ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধিকাংশ নতুন বই চলে এসেছে, কেনার শেষ সময়

প্রকাশিত: ০৫:২৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

অধিকাংশ নতুন বই চলে এসেছে, কেনার শেষ সময়

মোরসালিন মিজান ॥ বয়স অনেক হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার। ২৮ দিনের আয়োজন। শনিবার ছিল ১৮তম দিন। সঙ্গত কারণে বই যা আসার, মোটামুটি চলে এসেছে। এখন কেনার শেষ সময়। সচেতন পাঠকমাত্রই পছন্দের তালিকা ধরে বই সংগ্রহ করছেন। গত শুক্রবার বিপুল পরিমাণ লোক সমাগম হয়েছিল মেলায়। এতো লোক আগে কোনদিন দেখা যায়নি। শনিবার উপস্থিতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি বেড়ে কয়েকগুণ হয়েছে। আগের মতো আড্ডা ঘুরে বেড়ানো চোখে পড়েনি। সময় নষ্ট করার মতো সময় ছিল না হাতে। এদিন অভ্যাসবশত চেনাজানা স্টলের সামনে কেউ থেমে যাননি। পছন্দের বই খুঁজতে মেলার প্রতিপ্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন। অখ্যাত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে কোন ভাল বই থাকলে, সেটিও ঠিক খুঁজে বের করেছেন পাঠক। সব দেখে মনে হয়েছে, প্রকৃত অর্থেই বইয়ের মেলা। বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে কথা হয় কয়েকজন বইপ্রেমীর সঙ্গে। সন্ধ্যা নামার আগেই বই দিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে ফেলেছিলেন ওয়াকিল আহমেদ। অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা বললেন, আগেও দুইদিন মেলায় এসেছি। তখন বইয়ের তালিকা নিয়ে গিয়েছিলাম। আজ এসেছি কিনতে। বাংলা একাডেমি থেকে বেশিরভাগ বই কিনেছেন বলে জানান তিনি। পাশাপাশি কয়েকটি প্রবন্ধ সঙ্কলন সংগ্রহ করেছেন। আবিদুর রহমান নামের আরেক পাঠক একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। বললেন, উপন্যাস এবং অনুবাদ সাহিত্যে আমার খুব আগ্রহ। তবে খুব বেশি বই পাওয়া যায়নি। তাই পুরনো এবং আগে পড়া হয়নি এমন বই বেশি কিনেছি। শিশু প্রহর ॥ শনিবার হওয়ায় এদিন শুরুটা হয় শিশু প্রহর দিয়ে। সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত চলে শিশুদের বিশেষ আয়োজন। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বই কেনা ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। একুশে উদ্যাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শিশুকিশোর সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্ব। উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে আকিবা আফরোজ রাকা, যুগ্মভাবে দ্বিতীয় হয়েছে সুমাইয়া সাবিকুন্নাহার ও তারানা তাবাসসুম মিম। তৃতীয় হয়েছেন নামিরা রহমান অন্তরা। সাধারণ জ্ঞান প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন মারজান শাওয়াল রিজওয়ান, যুগ্মভাবে দ্বিতীয় হয়েছেন রাইসা চৌধুরী ও নাবিলা হক বিস্মি। তৃতীয় হয়েছেন সায়েদা করিম মেশা। ১৫৬ নতুন বই ॥ অমর একুশে গ্রন্থমেলার ১৮তম দিনে মেলায় নতুন বই এসেছে ১৫৬টি। এগুলোর মধ্যে গল্প ১৯, উপন্যাস ২৩, প্রবন্ধ ৭, কবিতা ৪৭, গবেষণা ৪, ছড়া ৭, শিশুসাহিত্য ১০, জীবনী ২. মুক্তিযুদ্ধ ৫, বিজ্ঞান ১, ইতিহাস ৩, রাজনীতি ২, চিকিৎসা/স্বাস্থ্য ২, অনুবাদ ২, সায়েন্স ফিকশন ১ এবং অন্যান্য বিষয়ের ওপর লেখা ২১টি বই। মোড়ক উন্মোচন ॥ নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের আনুষ্ঠানিকতা চলছে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে। প্রতিদিনই বিভিন্ন বিষয়ে লেখা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হচ্ছে। শনিবার ৬১টি নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর তিনটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন। নির্বাচিত বই ॥ মাওলা ব্রাদার্স থেকে মেলায় এসেছে সৈয়দ শামসুল হকের ‘অনুবাদ কবিতা সমগ্র।’ অন্য ভাষার কবিতা। অন্য কবির লেখা কবিতা। অনুবাদ করেছেন সৈয়দ হক। সেইসব কবিতা নিয়ে সমগ্র। একই প্রতিষ্ঠান বের করেছে আবুল মাল আবদুল মুহিতের ‘মুক্তিযুদ্ধের রচনাসমগ্র।’ মুক্তিযুদ্ধের সময়, স্মৃতি ও সংগ্রামের নানা দিক বইতে তুলে ধরার প্রয়াস। প্রবাসী বাঙালীদের আন্দোলন সংগ্রামের জানা অজানা অনেক তথ্য ওঠে এসেছে। মেলায় কথা প্রকাশ থেকে এসেছে ড. আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেনের প্রবন্ধ সংকলন ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’ মোট ১১টি প্রবন্ধে নিজের মতামত তুলে ধরেছেন লেখক। অনিন্দ্য থেকে প্রকাশিত হয়েছে আহমদ রফিকের ‘বুদ্ধিজীবীর সংস্কৃতি বনাম জনসংস্কৃতি।’ বইতে ভাষা আন্দোলন জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিবাদী আন্দোলনের তুলনামূলক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন লেখক। সাযযাদ কাদিরের ‘বাংলাদেশ ১৯৭১ উদ্যত সঙ্গীতের নিচে’ প্রকাশ করেছে আহমদ পাবলিশিং হাউস। বইতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে প্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া লেখক নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন। বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে প্রকাশিত লেখাগুলো বইতে একসঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে। ইয়াসমীন হকও কলম ধরেছেন। লিখেছেন শাজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি। ‘সাস্টে ২২ বছর’ শিরোনামে বইটি প্রকাশ করেছে তাম্রলিপি। স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে, লেখক গত ২২ বছর ধরে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। তার আরেকটি পরিচয় তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও খ্যাতিমান লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের সহধর্মিণী। সঙ্গত কারণেই বইতে ওঠে এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ঘটনা। ঘটনার পেছনের ঘটনা। মুহম্মদ জাফর ইকবাল সম্পর্কেও অনেক অজানা তথ্য বই থেকে পাওয়া যাবে। অন্যপ্রকাশ বের করেছে ফারুক মঈনউদ্দীনের ভ্রমণ সাহিত্য ‘বিশ্বজোড়া অনন্ত অঙ্গনে।’ আমেরিকা তুরস্ক নেদারল্যান্ড মঙ্গোলিয়া এবং ভারতের ১৫টি গন্তব্য নিয়ে লেখা ভ্রমণকাহিনী আগ্রহীদের ভাল লাগতে পারে। এ্যাডর্ন প্রকাশ করেছে রেজাউল করিম খোকনের গল্পগ্রন্থ ‘শহরে এক আগন্তুক।’ চিরচেনা বাস্তব জীবনের গল্পগুলোই নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করেছেন গল্পকার। মেলায় সংস্কৃতি মন্ত্রী ॥ প্রতিদিনই একাধিক মন্ত্রী মিনিস্টারের আগমন ঘটে মেলায়। তবে আয়োজনটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের। এই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর মেলায় আসলে তার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতেই হয়। তবে এদিনও তিনি ঠিক মেলা পরিদর্শনে আসেননি। একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছিলেন। এর পর সামান্য ঘুরে দেখা। কয়েকটি স্টলে বই দেখেন মন্ত্রী। তার পর প্রতিক্রিয়া জানানোর মতো করে বলেন, বসন্তের বাতাসে বইমেলায় ঘুরতে ভাল লাগে। আমি বাচিক শিল্পী। কবিতা ভালবাসি। এবার মেলায় অনেকগুলো কবিতার বই বেরিয়েছে। সংগ্রহ করব। পছন্দের কবিতা মঞ্চে আবৃত্তি করবেন বলেও জানান তিনি। মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘নব্বইয়ের দশকের কবিতা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন কবি মোস্তাক আহমাদ দীন। আলোচনা করেন ড. শহীদ ইকবাল ও ড. এ. এম. মাসুদুজ্জামান। সভাপতিত্ব করেন কবি সাজ্জাদ শরিফ। প্রাবন্ধিক বলেন, বিষয়-বৈচিত্র্য নিয়েই নব্বইয়ের দশকের কবিতা, নব্বইয়ের বিভিন্ন কবির কণ্ঠে সত্তরের মতো যৌথ শব্দস্রোতে সম্মিলিত চরণসজ্জায় কিংবা আশির দশকের মতো মিথের ব্যবহারে কেবল কালের কথা উঠে আসে না; কবিতা এখন হয়ে ওঠে আত্ম-অনুভূতি ও সত্তা-উপলব্ধির ব্যঞ্জনাগর্ভ স্বরগ্রাম। নব্বইয়ের দশকের পর আরও দেড় দশক অতিক্রান্ত, দশকের অনেক কবি এখনও সক্রিয়, শুরুর দিকে বিচ্ছিন্নতা ও অস্থিরতা কাটিয়ে তারা এখন স্থিতধী ও পরিণত, তাই তাঁদের নতুন কবিতা এখন আরও বেশি পাঠকদের আকৃষ্ট করে চলছে। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পর্বে ছিল নাগরিক নাট্যাঙ্গনের নাটক ‘ক্রীতদাসের হাসি’র মঞ্চায়ন।
×