ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সবক্ষেত্রে বাংলা ভাষা এখনও উপেক্ষিত

উচ্চ আদালতের অধিকাংশ বিচারপতি ইংরেজীতেই রায় লিখছেন

প্রকাশিত: ০৫:২০, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

উচ্চ আদালতের অধিকাংশ বিচারপতি ইংরেজীতেই রায় লিখছেন

বিকাশ দত্ত ॥ আইন কমিশনের সুপারিশ ও বেশ কিছু বিচারপতির বাংলায় রায় দেয়ার পরও উচ্চ আদালতের বেশির ভাগ বিচারপতি ইংরেজীতেই রায় লিখছেন। নিম্ন আদালতগুলোতে বিচারকাজে বাংলার ব্যবহার বাড়লেও উচ্চ আদালতে এখনো অবহেলিত। এদিকে সুপ্রীমকোর্টের আপীল ও হাইকোর্ট বিভাগে প্রথা এবং রীতিনীতির কথা বলে সকল কাজকর্ম চলছে ইংরেজী ভাষাতেই। সুপ্রীমকোর্টের উভয় বিভাগে বিচারপতিগণ রায়, আদেশ বা নির্দেশনা দিচ্ছেন বেশির ভাগই ইংরেজীতে। আইনজীবীরাও তাদের শুনানি (বক্তব্য) রাখেন ইংরেজী ভাষাতেই। ফলে পবিত্র বাংলা ভাষা হচ্ছে উপেক্ষিত। এ বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার (বিচার ও প্রশাসন) মোঃ সাব্বির ফয়েজ জনকণ্ঠকে বলেছেন, কোন ভাষায় রায় দেবেন এটা একান্তই বিচারপতিদের বিষয়। তারা ইচ্ছা করলে যেকোন ভাষায় রায় দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহারে কোন বাধা নেই। নিম্ন আদালতের সিংহভাগ রায় ও আদেশ এখন বাংলায় হচ্ছে। আশা করি উচ্চ আদালত এক সময় বাংলা প্রচলন হবে। তবে সময় লাগবে। এদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ জনকণ্ঠকে বলেছেন, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু একদিনে হবে না। অনেকেই বাংলায় রায় দিচ্ছেন। আস্তে আস্তে এই প্রচলন চালূ হবে আশা করি। আইন কমিশনের সদস্য অধ্যাপক ড. এম শাহ আলম বলেন, যেহেতু বর্তমানে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনে কোন আইনগত বাধা নেই, সেহেতু বিচারপতিরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহার করতে পারেন। সুপ্রীমকোর্টে বাংলায় অনেক বিচারপতি রায় লিখেছেন। সুপ্রীমকোর্টের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিচারপতি আমীরু ইসলাম চৌধুরী বাংলা ভাষায় রায় লেখেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বাংলা ভাষায় সর্বাধিক রায় লিখে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তাই বর্তমান সময়ে সুপ্রীমকোর্টের বিচারকরা বাংলায় রায় লিখলে কোন সমস্যা হবে না বলে মনে করি। আইনজীবীরা মনে করেন, অনেক বিচারপতি বাংলায় রায় দিচ্ছেন। একদিনে এটা সম্ভাব হবে না। আস্তে আস্তে উচ্চ আদালতে বিচাপতিগণ বাংলাতেই রায় লিখবেন। এমন একদিন আসছে যখন উচ্চ আদালতে সকল রায়ই হবে বাংলায়। সে জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। আইনজীবীরা আরও বলেন, বিচারপতিগণ কোন ভাষায় রায় দেবেন এটা একান্তই বিচারপতিদের বিষয়। তারা ইচ্ছা করলে বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় রায় দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। এর আগে সাবেক প্রধানবিচারপতি এবিএম খায়রুল হক, সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকসহ কয়েকজন বিচারপতি উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষায় বেশ কিছু রায় দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কিন্তু সেই অর্থে তাদের অনুসরণ করেননি অন্য বিচারপতিরাগণ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি লাভ করেছে, মহান ভাষা আন্দোলনের সেই দেশেরই উচ্চ আদালতে আজও উপেক্ষিত বাংলা ভাষা। অথচ জার্মানি, জাপান, ফ্রান্স, স্পেন ও নেদারল্যান্ডসসহ উন্নত বিশ্বে বিচারপ্রার্থীদের শুনানি ও রায় বোঝার জন্য উচ্চ আদালতে দাফতরিক কাজসহ আদালতের রায় ও আদেশ চলে তাদের নিজস্ব ভাষায়। উল্লেখ্য, ২০১১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি আইনকমিশনের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম শাহ আলম বিচারকাজে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ এর প্রয়োগ বিষয়ে একটি সুপারিশ করেন। ৬ বছর আগে তার ঐ সুপারিশ আজও আলোর মুখ দেখেনি। তিনি সুপারিশে বলেন, বাংলাদেশের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী ‘প্রজাতন্তের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।’ সংবিধানের এ বিধান সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে না দেখে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭ (১৯৮৭ সনের ২নং আইন) জারি করা হয়। এর ধারা ৩-এর বিধান নিম্নরূপ “৩। (১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং আইনগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। (২) ৩ (১) উপ-ধারায় উল্লিখিত কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপীল করেন তা হলে উহা বে আইনী বলে গণ্য হইবে।” সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে বিধৃত আছে যে, “আদালত” অর্থ সুপ্রীমকোটসহ যে কোন আদালত। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেছেন, আমাদের সংবিধানে ইংরেজীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করা হয়েছে। এমনকি আমাদের সংবিধানে বাংলা ও ইংরেজীর মধ্যে বিরোধ হলে বাংলাকেই প্রাধান্য দেয়ার কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রয়োগে কোন অসুবিধা দেখি না। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলন হলে জনগণ তা সহজে বুঝতে পারবে। ১৯৯১ সালের ১৭ নবেম্বর ইউনেস্কো ২১ ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভের পর বাংলা ভাষা নিজ দেশে অনেকটা অবহেলিত হয়ে আছে। নিম্ন আদালতগুলোতে বাংলা চর্চার প্রচলন রয়েছে। অবশ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি এ. বি. এম. খায়রুল হক হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি থাকাকালীন ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলা ভাষায় রায় ও আদেশ প্রদান করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দেয়া রায়ের ক্ষেত্রে আপীল বিভাগের কয়েকজন বিচারপতি বাংলা ভাষা ব্যবহার করেছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিম্ন আদালতের পাশাপাশি উচ্চ আদালতেও বাংলা ভাষার ব্যবহার বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বাংলায় আইন পাস হওয়ার পর থেকে আইন আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষায় কর্মকা- পরিচালনা করতে আইনগত কোন বাধা নেই। উচ্চ আদালতের কার্যক্রম সহজভাবে বোঝার জন্য বাংলায় আদেশ, রায় প্রকাশ করা আবশ্যক। তবে যেসব মামলায় বিদেশী সংস্থা বা নাগরিকরা পক্ষ থাকেন সেসব মামলায় ইংরেজী ভাষা ব্যবহার করা যেতে পারে। নিম্ন আদালতে বাংলার প্রচলন থাকলেও উচ্চ আদালতে এখনও পর্যন্ত ঘাটতি রয়ে গেছে।
×