ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

সম্ভাবনাময় ধোলাইখাল

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

সম্ভাবনাময় ধোলাইখাল

জুয়েল আহমেদের প্রাইভেট কারটি বাসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুমড়ে-মুচড়ে যায়। আগে থেকেই ধোলাইখালের নাম শোনার কারণে তিনি গাড়িটি কোন গ্যারেজে না নিয়ে সোজা চলে যান ধোলাইখালে। সেখানকার একটি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেন এটি মেরামত করার। সময় নেয় এক মাস। এক মাস আগেই তার কাছে ফোন আসে, গাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। গাড়ি আনতে গিয়ে দেখেন এটি একেবারে নতুনের মতো। বোঝার উপায় নেই যে, এটি দুর্ঘটনায় দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল। জুয়েল আহমেদ তার চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। রাজধানী পুরান ঢাকার জনসন রোডের ট্রাফিক সিগন্যাল পেরিয়ে নারিন্দা পর্যন্ত ধোলাইখালের বিস্তৃতি। উত্তর ও দক্ষিণ মৈশুণ্ডি, নবাবপুর, টিপু সুলতান রোড, বনগ্রাম, ওয়ারী ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় লোহা-লক্কড়, ছোট-বড় নানা কিসিমের যন্ত্রাংশের বিশাল মওজুদ। এর কেন্দ্রবিন্দু বিখ্যাত ধোলাইখাল। ধোলাইখাল ঘিরে পার্শ্ববর্তী এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় অর্ধ লক্ষাধিক ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ বা হাল্কা প্রকৌশল শিল্প কলকারখানা। এখানে কাজ করা অধিকাংশ শ্রমিকেরই নেই কোন শিক্ষাগত যোগ্যতা। কারিগরি কোন শিক্ষাও নেই। দীর্ঘদিন কাজের অভিজ্ঞতা আর নিজস্ব মেধায় তারা নিখুঁতভাবে সব রকমের মেশিনারি পার্টস তৈরি করছেন। যুগের পর যুগ ধরে এখানকার কারিগররা বাস্তব অভিজ্ঞতার শক্তিতে বলিয়ান হয়ে একের পর এক যন্ত্রপাতি তৈরি কিংবা মেরামত করছেন। ধোলাইখালের গাড়ির যন্ত্রাংশের মার্কেটটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬৮ সালে। তখন শুধু বাস ও ট্রাকের যন্ত্রাংশই পাওয়া যেত এখানে। কারণ ওই সময় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। তবে ব্যক্তিগত গাড়ি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে এর বিভিন্ন যন্ত্রাংশের চাহিদা। একই সঙ্গে জমতে থাকে গাড়ির যন্ত্রাংশের ব্যবসাও। ১৯৮০ সালের পর থেকে এ ব্যবসা বাড়তে থাকে অসম্ভব দ্রুত গতিতে। এখন তো গাড়ির যন্ত্রাংশ মানেই সারাদেশের মানুষ এক নামে চেনে ধোলাইখালকে। এখানে তৈরি করা হচ্ছে নিনিয়াম, ব্রেক ড্রাম, প্যাড ড্রাম, ব্রেক সিলিন্ডার, বাম্পার ব্রাকেট, পিস্টন ইত্যাদি। এ ছাড়া লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের- যেমন শ্যালো পাম্পের ইঞ্জিন ব্যবহার করে টেম্পো, ট্রাক্টর, ইট ভাঙার মেশিন ইত্যাদি- যন্ত্র তৈরি করা হচ্ছে। আর এগুলো মেটাচ্ছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা। শুধু তা-ই নয়, উৎপাদিত পণ্য দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রফতানি হচ্ছে বিদেশেও। এ ছাড়া কর্মসংস্থান ও দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে ধোলাইখাল মিনি মোটর ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পুরনো গাড়িকে নতুন আদল দেওয়া, গাড়ির ভিতরের ও বাইরের সাজসজ্জা, অচল গাড়ি সচল করা, মেরামতসহ যে কোন কাজে এখানকার কারিগররা খুবই দক্ষ। এ ছাড়া তারা যে কোন যন্ত্র, যেমন জেনারেটর, প্লাস্টিক মেশিন ইত্যাদি মেরামতে সিদ্ধহস্ত। অনুসন্ধানে জানা যায়, ধোলাইখালের এই মার্কেটে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১৩ হাজার দোকান রয়েছে। এসব দোকানে কর্মসংস্থান রয়েছে মালিক-শ্রমিকসহ প্রায় ৭০ হাজার লোকের। যে কোন যানবাহনের ইঞ্জিনের নাট, বল্টু, চেসিস, বিয়ারিং, টায়ার, স্প্রিংসহ ছোট-বড় সব যন্ত্রাংশই পাওয়া যায় ধোলাইখালে। এমনকি না পাওয়া গেলে তৈরি করে দেওয়া হয় ম্যাজিকের মতো। তবে কিছু দোকান বা ওয়ার্কশপ আছে, যারা শুধু নির্দিষ্ট ধরনের যন্ত্রাংশই বিক্রি করছে। সেসব দোকানের কোন কোনটিতে শুধু বিয়ারিং, আবার কোনটিতে শুধু টায়ার বা স্টিয়ারিং পাওয়া যায়। মোটর পার্টসের দোকান ছাড়াও এখানে রয়েছে ড্রামশিট, লেদ মেশিন, পুরনো লোহা-লক্কড়ের দোকান। লাইনার, পিস্টন, বিয়ারিং থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি মোটর পার্টস, গাড়ির ব্রেকড্রাম, ইঞ্জিন, কার্টিজ, সকেট, জগ, জাম্পার, স্প্রিং, হ্যামার, ম্যাকেল জয়েন্ট, বল জয়েন্টসহ নানা সামগ্রী এখানেই তৈরি হচ্ছে। ধোলাইখালে তৈরি মেশিনারি পার্টস ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ নানা দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ ছাড়া ভাল রিকন্ডিশন্ড পার্টসের জন্য দেশব্যাপী সুনাম রয়েছে ধোলাইখালের। ইতোমধ্যে ধোলাইখাল পরিণত হয়েছে মিনি মোটর ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনে। শুধু গাড়ির ইঞ্জিন মেরামতই নয়, জাহাজ, পাওয়ার প্লান্ট, জেনারেটরসহ ইঞ্জিনচালিত সব ধরনের যন্ত্রের সমস্যা সমাধান করতে পারেন ধোলাইখালের দক্ষ কর্মীরা।
×