ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আইন থাকলেও সঠিক প্রয়োগ নেই;###;জনসচেতনতার অভাবে অনেকেই এদের সমাজের অভিশাপ বলে মনে করেন ;###;নারী প্রতিবন্ধীরা অবহেলার শিকার বেশি ;###;গণপরিবহনে আসন সংরক্ষিত থাকছে না

চিকিৎসা শিক্ষা চাকরিসহ সবক্ষেত্রেই বঞ্চিত ১৫ লাখ প্রতিবন্ধী

প্রকাশিত: ০৫:২২, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

চিকিৎসা শিক্ষা চাকরিসহ সবক্ষেত্রেই বঞ্চিত ১৫ লাখ প্রতিবন্ধী

মশিউর রহমান খান ॥ সাংবিধানিকভাবে জন্মসূত্রে দেশের প্রতিটি মানুষের সমান অধিকারের কথা বলা হলেও প্রতিনিয়ত সমাজে অবহেলিত হচ্ছে প্রতিবন্ধীরা। যাত্রাপথে, শিক্ষা গ্রহণ, সরকারী ও বেসরকারী সকল চাকরিতে, পরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে, ভাতা প্রাপ্তিতে, সড়ক মহাসড়কের ফুটপাথে হাঁটতে কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণেও বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের প্রায় ১৫ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। শারীরিক, মানসিক কিংবা শ্রবণ প্রতিবন্ধী কেউই বাদ পড়ছে না এ অবহেলার হাত থেকে। দেশের বিদ্যমান আইনে সরকারকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের আইনী সুরক্ষার ব্যবস্থা এবং সুস্থ মানুষের মতো তাদেরও সমানাধিকার প্রদানের কথা বলা হলেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। অনেকেই প্রতিবন্ধীদের সমাজের অভিশাপ বলে মনে করেন। অথচ তারা আমাদের সমাজেরই লোক। তাদেরও রয়েছে এদেশে সবার মতো সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। রাষ্ট্র ও দেশের সংবিধান তাই বলে। সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় তাদের জীবন জীবিকা সুবিধা অসুবিধা নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করলেও সমাজের সকল স্তরে এখনও প্রতিবন্ধীদের স্বাভাবিকভাবে বরণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছে না সমাজের সকল স্তরের মানুষ। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী প্রতিবন্ধীসহ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি মানুষই সমান অধিকার বা মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখেন। বাংলাদেশে বৈষম্যের মাত্রা কিছুটা কমে আসলেও অনেক স্থানেই প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম দেয়া পিতা মাতাকে তাদের পাপের ফল বলেই আখ্যা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে নারী প্রতিবন্ধীরা অবহেলার শিকার সবচেয়ে বেশি। এ নিয়ে সরকারের আগ্রহের যথেষ্ট ঘাটতি ও সমাজের সকল স্তরের মানুষের অবহেলার কারণে শিশু ও বয়স্ক সকল বয়সী প্রতিবন্ধী তাদের সুবিধাবঞ্চিত সম্প্রদায়ের অংশ বলেই মনে করতে বাধ্য হচ্ছে। যা সংবিধানের সুস্পষ্ট লংঘন। ফলে মুখ বুঝেই তারা নীরবে নিভৃতে দিন কাটান। বাংলাদেশের চলমান প্রেক্ষিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এককভাবে রাস্তায় চলাচলের কোনও পরিবেশ নেই। এমনকি প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার ঘোষিত ও বাধ্যতামূলকভাবে পালনের জন্য নির্দেশিত বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারী বা আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে প্রতিনিয়তই লংঘনের প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। প্রতিবন্ধীদের নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাছ থেকেও এ ধরনের মন্তব্য উঠে আসে। সংশ্লিষ্টদের মতে, ব্যক্তির প্রতিবন্ধিতা নয়, সামাজিক এবং অবকাঠামোগত প্রতিবন্ধকতাই প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চলার পথে