ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস হাউসে দুদক আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস হাউসে দুদক আতঙ্ক

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস হাউজে অনিয়ম-দুর্নীতি নতুন নয়। ছোট-বড় এবং মহাদুর্নীতিবাজরা এ দুটি সংস্থায় জড়িত থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করে। কাস্টমস হাউজের সবকটি গ্রুপ, পণ্যের খালাস, শুরু করে হেন কোন পয়েন্ট নেই যেখানে অবৈধভাবে অর্থের লেনদেন হয় না। এক কথায় ঘুষ ছাড়া কোন ফাইল উঠেও না, নামেও না। তাই এ হাউজে ঘুষের একটি নাম ‘স্পীডমানি’। অনুরূপভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের বার্থিং, পণ্যের খালাস, গন্তব্যে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি বিরাজমান। সবচেয়ে বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটে উন্নয়ন কর্মকা-ের বিপরীতে বিভিন্ন প্রকল্পে। এছাড়া রয়েছে যন্ত্রাংশ ক্রয় কর্মকা-েও। বিভিন্ন সময়ে বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠন, সরকারী দল, শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বন্দরের দুর্নীতি রোধে এবং দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি আসলেও বিহীত কোন ব্যবস্থা দৃশ্যমান হয়নি। দুদকের পক্ষ থেকে বর্তমানে যে অনুসন্ধান ও তৎপরবর্তী কার্যক্রম শুরু হচ্ছে এ নিয়ে উভয় সংস্থার সংশ্লিষ্ট অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। গত ৩০ জানুয়ারি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় খাতের একক বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ এবং দেশের বৃহত্তম বন্দর চট্টগ্রাম বন্দরে দুদকের উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল আকস্মিক পরিদর্শনে এসে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কড়া ম্যাসেজ দিয়ে যান। এরপর গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ চট্টগ্রাম এসে শিক্ষা সেক্টরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কড়া সতর্ক বক্তব্য দিয়ে যান। এরপর দুদকের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস হাউজ কর্তৃপক্ষের কাছে ঠিকাদারি কার্যক্রম, ইক্যুইপমেন্টসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী ক্রয়, পণ্যের হ্যান্ডলিং এবং জমি ইজারা-সংক্রান্তে তাদের চাহিদার একটি পত্র প্রেরণ করেছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমস হাউজের কর্মকা-ে দুদক ভীতি পেয়ে বসেছে। কাস্টমস সূত্র জানায়, দুদকের উচ্চপর্যায়ের টিম পরিদর্শনের পর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে দুর্নীতিবিরোধী কড়া ম্যাসেজ পেয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যায়ে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয় তারা রয়েছেন অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে আর যাদের কোন না কোনভাবে ফাইলে স্বাক্ষর রয়েছে তারা পড়েছেন দুশ্চিন্তায়। উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৮০ ভাগেরও বেশি আমদানি-রফতানির পণ্য পরিবাহিত হয়ে থাকে। আর চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউজ এককভাবে জাতীয় কোষাগারে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা যোগান দেয়ার টার্গেট রয়েছে এবার। দুদক সূত্রে জানা গেছে, এখন দুদক নড়েচড়ে বসেছে। ইতোমধ্যেই সরকারের পদস্থ বহু কর্মকর্তা ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার হয়েছেন। দুদকের আবেদনক্রমে পুরনো মামলাগুলোর অধিকাংশ সচল হয়েছে। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম কাস্টমস ও চট্টগ্রাম বন্দরে দুদকের পক্ষ থেকে দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়েছে এতে রাঘববোয়ালরা আটকেও যেতে পারেন বলে জল্পনা-কল্পনা চলছে। কাস্টমসের চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের দুর্নীতির পরিমাণ অঙ্কের হিসেবে বেশ বড়। ২২৯ কোটি টাকার কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিং সম্পন্ন না করে মালয়েশিয়ার এমএমডিসি নামের একটি প্রতিষ্ঠান ১৬৫ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পর মামলা-মোকদ্দমায় বিষয়টি স্থান পেয়েছে। এছাড়া টার্মিনাল অপারেটরদের বিল পরিশোধের প্রক্রিয়ায় রয়েছে বড় ধরনের ফাঁকফোকর। পুরনো তিনটি জাহাজকে নতুন দেখিয়ে কেনার ঘটনাটি বিস্ময়কর হলেও ওই সময়ের কর্মকর্তা সবাই পদোন্নতি পেয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, সর্বোচ্চ ১৫ কোটি টাকার পুরনো জাহাজ রিকন্ডিশন্ড করিয়ে ওই তিনটি পুরনো জাহাজকে নতুন দেখিয়ে ৫০ কোটি টাকায় কেনা দেখানো হয়েছে। এসব জাহাজ চট্টগ্রাম-পানগাঁও সমুদ্র রুটে কন্টেনার পরিবহনের জন্য কেনা হলেও আমদানিকারকদের অনাগ্রহের কারণে জাহাজ তিনটি অলস অবস্থায় পড়ে থাকে। এ অবস্থায় এ তিনটি জাহাজ চালানোর জন্য একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেয়া হয়। তারাও খুব বেশি সুবিধা করতে পারছে না বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। অপরদিকে, প্রায় ৪৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প কাজে নাম সর্বস্ব ভুয়া কোম্পানির নামে প্রায় ১৮ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। এছাড়া ঢাকার কমলাপুর আইসিডি’র (যা চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ন্ত্রণাধীন) কন্টেনার হ্যান্ডলিং কার্যক্রমে রয়েছে বড় ধরনের ঘাপলা। যে প্রতিষ্ঠানটি ৬৯ কোটি টাকার বেশিতে কাজটি পায় এবং পরবর্তী সময়ে শর্তানুসারে কোনটিই পালিত হয়নি। পক্ষান্তরে চুক্তিভঙ্গকারী ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গোপন আঁতাত হওয়ায় এ নিয়ে কার্যকর কোন ব্যবস্থা হয়নি। ভিটিএমআইএস (ভ্যাসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন), ৪০ ফুট উঁচুর একটি টাওয়ার প্রধান কন্ট্রোল রুম বহুতল ভবন নির্মাণ, ক্যামেরা রাডার ও ক্লোজড সার্কিট টিভি সিস্টেম প্রতিষ্ঠায় স্তরে স্তরে রয়েছে দুর্নীতি। ২০১৪ সালের শেষদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের নজিরবিহীন দুর্নীতির ঘটনাবলী নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম হয়। ওই সময়ে কেলেঙ্কারির তালিকাও সরকারের কাছে প্রদান করা হয়। কিন্তু পুরো ব্যাপারটি ছিল লাগামহীন। দুদকের পক্ষ থেকে ছোটখাট কিছু ঘটনা নিয়ে তদন্ত হলেও বড়গুলোতে তারা হাত দেয়নি। এখন দুদক সূত্রে জানানো হয়েছে, তাদের কাছে বন্দর ও কাস্টমস নিয়ে দুর্নীতির অসংখ্য অভিযোগ পৌঁছেছে। এসব অভিযোগ থেকে বাছাইকৃত কিছু ঘটনা নিয়ে তারা প্রথমে অনুসন্ধান চালাবেন। অনুসন্ধানে সত্যতা মিললে মামলার মাধ্যমে তদন্ত শুরু হবে। এ ক্ষেত্রে ওই সময়ে ক্ষমতায় যারা ছিলেন যারা ফাইলে স্বাক্ষরদানকারী তাদের কেউ রেহাই পাবেন না।
×