ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ই-প্রণয় পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনছে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

ই-প্রণয় পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনছে

সমুদ্র হক ॥ ই-প্রণয়ের শাখা, প্রশাখা পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনছে। একবিংশ শতকে মানব-মানবীর হৃদয়ের গভীরের প্রণয়ের মধুময়তার সঙ্গে প্রযুক্তির ছোঁয়াও মিশে গেছে। ‘ভালবাসা’ ছোট্ট একটি মিষ্টি সহজ শব্দ। বর্তমানে ‘ই’ যোগ হয়ে এ যুগের তরুণ-তরুণী মিশ্রিত নতুন শব্দের সৃষ্টি করেছে। এখন আর প্রণয়ের মানুষকে সহজ করে সহজ কথাটি বলার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয় না। টানতে হয় না প্রকৃতির নানা উপমা। প্রতীক্ষার পালা আর নেই। ই (ইলেক্ট্রনিক) যুগে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক ও তার মেসেঞ্জার ঘরে-বাইরে উড়ে বেড়াচ্ছে। যে যতভাবে ধরতে পারে। আকাশবিজ্ঞান সবই জলবততরলং করে দিয়েছে। স্মার্ট সেল (মোবাইল) ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, নানা ধরনের কম্পিউটার আকাশ ধরে ফেলেছে। প্রণয় ভালবাসাকে ইন্টারনেটে ভরে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরছে। দেশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ছাড়িয়ে বিশ্বের দেশে দেশে চোখ ও কথা ঘুরে ফিরছে। প্রণয় এখন হৃদয়ের দুয়ারে সারা বছর ফাগুন এনে দিয়েছে। এর মধ্যেই সুযোগ খুঁজে নিয়ে ঢুকে পড়েছে ‘ঘুণ পোকা’, যা ডেকে আনছে বিপদ। এদিকটা খেয়াল না করায় হোঁচট খেয়ে পিছলে পড়তে হচ্ছে। শুধু এ যুগের তরুণ-তরুণীই নয়, মধ্যবয়সী পর্যন্ত ই-প্রণয়ের পথে পা বাড়িয়েছে। যা থেকে মিষ্টিমধুর প্রণয়ের পাত্রে মারাত্মক ঝাল মিশে গিয়ে কখনও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে হচ্ছে। তরুণ-তরুণীরা ই-প্রণয়ে সঙ্গীকে খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করছে। যুগের প্রযুক্তিতে বাঁধা দিতে গেলেই বিপদ। বিপদের বড় শঙ্কা হলো, বয়সের এই সময়টিতে উভয়ই সত্য গোপন করে। ফাঁকি দেয়ার প্রবনতা বেড়ে যায়। যাকে প্রণয়ের বন্ধু হিসাবে গ্রহন করে তার কাছে ফাঁকি দিয়ে প্রণয় যখন কথিত সফল হয়ে পরিণয় অবধি পৌঁছয় তার পরের অধ্যায়টি হয়ে ওঠে বিষময়। অবিশ্বাস ভর করে একে অপরের প্রতি। ‘মানুষ তার বিশ্বাসের সমান বড় আশার সমান সুন্দর’ কথাটি হৃদয়ের জানালা দিয়ে পালিয়ে যায়। হৃদয়ের দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করে বিষাক্ত হাওয়া; যা জীবনকে ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করায়। ফল কখনও বিচ্ছেদে, কখনও অপরাধে। মধ্যবয়সীর অনেকে ভিন্ন ধরনের ই-প্রণয়ের জটিল পথে হাঁটতে শুরু করেছে। যা দিনে দিনে ভয়াবহ এক ধরনের মনোস্তাত্ত্বিক ই-রোগের জীবাণুতে পরিণত হয়ে মানবদেহে সংক্রমিত হচ্ছে। এই ভাইরাস দমনের উপযুক্ত কোন চিকিৎসা