প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সংখ্যা কতো সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনও তথ্য নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পৃথক দুটি বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ১০ থেকে ১৬ ভাগ পর্যন্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সে হিসেবে দেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা দেড় কোটি ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। তবে সমাজ কল্যাণ সংস্থা পরিচালিত প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ কর্মসূচী অনুযায়ী দেশে এ মুহূর্তে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ১৪ লাখ ৮২ হাজার ৭১৬ জন। তবে অন্যান্য সংস্থার দাবি দেশে প্রতিবন্ধীদের প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি। অনেক পিতামাতাই সমাজিক লোকলজ্জার ভয়ে তার সন্তানকে প্রতিবন্ধী হিসেবে নাম তালিকাভুক্ত করতে রাজি হন না। বিশেষ করে মেয়ে সন্তানের বেলায় তা আরও প্রকট হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ। যা মোট জনসংখ্যার ১৫.৭ শতাংশ। অথচ এই মানুষগুলোর জন্য ২১ বছর আগে প্রণীত বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে (বিএনবিসি) নির্মীয়মাণ ভবনে সবার জন্য প্রবেশগম্যতার বিষয়টি স্থান পায়নি। সংবিধানের ১৯ (১) ও ২৮ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নাগরিকদের সকল ক্ষেত্রে সুযোগের সমতা বিধানের কথা বলা হয়েছে। এছাড়া ২০০৭ সালে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ (সিআরপিডি) অনুসমর্থনকারী দেশ হিসেবে এর বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অঙ্গীকারাবদ্ধ। এ হিসেবে বিভিন্ন সরকারী ভবনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির প্রবেশগম্যতাকে উপেক্ষা করা সংবিধান ও আন্তর্জাতিক সনদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিক অধিকারের কথা সমান বলা হলেও দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী সড়ক-মহাসড়ক, ফুটপাথ, ফুটওভার ব্রিজসহ গণপরিবহন প্রতিবন্ধীবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার কথা থাকলেও আজ পর্যন্ত এ নির্দেশ বাস্তবায়নে তেমন সাড়া মিলেনি। নির্দেশানুযায়ী প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ থাকার কথা থাকলেও তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। গণপরিবহনে নারী ও শিশুদের সঙ্গে প্রতিবন্ধীদের জন্য ছোট পাবলিক বাসে কমপক্ষে ৬টি বড় বাসের ক্ষেত্রে ৯টি আসন সংরক্ষিত রাখতে হবে। কিন্তু তেমন জনসচেতনতা না থাকায় এখনও এসব আসনে প্রতিবন্ধীরা বসতে পারেন না। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৯০ শতাংশ জনগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণের সময় বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ঐসব ভবনে প্রবেশের ক্ষেত্রে সুবিধাÑঅসুবিধাগুলো বিবেচনায় নেয়া হয়নি। ফলে ভবনগুলো হয়ে পড়েছে প্রতিবন্ধী বিরোধী। এসব ভবনে কোন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস বা চলাচল করতে পারছেন না। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সমাজের মূল ধারা থেকে তারা পিছিয়ে পড়ছে। বাস বা যে কোন গণপরিবহনে নারী ও শিশুদের ওঠার সুযোগ থাকলেও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে কোন গণপরিবহনেই ওঠার সুযোগ নেই। বিশেষ করে শারীরিক প্রতিবন্ধীদের বেলায় তা প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। মূলত প্রধান প্রতিবন্ধীরা হুইল চেয়ারে করে বাসে বা গণপরিবহনে উঠতেই পারে না কারণ এর কোন ব্যবস্থা দেশের গণপরিবহনগুলোর নেই। এছাড়া