মঙ্গল। নইলে আরও দুই যুগ পরেও আমরা একই বিষয় নিয়ে তর্ক করতে থাকব, যেভাবে আমাদের ভাল ভাল অর্জনগুলোকে আমরা এখনও বিতর্কের উর্ধে আনতে পারিনি। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ুং@ঢ়ৎরুড়.পড়স
×