মেলে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে এই রোগের উৎপত্তি। তার পর ইন্টারনেটের সহযোগিতায় স্মার্ট ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটারের মনিটরে হৃদয়গুলো জড়ো হতে থাকে। এই বিষয়টির নাম দেয়া হয়েছে পোস্ট-মেরিটাল বা এক্সট্রা মেরিটাল রিলেশন্স (পিএমআর বা ইএমআর)। এর ভয়ঙ্কর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (সাইড এফেক্ট) পড়ছে পরিবারে। প্রভাব পড়ছে সন্তানের ওপর। সেখান থেকে সম্প্রসারিত হচ্ছে সমাজে; কলুষিত হচ্ছে সমাজ। একদা এ বিষয়টি বড় বড় নগরীর মধ্যেই ছিল। বর্তমানে তা শহর-নগর ছাড়িয়ে গ্রামেও পৌঁছে গেছে নানা বর্ণে। খোঁজখবর করে অনেক তথ্যই মেলে। যারা এ ভাইরাসে আক্রান্ত তাদের অনেকেই চালাক। তবে বুদ্ধিমান নয়। ঘরের মানুষের কাছে যাতে ধরা না পড়ে সে জন্য তারা সতর্কতাও অবলম্বন করে নানাভাবে। উদাহরণ দেয়া যাক- একজনের মোবাইল ফোনে ‘বিশেষ মানুষের’ নম্বর সেভ করা আছে অচেনা নামে। রাতে রিং বেজে উঠলে স্ত্রী দেখেও স্বামীকে জানায় অচেনা লোক ফোন করেছে। গল্পের সেই চোর-পুলিশ খেলার মতোই যেন। আরেকজনের মোবাইল ফোনে বিশেষ মানুষের নম্বর সেভ করা আছে মোবাইল অপারেটরের ভাষা দিয়ে। যেমন ‘ব্যাটারি লো’। বর্তমানে সেলফোনের নানা অপশন আছে। অর্ধাঙ্গিনী এ ধরনের লেখা পড়ে মনে করতেও পারে সেটের ব্যাাটারি বুঝি সত্যিই লো। চতুর পুরুষরা এভাবে বিচিত্র সব শব্দ সেভ করে বোকা বানাতেই পারে (উল্টোটাও ঘটতে পারে)। তবে এমন চালাকি ধরাও পড়ে যখন স্ত্রী ফোনটি ধরে বসে। বুদ্ধিমানরা ডিপ্লোম্যাটিক নানা বুদ্ধি বের করে এই পথে এগিয়ে যায়। শেষ ফলও হয় একই। সেলফোনের বিষয়গুলো যত প্রাইভেসি হোক কনজুগাল লাইফে ঘুণপোকা ঢুকলে তার পরিণতি ভয়াবহ। মিথ্যা বলার প্রবণতা বেড়ে যায়। সত্য চাপা না থেকে প্রকৃতি একদিন প্রকাশ করেই দেয়। চোর ধরা পড়ার পর সে যতই বলুক- চুরি করতে তার লজ্জা হয়েছিল, কেউ কি তা বিশ্বাস করবে! বিশ্বাসের ভিত যখন ভেঙ্গে যায় তখন পরিবারের ওপর নেমে আসে মহাবিপর্যয়। জীবন ও পরিবারের বন্ধনকে বিপন্ন করে তোলে। পরিবারের মানুষের কাছে যার পরিচিতি হয়ে ওঠে প্রতারকরূপে। ভালবাসা কখনই প্রতারণা ও ফাঁকি মেনে নেয় না। এই বিষয়ে মনোস্তত্ত্ব বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, প্রযুক্তি অবশ্যই মানুষকে এগিয়ে নেবে। একই সঙ্গে প্রযুক্তির এ্যাবিউজগুলো না ঠেকালে বিপদও ডেকে আনে। বিশেষ করে মানব-মানবীর ভালবাসার মধুময়তার হৃদয়ে কোন কারণে ঘুণপোকা ঢুকে ভুল পথ তৈরি হলে (তরুণ-তরুণী ও মধ্যবয়সী উভয়েরই) তা পরিবার ও সমাজে কোন কল্যাণ বয়ে আনে না। এমন অবস্থায় হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়ার বিপদটা বেশি। মানুষের প্রেমপিপাসা চিরন্তÍন, চিরদুর্নিবার। ভালবাসা হীরক খ-সম প্রেম- মানুষই সেই হীরকখ-কে যতনে লালন করার অধিকার রাখে। যার মূল্য পরিশোধের ক্ষমতা কি থাকে প্রেমিক হৃদয়ে! ই-প্রণয়ের এই যুগে সাবধান না থাকলে বড়ই বিপদ।
×