লাইন ধরে বাসে ওঠার ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধীদের কোন প্রকার অগ্রাধিকার পর্যন্ত দিতে দেখা যায় না। রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন মহানগরে বসবাসকারী নাগরিকদের পরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে যে কোন সুস্থ মানুষ ও প্রতিবন্ধীদের মাঝে বাসে বা পরিবহনের উঠা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হয়। এক্ষেত্রে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী বা শারীরিকভাবে দুর্বল বা প্রতিবন্ধীদের অধিকার সম্পর্কে বাধ্যতামূলক কোন আইন না থাকায় ও বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিবহনে চলাচল করতে অপেক্ষা করতে হয়। বেশিরভাগ সময় অত্যাধিক ভিড়ের চাপে নির্দিষ্ট পরিবহনে উঠতে না পারার কারণে প্রতিবন্ধীদের যাত্রা বাতিল করে বাসায় ফিরতে হয়। নির্ধারিত আসনে বসার জন্য নারীদেরই যেখানে তর্কযুদ্ধ চালাতে হয়, প্রতিবন্ধীদের আসনের নিশ্চয়তা তো নেই বললেই চলে। মূলত স্থাপনা ও ভবন অথবা ফুটপাথের পাশে ঢালু পথ বা র‌্যাম্প, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ব্রেইল ব্লক, লিফটে ফ্লোর এ্যানাউন্সমেন্ট, ব্রেইল বাটন, স্বল্প দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি জন্য কিছু ছবির ব্যবহার বা ভবনের ম্যাপ তৈরি, কিছু বিশেষ রঙের ব্যবহার এবং এসব অপ্রতিবন্ধী মানুষের চলার পথকে আরও সহজ করে। এসব পদ্ধতির কোন ব্যবহার না থাকায় প্রতিবন্ধী মানুষ চলাচলে ও সমাজে বসবাসের ক্ষেত্রে অসহায় হয়ে পড়ে। প্রতিবন্ধীদের অধিকারের কথা চিন্তা করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ২০০৯ সালের ৭ ডিসেম্বর বিভিন্ন সরকারী অফিস ও ভবনে প্রতিবন্ধীদের প্রবেশের সুবিধার্থে প্রয়োজনীয়সংখ্যক র‌্যাম্প ও তাদের ব্যবহার উপযোগী টয়লেট (প্রতি তলায় ন্যূনতম একটি অথবা মোট টয়লেট সংখ্যার ৫ শতাংশ) নির্মাণের ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেয়। নির্দেশ প্রতিপালনে সংশ্লিষ্ট ৯টি সরকারী প্রতিষ্ঠানকে জরুরী বাস্তবায়ন করতে পরিপত্র জারি করে। পরিপত্রে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) কর্তৃক ভবন নির্মাণের প্ল্যান পাশের সময় বিভিন্ন সরকারী ভবন এবং পাবলিক প্লেস হিসেবে ব্যবহার্য ভবন, যেমন- ব্যক্তিমালিকানাধীন বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক হোটেল, কমিউনিটি সেন্টারে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিবান্ধব র‌্যাম্প ও টয়লেট নির্মাণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এসব নির্দেশনার সামান্যও বাস্তবায়ন করেনি। শুধুমাত্র রাজধানীর সচিবালয় ও জাতীয় জাদুঘরে প্রতিবন্ধীবান্ধব র‌্যাম্পের ব্যবস্থা রয়েছে। অপরদিকে ২০০৬ সালে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্ট নিজ উদ্যোগে প্রতিবন্ধীবান্ধব র‌্যাম্পের ব্যবস্থা করে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিভিন্ন সরকারের সময় প্রতিবন্ধীদের অধিকারের জন্য প্রণীত আইন সম্পর্কে সচেতনতা না থাকা, আইনের সঠিক কার্যকারিতা না থাকা এবং ভবন নির্মাণের সময় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সহজে প্রবেশগম্যতার অধিকারের বিষয়টি উপক্ষো করাই সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়িত না হওয়ার অন্যতম কারণ। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশে পরিবহনে ওঠানামার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের জন্য কোন বিশেষ সুবিধা নেই, প্রতিবন্ধীদের জন্য আজ পর্যন্ত কোন নির্দিষ্ট বাস কাউন্টার তৈরি করা হয়নি। নগরীতে রাস্তা পারাপারের জন্য একসময় জেব্রা ক্রসিং থাকলেও বর্তমানে তা দেখা যায় না। ট্রাফিক ব্যবস্থা ট্রাফিক পুলিশ কর্তৃক ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করায় প্রতিবন্ধীদের পক্ষে কখন সিগন্যাল পড়বে এবং কখন তা উঠিয়ে নেয়া হবে তা বোঝার উপায় থাকে না। ফলে অসংখ্য দুর্ঘটনা ঘটছে। যার শিকার হচ্ছেন প্রতিবন্ধীরাও। আবার দুর্ঘটনায় নতুন করে প্রতিবন্ধী তৈরি হচ্ছে। রাস্তা পারাপারের জন্য তৈরি করা ওভার ব্রিজগুলো প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। এছাড়া সরকারী-বেসরকারী অফিসেও প্রতিবন্ধীদের চলাচলের জন্য বিশেষ কোন বন্দোবস্ত নেই। এমনকি কোনও ভবনে দুর্ঘটনা ঘটলে হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী ব্যক্তিটির নেমে আসার জন্য পর্যাপ্ত সুবিধাও নেই। ফলে বাধ্য হয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিটির দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ এর ৩২ ধারাতে বলা আছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সরকার কর্তৃক সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে সকল গণপরিবহনে মালিক বা কর্তৃপক্ষ তৎপরিবহনের মোট আসন সংখ্যার শতকরা ৫ (পাঁচ) ভাগ আসন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সংরক্ষিত রাখিবেন। অপরদিকে ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৩’তেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এ আইনের ধারা ২ (সংজ্ঞা) এর উপধারা ১৩-এ বলা হয়েছে ‘প্রবেশগম্যতা’ অর্থ ভৌত অবকাঠামো, যানবাহন, যোগাযোগ, তথ্য, এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসহ জনসাধারণের জন্য প্রাপ্য সকল সুবিধা ও সেবাসমূহে অন্যান্যদের মত প্রত্যেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সমসুযোগ ও সমআচরণ প্রাপ্তির অধিকার। এছাড়া ‘জাতীয় সমন্বিত বহুমাধ্যমভিত্তিক পরিবহন নীতিমালা, ২০১৩’-এর ৪.৪-এ মহিলা, বয়োজ্যেষ্ঠ ও শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য পরিবহন; ৪.৪.১-এ পথচারীদের জন্য পায়ে চলার পরিবেশ মানোন্নয়ন, বিশেষত শিশু, মহিলা, বয়স্ক এবং শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের (ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জ) ব্যববহার উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিতকরণ; ৪.৪.৪-এ রেলস্টেশন ও বাস স্টপে র‌্যাম্প ব্যবহার এবং নৌ-পথে বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে যাতায়াত সহজীকরণ; ৫.১.৫-এ শারীরিক বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পথচারীদের ফুটপাথ ওঠানামা সহজতর করার লক্ষ্যে ঢালু পথ (র‌্যাম্প) এর সংস্থানের কথা বলা হয়েছে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালাতে ১ ইঞ্চি অনুপাত ১২ ইঞ্চি লম্বা র‌্যাম্প নির্মাণের কথা বলা হলেও কোন কোন জায়গায় ১ ইঞ্চি অনুপাতে ৩ ইঞ্চি র‌্যাম্প রয়েছে যা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। সার্বজনীন প্রবেশগম্যতায় শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধী মানুষের চাহিদাগুলো সম্পূর্ণরূপেই উপেক্ষিত। কোথাও ইশারা ভাষার কোন ধরনের সহযোগিতা লক্ষ্য করা যায় না। তথ্য অনুসন্ধান নোটিসবোর্ড বা সিটিজেন চার্টার লোকেশন ম্যাপ নেই বললেই চলে। প্রবেশগম্যতা সম্পর্কিত বিষয়ক অভিজ্ঞ ব্যক্তি, বুয়েট ও চুয়েটের প্রকৌশলী, ইশারা ভাষার দোভাষী ও স্বেচ্ছাসেবীদের একটি দল নিয়ে ওই নিরীক্ষায় এ তথ্য উঠে আসে। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় প্রতিবন্ধী মানুষের সর্বজনীন প্রবেশগম্যতা সম্পর্কিত বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে। বিধিমালায় আইন লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদ-ের বিধান যোগ করা হয়েছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আইনটি প্রয়োগ করবেন। তবে আজ পর্যন্ত এ আইনটির এটির কার্যকারিতা লক্ষ্য করা যায়নি। যদিও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ তে বিভিন্ন স্থাপনায় প্রতিবন্ধী মানুষের প্রবেশগম্যতার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এর আলোকে জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও তা আজও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে অবহেলিতই রয়ে গেছে সকল আইন। প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে চলমান সমস্যা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতে হুইলচেয়ারে ওঠার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য টেকটাইল এবং বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে সঙ্কেত ভাষার ব্যবস্থা করতে হবে। অপরদিকে সব ধরনের গণপরিবহনে প্রতিবন্ধীব্যক্তিদের জন্য বাধ্যতামূলক আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। রেলের বগিতে হুইলচেয়ার উঠতে রেলস্টেশনের প্লাটফর্মগুলো বগির সমান করা ও বগিতে হুইল চেয়ার সহজে ঢুকতে বগির প্রবেশ মুখগুলো বড় করতে হবে। পাশপাশি সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে প্রতিবন্ধীবান্ধব ফুটপাথ তৈরি করার উদ্যোগ হাতে নিতে হবে। এছাড়া সরকার এক্ষেত্রে যেসব উদ্যোগ হাতে নিয়েছে তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। শহর ও গ্রামের সকল বাস স্টপেজকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে। বাসগুলোতে অডিও সিস্টেম রাখতে হবে যাতে করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা শুনে গন্তব্য এবং বাস সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। এছাড়া গণপরিবহন আমদানির লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে সেগুলো প্রতিবন্ধীবান্ধব কিনা তাও নিশ্চিত করতে হবে। তবেই কেবল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চলাচল অনেকটা নিশ্চিত হবে। কিছুটা হলেও ফিরে পাবে তাদের অধিকার। এজন্য সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে সরব হতে হবে ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা দেশের সকল শ্রেণীর প্রতিবন্ধীকে সুযোগ সুবিধা আদায়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছি। তারা সমাজের বোঝা নয় তারা আমাদেরই অংশ। তারা আমাদেরই সন্তান, ভাই বোন কিংবা কারো পিতামাতা। তাদের কোনক্রমেই অবহেলা করা যাবে না। এরা সমাজের বিচ্ছিন্ন নয় মূল অংশের লোক। এরপরও আমাদের দেশে এখনও বিভিন্ন স্তরে প্রতিবন্ধীরা নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। তবে এসব সমস্যা সমাধানে ও প্রতিবন্ধীদের সামাজিক জীবনের উন্নতিকল্পে আমাদের আরও সময় দিতে হবে। বর্তমান সরকার গণপরিবহনে আসন সংরক্ষণ থেকে শুরু করে, বিভিন্ন প্রকার সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা চালু করা, প্রতিবন্ধী অধিকারসহ বিভিন্ন আইন প্রণয়নসহ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকার প্রতিটি কাজে প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার প্রদান করছে। এর ফলে বর্তমানে যে কোন সময়ের চেয়ে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধী তাদের অধিকার ভোগ করতে পারছেন। সমাজে প্রতিবন্ধীদের সবার মতো সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখতে হবে। তাই সমাজের সকল শ্রেণীর নাগরিককে প্রতিবন্ধীদের অবহেলা নয় সমাজের অংশ হিসেবে মনে করে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে এগিয়ে আসার জন্য তিনি আহ্বান জানান।
×